বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে গত ২৭-৩১ জানুয়ারি পাঁচদিনব্যাপী বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের স্বপ্ন, সাধ ও প্রত্যাশার এক অনন্য সম্ভাবনার দুয়ার সফটওয়্যার মেলা অনুষ্ঠিত হলো। এই সফটওয়্যার মেলার সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস তথা বেসিস। সহযোগিতায় ছিল গ্রামীণফোনের পাশাপাশি আরো কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। মেলার আয়োজন ছিল দৃষ্টিনন্দন। ২০০২ সালে শেরাটন হোটেলের লবি প্রাঙ্গণ থেকে এ সফটওয়্যার মেলার যাত্রা শুরু। কিছুটা ব্যতিক্রম ছাড়া ২০০২ থেকে প্রায় প্রতি বছরই এ মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। অনেক দেশী-বিদেশী সফটওয়্যার শিল্পের সমাগম ঘটেছে বিগত বছরগুলোতে। আয়োজকরা বিভিন্ন বছরে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন এই মেলাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে। সফলতা ও ব্যর্থতার পরিসরে এবারের সফটওয়্যার মেলাকে আমরা দেখার চেষ্টা করেছি পরিণত শিল্পের সার্বিক কাঠামোতে ও বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের অবস্থান বিচারে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস ও কমপিউটার জগৎ-এর যৌথ জরিপের ভিত্তিতে এবং সামগ্রিকভাবে সফটওয়্যার প্রকৌশলের মানদন্ডের পরিমাপে এ লেখায় সফটওয়্যার মেলার অর্জন পাঠকের কাছে তুলে ধরবার একটা প্রয়াস নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, জরিপ পরিচালনার কাজে উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে।
শুরুর কথা
সফটওয়্যার মেলা বেসিসের উদ্যোগে প্রতিবছর আয়োজিত হয়। এ মেলায় দেশী-বিদেশী সফটওয়্যার শিল্প সফটওয়্যার প্রদর্শন করে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিজেদের সার্বিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি সেবার বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করে। এই মনোজ্ঞ উপস্থাপন সফটওয়্যার বিপণনের পূর্বশর্ত। সফটওয়্যার প্রদর্শনের পাশাপাশি মেলায় বিভিন্ন সমসাময়িক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিবিষয়ক আলোচনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়। মনোজ্ঞ এ সফটওয়্যার মেলায় বেসিসের সদস্যদের পাশাপাশি বিদেশী সফটওয়্যার শিল্প প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়। এছাড়া অসদস্যরাও মেলায় অংশ নিতে পারে। এ মেলায় সফটওয়্যার শিল্পের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনাপ্রসূত প্রযুক্তিও প্রদর্শিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সৃষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি যাচাই-বাছাইয়ের পরে মেলা প্রাঙ্গণে প্রদর্শন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এ প্রক্রিয়ায় নিজেদেরকে কর্মসাফল্যে তুলে ধরার সুযোগ পায়।
সফটওয়্যার মেলা যেভাবে শুরু
সফটওয়্যার মেলা ২০০২ বেসিসের সফল উদ্যোগের ফসল। ২০০২ সালে শেরাটনের হোটেল প্রাঙ্গণে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছিল এ প্রাণের মেলা। উপচেপড়া ভিড়, হোটেল প্রাঙ্গণের প্রতিটি কোণে জনসমুদ্র, চোখেমুখে উত্তেজনা আর আকুলতায় নবীন প্রজন্ম খুঁজে ফিরছিল পছন্দের পসরা। সবার মনের গভীরে ২০০২-এর সফটওয়্যার মেলা এক আবেশ সৃষ্টি করেছিল। এই একই আবেশের পথ ধরে ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন প্রাঙ্গণে আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়েছিল সফটওয়্যার মেলা। আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে এই মেলার আয়োজনে ছিল টানটান উত্তেজনা। মেলায় আসা দর্শনার্থীদের ছিল রেজিস্ট্রেশন, মেলাকে আরো সফল করবার প্রয়াসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমন্বিত করার প্রয়াস ছিল চোখে পড়বার মতো। আনুমানিক ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার দর্শনার্থী এই মেলাকে উপভোগ করেছিল। মেলা থেকে বাংলাদেশ সফটওয়্যার শিল্পের উপলব্ধিতে নবীন প্রজন্ম আরো একধাপ এগিয়েছিল।
