যুদ্ধক্ষেত্র কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে নিরাপদ দূরত্বে থেকে কিভাবে সমরাস্ত্র, খাদ্য, পানি ও অন্যান্য সরবরাহ পৌঁছে দেয়া যায় তার উপায় নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরির (সিএসএআইএল) গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন রোবো ফর্কলিফট। এটি পণ্যসামগ্রী যান্ত্রিকভাবে ওঠানো ও নামানোর ব্যবস্থাসংবলিত ট্রাকবিশেষ। তবে এই ট্রাক আধা স্বায়ত্তশাসিত। এর ভেতরে বসে নয়, দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এটি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ বা বৈরী এলাকার মধ্য দিয়ে যখন সে সাপ্লাই নিয়ে যাবে তখন অতর্কিত আক্রমণ হলেও প্রাণের ঝুঁকি থাকবে না।
বর্তমানে চালক ফর্কলিফট চালিয়ে গাড়ি, ট্রেন বা জাহাজ থেকে পণ্যসামগ্রী বা অন্য সরবরাহ নামিয়ে এনে তা গুদামজাত করা এবং পরে সেখান থেকে ট্রাকে তোলার কাজ করছে। ইরাকের মতো যুদ্ধাঞ্চলে এ কাজটি করতে গিয়ে চালকরা সব সময় শত্রুর আক্রমণের ভয়ে ফর্কলিফটে বসে হামাগুড়ি দিয়ে, যাতে গুলি বা অন্য কিছুর শিকার না হয়। এর ফলে কাজের গতি মন্থর হয়ে যায়। ফলে পুরো বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এই অবস্থার উত্তরণের জন্যই গবেষকরা স্বয়ংক্রিয় ফর্কলিফট উদ্ভাবন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তাদের এই ভাবনা এখনো চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। তবে কাজটি এগিয়েছে বহুদূর।
এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সিএসএআইএলের পোস্টডক্টরাল গবেষক ম্যাট ওয়াল্টার বলেছেন, তাদের গবেষণা শেষে যখন এই রোবটিক যানটি হাতে চলে আসবে তখন যেকোনো ধরনের ঝুঁকিমুক্তভাবেই ট্রাকে পানির কন্টেনার থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রী পর্যন্ত সবকিছুই ওঠানো-নামানো সম্ভব হবে। যানটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে করে এটি বাইরে যেকোনো ধরনের পথে চলতে এবং প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পারে।
ওয়াল্টার বলেন, ইরাকে দিনে ৩/৪ বার শ্রমিকদের ফর্কলিফট থেকে দূরে থাকার বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। কারণ তারা গুলিবর্ষণের শিকার হয়। তাই প্রায় সবকিছুই করতে হবে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে। মানুষের জন্য যেটা ঝুঁকিপূর্ণ সে কাজটি করতে হবে স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত যন্ত্র দিয়ে। তবে এটা বলা যত সহজ কাজটি বাস্তবে রূপ দেয়া তত সহজ নয়।
রোবো ফর্কলিফটের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে করে এটি দূরে বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকা কিংবা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো কর্মী বা সুপারভাইজারের নির্দেশনামতো স্বায়ত্তশাসিতভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ফর্কলিফটকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, কোথা থেকে সাপ্লাই নামাতে হবে, কোথায় রাখতে হবে, ট্রাক কোথায় থামবে ইত্যাদি। এরপর গুদামের ভেতরেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরবরাহ নিয়ে যাওয়ার কমান্ড বা নির্দেশনা শেখানো হবে।
