শ্রীফলতলা গ্রামের জ্ঞানমেলা
- এম. এ. হক অনু - শ্রীফলতলা, রামপাল, বাগেরহাট থেকে ফিরে
আমাদের গ্রাম৷ তৃণমূল পর্যয়ে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে নিবেদিত একটি বেসরকারি সংস্থা৷ এ সংস্থারই একটি প্রকল্পের নাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প৷ এ প্রকরে আয়োজনে ২০০৪ সাল থেকে শ্রীফলতলা গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সাংবাত্সরিক জ্ঞানমেলা৷ শ্রীফলতলা হচ্ছে বাগরেহাট জেলার রামপাল থানার একটি গ্রাম৷ উল্লিখিত এ মেলার লক্ষ্য তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা৷ এবারের মেলাটি ছিল এধরনের তৃতীয় জ্ঞানমেলা৷ মেলা শুরু হয় ২০ ফেব্রুয়ারি এবং শেষ হয় ২১ ফেব্রুয়ারি৷
২০ ফেব্রুয়ারি সকালে শ্রীফলতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেখা যায় মাঠে কাদাপানি৷ এ মাঠেই জ্ঞানমেলা বসার কথা৷ মেলার আগের রাতে খানিক সময় শিলাবৃষ্টিসহ মুষলধারে বৃষ্টি হয়৷ সকালেও কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়৷ মাঠের চারপাশে বানানো হয়েছে স্টল৷ শামিয়ানা টানিয়ে প্যান্ডেল বানানো হয়েছে অথচ সব আয়োজনই যেনো ভেস্তে যেতে বসেছে৷ এতে মন খারাপ মেলা আয়োজকদের৷ ঢাকা থেকে আসা অতিথিদের মাঠের পাশেই আমাদের গ্রাম প্রকল্পের রামপাল অফিসে নিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ৷ সেখানে শুরু হয় মতবিনিময় সভা৷ সভায় মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনার মাধ্যমে ঢাকা থেকে আসা অতিথি ও সাংবাদিকদের প্রকল্প কার্যক্রম দেখানো হয়৷ সভায় সিদ্ধান্ত হয় বৃষ্টিতে প্যান্ডেল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে স্কুল মিলনায়তনে৷ মাঠে পৌঁছে দেখা গেল মেলায় অংশ নিতে আসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্টল সাজাচ্ছে৷ মাঠে সাধারণ দর্শনার্থীরাও আসতে শুরু করেছেন৷ এরই সাথে সকাল থেকে মাঠে উপস্থিত ছিলেন স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা৷ জ্ঞানমেলা শুরু হচ্ছে শুনে যেনো সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে৷
তৃতীয় জ্ঞানমেলা উদ্বোধন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী৷ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাইক্রোসফট বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার ফিরোজ মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাহমুদুল হক, রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমুর রহমান, এনজিও রূপান্তরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্বপন গুহ, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা রুকন উদ্দৌলা এবং বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্কের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফেরদৌসী আখতার৷ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আমাদের গ্রাম প্রকল্পের পরিচালক রেজা সেলিম৷
অনুষ্ঠানে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে৷ সাধারণ মানুষের পক্ষে এককভাবে কমপিউটার কেনা সম্ভব নয়৷ আমার মনে হয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম কমপিউটার ব্যবহার করে৷ তাই চিন্তা করতে হবে বিকল্প পন্থার৷ এজন্যই দরকার টেলিসেন্টারের মতো কেন্দ্র৷ যাতে গ্রামীণ সাধারণ মানুষ টেলিসেন্টারে এসে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারে৷ এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক তথা বিটিএন৷ বিটিএন ২০১১ সালের মধ্যে সারা দেশে ৪০ হাজার টেলিসেন্টার গড়ে তুলবে তাদের সদস্যদের সহায়তায়৷ তিনি আরো বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে এ ধরনের মেলার আয়োজন দেশের আর কোথাও হয়নি৷ গ্রামবাংলার মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে৷
ফিরোজ মাহমুদ বলেন, বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ৷ আমাদের দেশে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করে৷ তাই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের গ্রামীণ জনসম্পদের উন্নয়ন করতে হবে৷ এতেই অর্জিত হবে আমাদের লক্ষ৷
রেজা সেলিম বলেন, লোকজ গ্রামীণ মেলা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ৷ এ লোকজ মেলা নিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকে অনেক বেশি৷ এ কারণে আমাদের মনে হয়েছে, গ্রামে মেলা আয়োজনের মাধ্যমে আমরা সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছতে পারব৷ সে থেকেই এ মেলার আয়োজন৷ মূলত মানুষের জীবনযাপনে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া কতটুকু তা এ মেলার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়৷
এবারের জ্ঞানমেলা আয়োজনে সহযোগিতা করেছে মাইক্রোসফট বাংলাদেশ৷ এ বছরের জ্ঞানমেলা ২০০৮ পুরস্কার পান সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা রুকন উদ্দৌলা৷ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বাগেরহাট অঞ্চলের ঐতিহ্য পটগানের মাধ্যমে পরিবেশিত হয় সিডরসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চিত্র, অবকাঠামো পুনর্গঠন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা৷
এ বছরের মেলায় স্কুল, এনজিও, ম্যাগাজিন, প্রকাশনী, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানবিষয়ক ২৬টি স্টল ছিল৷ মাঠের এক পাশে ছিল মিঠাই-মুরুলি খাওয়ার আয়োজন, আলতা-চুড়ির দোকান, শীতকালীন পিঠা, নাগরদোলা এবং সব শ্রেণীর মানুষের জামা-কাপড়ের দোকান৷ অন্যদিকের স্টলে ছিল কমপিউটার, প্রিন্টার, ফ্যাক্স ও ফটোকপিয়ার মেশিন, ইন্টারনেট ব্যবস্থাসহ আরো কত কি৷ মেলায় অংশ নেয় রূপান্তর, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের মতো কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা৷ অন্যান্য আয়োজনের মধ্যে ছিল চিত্রাঙ্কন, ক্যারম, দাবা, গণিত, নাচ, গান ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা৷ এসব প্রতিযোগিতায় গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্ররা অংশ নেয়৷
মেলায় মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর একটি স্টল ছিল৷ জ্ঞানমেলায় কমপিউটার জগৎ প্রতি বছর একজন মেধাবী প্রতিযোগীকে এবং আমাদের গ্রাম প্রকল্পের একটি কেন্দ্রে সৌজন্য সংখ্যা পাঠানোর ব্যবস্থা করবে৷
২১ ফেব্রুয়ারি মেলা প্রাঙ্গণের পাশেই আমাদের গ্রাম পরিচালিত জ্ঞানকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় এক সেমিনার৷ সেমিনারের বিষয় ছিল- তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কীভাবে জ্ঞান ব্যবস্থাপনা করা যায়৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন এবং আমাদের গ্রাম সেমিনারের আয়োজন করে৷ সেদিন বিকেল চারটায় শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠান৷ এতে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন শ্রীফলতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান, কয়লারহাট কামাল উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাজহারুল হক ও আমাদের গ্রাম শ্রীফলতলা প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রিজাউল করিমসহ প্রমুখ৷ এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় তৃতীয় জ্ঞানমেলা৷