২০০৫, ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮-এ এই সফটওয়্যার মেলা একই দিকনির্দেশনায় আয়োজিত হয়। অথচ লক্ষণীয়ভাবে দর্শনার্থীদের সংখ্যা কমতে থাকে। হয়তোবা বেসিসের যথাযথ উদ্যোগের অভাব, সফটওয়্যার শিল্পের রুগ্নদশা বা কোনো এক কারণে এই ভাটার জন্ম। কেনো এই ভাটা এবং এক্ষেত্রে সফটওয়্যার সমিতি কী করতে পারে। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের বাসত্মবায়নে এই সফটওয়্যার মেলায় আসা সফটওয়্যার শিল্পগুলোর কী করা উচিত- এসব বিষয়েও কিছুটা আলোকপাত করবো।
২০০৯-এর সফটওয়্যার মেলা
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিজ্ঞান-তথ্যযোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রীর উপস্থিতি এই আয়োজনকে আকর্ষণীয় করে তোলে। হলভর্তি আসা অতিথিদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন আর সাদর সম্ভাষণের মধ্য দিয়ে এ মেলার উদ্বোধন হয়। সব মিলিয়ে মোট ৯২টি সফটওয়্যার ও তথ্যসেবার শিল্প প্রতিষ্ঠান এই মেলায় অংশ নেয়। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এবারের মেলাকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় আয়োজন বলা হয়।
মেলায় দেশী-বিদেশী সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তির সেবা শিল্পগুলোর মাঝে চোখে পড়বার মতো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। মেলায় ঢোকার মুখেই জিপ্লেক্স-এর মনোরম হলুদ-লাল রঙের বাহারি স্টলটি দেখার মতো। জিপ্লেক্স কলসেন্টার ব্যবসায়ে নিয়োজিত। কথা প্রসঙ্গে জিপ্লেক্স-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তার আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনাকে সামনে রেখে এ মেলায় আসা। মেলায় ঢোকেই ডান পাশে নজরে আসে গ্রামীণ-এর বেশ বড় একটা স্টল, নীরবে চলে কয়েকটি ল্যাপটপে গ্রামীণ ইন্টারনেট সবার জন্য প্রদর্শন। একটু সামনে এগিয়ে গেলেই একই পাশে Somewherein-এর আরিল্ড-এর বাংলা ব্লগ ও এসএমএস মেসেজের আকর্ষণীয় প্রদর্শনী। এ স্টলের মেয়েরা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছিল প্লাজমা ডিসপ্লের ওপর ব্লগ সেবার ধারাবিবরণী দিতে গিয়ে। হাতের বামে তাকালেই দেখা যায় বিডি জবস। স্টলটা বেশ বড়। একটা, দু’টা ল্যাপটপ আর ক্লান্ত যুবকের নির্লিপ্ততা নজরে আসে। ছোট-বড় স্টলগুলো কিছু পসরা, কিছু কাগজের সমাহার নিয়ে কেমন যেন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে, কাছে এগিয়ে গেলেও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি এই স্টলগুলোতে। ওরা যেন জানে না, কেনো এ মেলায় আসা। ওদেরকে যেনো বলা হয়নি না বলা অনেক কথা। ওদেরকে অনেক কষ্ট দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে স্টলের চৌহদ্দিতে। খুব কষ্ট লেগেছে ওদের কষ্ট দেখে।
প্রায় স্টলেই দেখা গেল নিজেদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার ব্যসত্মতা। কথা বলা বা মনোযোগ দেবার সময় ওদের নেই। না, সব স্টলই যে একই রকম তা বলা যাবে না। মেলায় একটা স্টল অনেকেরই নজর কেড়েছে। লাল সজ্জায় স্টলটাকে আলোকিত করে রেখেছে সুন্দরী রমণীরা। বেশ বড় স্টলটাতে ভিড় উপচে পড়েছে। কাস্টমার সার্ভিস নিয়ে রীতিমতো ব্যসত্ম সবাই। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেই একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো, না চাকরি করে না। মেলার আগেই ওদেরকে কোম্পানি নিয়োগ দিয়েছে শুধু মেলার উদ্দেশ্যকে বাসত্মবে রূপ দিতে। এই কোম্পানিটি বাংলাদেশে টালি নামের একটি অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার বিক্রি করে। এ যাবত তিন থেকে চার হাজারের বেশি সফটওয়্যার বিক্রি হয়েছে এবং আরো বেশি বিক্রির জন্য বিপণনের ভিত্তিকে মজবুত করছে। মেলা প্রাঙ্গণে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর সফটওয়্যারের দুর্বল বিপণনের মাঝে এমন সবল ও আগ্রাসী বিপণন প্রদর্শন চোখে পড়বার মতো।