সুপারভাইজারের ট্যাবলেট কমপিউটার ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে সংযুক্ত থাকবে ফর্কলিফটের সাথে। ফর্কলিফটে যুক্ত ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে সুপারভাইজার তার কমপিউটারে সাপ্লাইয়ের অবস্থা দেখতে পাবেন এবং কোন সাপ্লাইটা জরুরি তা চিহ্নিত করে সেটি নামানোর ও যথাস্থানে সংরক্ষণ করতে নির্দেশ দেবেন। প্রযুক্তিটির যখন আরো অগ্রগতি ঘটবে তখন সুপারভাইজারের কাজ আরো কমে যাবে। তিনি তখন কেবল নির্দেশনা দেবেন ট্রাক থেকে মাল নামাও। সঙ্গে সঙ্গে ফর্কলিফট সেটি করতে শুরু করবে। আবার যানটিতে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন স্বয়ংক্রিয় অবস্থা থেকে এটিকে মানুষচালিত প্রচলিত ফর্কলিফটে পরিণত করা যাবে। গবেষকরা এখন এমআইটি ক্যাম্পাসের আউটডোরে ফর্কলিফটের সেন্সর, ক্যামেরা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখছেন।
প্রকল্প প্রধান এবং কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর সেথ টেলার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, সিএসএআইএলের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি। এর মূল প্রতিপাদ্য হলো পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে মেশিনের সচেতনতার উন্নয়ন ঘটানো। তিনি বলেন, মানুষ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয় বা পারিপার্শ্বিকতা বুঝতে পারে। কিন্তু মেশিনের ক্ষেত্রে সেটি হয় না। মেশিনকে সেন্সর, ক্যামেরা ও মেমরি দিয়ে তার কর্মপরিধি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, রোবটিক সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে তারা ইতোমধ্যেই অনেক সাফল্য পেয়েছেন। তারা উদ্ভাবন করেছেন মানুষবিহীন গাড়ি, যে কিনা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পথঘাট চিহ্নিত করে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে। জার্নাল অব ফিল্ড রোবটিকসে এ ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে আসন্ন রোবটিকস সম্মেলনে ফর্কলিফট প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। এই প্রকল্পে জড়িত রয়েছে এমআইটির সিএসএআইএল, এলআইডিএস এবং কোর্স ২, ৬ ও ১৬, লিংকন ল্যাবরেটরি, ড্রাপার ল্যাবরেটরি এবং বিএই সিস্টেমের ৩০টি ফ্যাকাল্টি, স্টাফ এবং ছাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি লজিস্টিক ইনোভেশন এজেন্সি এ প্রকল্পে অর্থ যোগান দিচ্ছে।
এদিকে জাপানের গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন কৃষকদের জন্য রোবট স্যুট। এই স্যুটের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে কৃষক ফসল ফলাতে গিয়ে কর্মক্লান্ত না হয়ে পড়ে। দেশটির কৃষি শিল্পে শ্রমিক স্বল্পতা বিরাজ করছে এবং যেসব কৃষক এখনো এ শিল্পে কাজ করছে তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক। গবেষকরা তাই ভেবেছেন, কৃষকদের জন্য এমন পোশাক তৈরি করা প্রয়োজন যা তাদের কর্মস্পৃহা বাড়িয়ে দেবে।
টোকিও কৃষি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যে স্যুটের প্রাথমিক সংস্করণ তৈরি করেছেন, তাতে ৮টি মটর এবং ১৬টি সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। ওজন ২৫ কেজি (৫৫ পাউন্ড)। বয়স্ক যেসব কৃষক বসে কাজ করতে গেলে পায়ের মাংসপেশী এবং দেহের বিভিন্ন সংযোগস্থলে ব্যথা পান এই স্যুট তাদের সে সমস্যার সমাধান দেবে। গবেষকরা আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ওই স্যুট বাজারজাত করার কথা ভাবছেন। এর দাম হবে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার ডলারের মধ্যে।
প্রফেসর শিজিকি তোয়ামা বলেছেন, হিউম্যান রোবটিকপ্রযুক্তি বিভিন্ন শিল্পে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু কৃষিশিল্পে এর রয়েছে অনেক সম্ভাবনা। তিনি বলেন, যেসব দেশে কৃষি কাজের জন্য বিশাল জায়গা নেই এবং যেখানে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ ব্যয়বহুল সেসব দেশে কৃষিখাতে রোবটিক যান কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com