মেলায় আসা দর্শনার্থীর সংখ্যা কম হলেও হয়তো বিষয়াশ্রয়ী দর্শনার্থীর সংখ্যা কম নয়। কিন্তু নীরব বিপণন তো মেলার উদ্দেশ্য হতে পারে না। এখানে দেশের নবীন প্রজন্মকে দেবার মতো তাহলে আর কি রইলো? মেলা প্রাঙ্গণে শুধু টালি দিয়ে তো আর বাড়ি হবে না। আমাদের ছোট-বড় প্রতিটি তথ্য ও সেবাপ্রযুক্তির প্রতিষ্ঠানকে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মেলায় আসা উচিত। মেলার অপর একটা আকর্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সৃজনশীল তথ্যপ্রযুক্তির পণ্য এবারের মেলায় দুই-একটা দেখা গেলেও বেশ কয়েকটা স্টলে গিয়ে পাওয়া গেল না ওদের কোনো নাম-নিশানা।
২০০৯-এর সফটওয়্যার মেলার জরিপ
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস-এর ছাত্রছাত্রীরা ‘কমপিউটার জগৎ’-এর সাথে একত্রে এই মেলার ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের অংশ হিসেবে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে মেলার প্রতিটি স্টলে গিয়ে কথা বলে এবং জরিপের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে। জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে নিচের চিত্রগুলো দেখানো হলো।১নং চিত্রে দেখা যায় সফটওয়্যার ডাটাবেজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে MySQL-এর ব্যবহার শতকরা ৩৮ ভাগ, যা উন্মুক্ত সফটওয়্যার হিসেবে আলোচিত। ওরাকলের শতকরা ২৯ ভাগের পরে আছে মাইক্রোসফটের MSSQL-এর ব্যবহার, যার পরিমাণ শতকরা ২২ ভাগ।
ব্যাক-এন্ড ইউজেস
ডেস্কটপের ডেভেলপমেন্ট কিট
ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের ডেভেলপমেন্ট কিট
ডেস্কটপ সফটওয়্যার তৈরির বিভিন্ন ভাষার ব্যবহারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডটনেট ও জাভা। ২নং চিত্রে দেখা যায় ব্যবহারকারীদের শতকরা ৩৯ ভাগ ডটনেট ব্যবহার করছে সফটওয়্যার তৈরির কাজে। এর পরপরই জাভা শতকরা ২৬ ভাগ ও ভিজ্যুয়াল বেসিক শতকরা ২০ ভাগ আমাদের সফটওয়্যার তৈরির কাজে ব্যবহার হয়।
ওয়েবভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরির বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার ৩নং চিত্রে দেখানো হলো। এখানে দেখা যায়, শতকরা ৩৮ ভাগ ব্যবহারকারী পিএইচপি এবং শতকরা ৩৩ ভাগ ডটনেট ব্যবহার করে ওয়েবভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরির কাজে।
ডেভেলপমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক
ওয়েবভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরির এখন রয়েছে অনেক ফ্রেমওয়ার্ক। ৪নং চিত্রে দেখানো হলো বিভিন্ন ফ্রেমওয়ার্কের ব্যবহার। দেখা যায় ওয়েবভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরির কাজে বিভিন্ন ফ্রেমওয়ার্কের ভেতরে অ্যাজ্যাক্স শতকরা ৩২ ভাগ এবং জুমলা শতকরা ৩১ ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে আমাদের।
মানবসম্পদ সক্ষমতা
মানবসম্পদ সফটওয়্যার শিল্পের প্রাণ। এ জরিপে মেলায় আসা বিভিন্ন কোম্পানির মানবসম্পদের সার্বিক চিত্র পরিস্ফুটিত হয়। ৫নং চিত্রে মানবসম্পদের বিস্তার দেখানো হলো। এখানে স্পষ্ট বোঝা যায়, প্রোগ্রামারের শতকরা ৩৪ ভাগ জনবল ছাড়া প্রশাসন (যা শতকরা ১০ ভাগ) এবং অন্যান্য মানবসম্পদের পরিমাপের সংখ্যা যথেষ্ট অপ্রতুল। আমাদের সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশ অনেক অংশে থেমে আছে। বিশেষ করে প্রজেক্ট ম্যানেজার (শতকরা ৮ ভাগ মাত্র)।
অভিজ্ঞ সিস্টেম অ্যানালিস্ট শতকরা ৭ ভাগ, অভিজ্ঞ অ্যানালিস্ট প্রোগ্রামার শতকরা ৯ ভাগ-এর ঘাটতি এই জরিপ থেকে লক্ষণীয়। একই সাথে প্রযুক্তি বিপণন বা বিপণনের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়। যেমন ব্র্যান্ড ম্যানেজার শতকরা ৪ ভাগ মাত্র এবং প্রযুক্তি বিপণনের জনবল শতকরা ৭ ভাগ, যা অত্যন্ত অপ্রতুল।
এই অপ্রতুল দক্ষ জনবলের পরিমাপ প্রতিদিনই কমছে আমেরিকা, জাপান, কানাডা বা ইউরোপের হাতছানিতে। অন্যদিকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি তথা কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল পড়ার আগ্রহ সেই অনুপাতে বাড়ছে না। যদিও পরিবর্তন আসছে। অপরদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখছি। এ স্বপ্নকে সার্থকতায় রূপ দিতে আমাদেরকে শিক্ষা ও শিল্পের সমন্বয় করে অধিক পরিমাণে দক্ষ জনবল আহরণের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে সুশিক্ষা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের হাল ধরার কাজে নিয়োজিত করতে হবে।
জরিপের সারমর্ম
জরিপের ফল এবং মেলা পরিদর্শনের ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্পের অগ্রগতিতে আউটসোর্সিংয়ের কাজ এনেছে বৈদেশিক মুদ্রা। অনেক নতুন উদ্যোক্তার জন্ম হয়েছে। প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ এই আউটসোর্সিংয়ের কাজ নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। কিন্তু আউটসোর্সিংয়ের কাজের অভিজ্ঞতায় সফটওয়্যার শিল্পের অন্য দিকগুলো সেভাবে বিকাশ লাভ করেনি। জরিপের ভিত্তিতে বলা যায়, ক্যাপাবিলিটি ম্যাচুরিটি মডেল বা সিএমএম মানদন্ডের ভিত্তিতে নিশ্চিত করার অবস্থানে বাংলাদেশে তৃতীয় ধাপে পৌঁছাবার মতো কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। মেলাতে সিএমএম সম্পর্কে ধারণার অভাব দুঃখজনকভাবে লক্ষণীয়। আউটসোর্সিং দরকার আছে, কিন্তু দেশের ব্যবসায় বাণিজ্যের উপযোগী সফটওয়্যার তৈরিতে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে সফল বিপণনের নজির নেই বললেই চলে।
সফটওয়্যার মেলার ভবিষ্যৎ ভাবনা
মেলা সবার জন্য। সফটওয়্যার মেলা তেমনই সবার মেলা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সদস্য ও অসদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ মেলাতে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের মেলায় আসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে মেলাকে আরো বাসত্মবভিত্তিক করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিবিষয়ক বিভাগের শিক্ষকদের এ সফটওয়্যার মেলার সাথে বেশি করে সম্পৃক্ত করা দরকার। এর ফলে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে এ শিল্পের নানা দিকনির্দেশনা সংযোজন সম্ভব হবে।
...............................................................................................
সাক্ষাৎকার
মেলার অভিজ্ঞতা আশাব্যজ্ঞক নয়
মো: রেজওয়ান আখতার
তৃতীয় বর্ষ, কমপিউটার ও প্রকৌশল বিভাগ, ই্উনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ঢাকা
মানুষকে প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত করার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এবারের সফটএক্সপো ছিল এক অনন্য আয়োজন। ছিল কর্মস্পৃহায় অদম্য প্রযুক্তিবিদদের এক মহাসম্মিলন। এই সম্মিলন ঘিরে থেকে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। এর সামান্যই বেসিস পূরণ করতে সক্ষম। যেখানে পৃথিবী এগুচ্ছে সুপারসনিক গতিতে, সেখানে আমাদের দেশের আইসিটি শিল্প এগুচ্ছে আইসিটি ইনকিউবেটর থেকে বেরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে। আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে সুনাম অর্জন করতে পারে, তাহলে এরা এদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ব্যবহার করে কেনো দেশীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রত্যয়ী হচ্ছে না, সেটা আমার বোধগম্য নয়। আর সেখানে যদি বাজারের প্রয়োজনীয়তার অভাব থেকেই থাকে, তাহলে বেসিসকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের বিপণন কার্যক্রমের প্রয়োজনে এ মেলার স্টলগুলোতে শুধু বিপণন বিভাগের কর্মীদের নিয়োগ করে থাকে, যাদের অনেকেই আবার কমপিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী ছিল না। এর ফলে তাদের পক্ষে সফটওয়্যার গঠনগত বিষয়গুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা ছিল কঠিন। এ ব্যাপারে আমাদের প্রোগ্রামারদের আরো উদ্যোগী হতে হবে।
তাই বলব, কমপিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এ মেলার অভিজ্ঞতা আমার জন্য বেশ আশাব্যঞ্জক নয়।
...............................................................................................
মেলায় জানলাম চাকরির অনেক সুযোগ আছে
মাহবুব হাসান
তৃতীয় বর্ষ, কমপিউটার ও প্রকৌশল বিভাগ, ই্উনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ঢাকা
কমপিউটার বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে সবসময় একটা কথা ভাবতাম, বাংলাদেশে আইটি ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ কেমন আছে বা আদৌ আছে কি না। এছাড়া আশপাশ থেকে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে বাংলাদেশে আইটি খাতে কোনো চাকরি নেই। কিন্তু সফটএক্সপোতে গিয়ে কয়েকটি আইটি কোম্পানির সাথে কথা বলার পর সে ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কারণ, প্রত্যেকটি কোম্পানির একই কথা, এরা তাদের প্রয়োজন মতো আইটির লোক পাচ্ছে না। এরা এমনকি প্রশিক্ষণ দিয়ে হলেও লোক নিয়োগ দিতে প্রস্ত্তত আছে। সফটএক্সপোতে গিয়ে কোম্পানিগুলোর সাথে কথা বলে আরো একটা ধারণা পেয়েছি। আসলে এরা একজন আইটি ছাত্রের কী কী ব্যাপার লক্ষ করেন, চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে এবং প্রায় সব কোম্পানির একই কথা- শুধু আইটির বেসিক জ্ঞানটা থাকলেই এরা তাদেরকে চাকরি দিতে প্রস্ত্তত। বাকিটা এরা প্রশিক্ষণ দিয়ে নেবেন। অবশ্য বেশ কিছু কোম্পানি প্রজেক্ট ওয়ার্কের ওপর জোর দিয়েছে।
বর্তমান সরকার আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে কী বুঝায় সেটা সম্পর্কে আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই অজ্ঞ। এমনকি যাদের ওপর নির্ভর করে ডিজিটাল বাংলাদেশ সেই আইটি কোম্পানিগুলোই জানে না ডিজিটাল বাংলাদেশ কী এবং কী করণীয়।
...............................................................................................
সব কথার শেষ কথা
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় তরুণ প্রজন্মের ভেতরে যথেষ্ট আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। সবাই উদযোগী হয়ে উঠেছে স্বপ্নের এই প্রত্যয়কে বাসত্মবে রূপ দিতে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিটি অনুষ্ঠানে তরুণ প্রজন্ম খুঁজে ফিরছে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বরূপ, বাসত্মবায়নের রূপরেখা, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং ভিত্তি স্থাপনের সফল মাপকাঠি ও এর সম্ভবনা। তাই এ লক্ষ্যে বেসিস, বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি এবং অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান সকল অনুষ্ঠানে ব্যবসা, শিক্ষা, গবেষণা ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রথমত এসব অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশ নেয়ার সুযোগ তৈরি করে সবার ভেতরে তথ্যপ্রযুক্তির বাংলাদেশকে সুষম উন্নয়নের ধারায় আবৃত করতে হবে। ক্যুইজ প্রতিযোগিতা, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, ভাবনা প্রতিযোগিতা এবং ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের মতো আয়োজন শিক্ষার্থীদের এ মেলা প্রাঙ্গণে এক বিশাল আনন্দ সঞ্চারণ করবে এবং মেলার বা অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্যন সহজ হবে। দ্বিতীয়ত, মেলায় আসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপণনবিষয়ক ধারণা এবং কর্মকান্ডকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। এর ফলে মেলায় আসা দর্শনার্থীদের সফটওয়্যার সম্পর্কিত ধারণা আরও স্পষ্ট হবে এবং ফলে প্রয়োজনীয় প্রভাব বিস্তার করবে।
আমরা প্রত্যাশার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এক বুক প্রত্যয় নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে একটা সুখী, সমৃদ্ধ তথ্যপ্রযুক্তির বাংলাদেশ গড়ার মূলমন্ত্রে দীক্ষা দিতে চাই।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : aktarhossain@yahoo.com