বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার দীর্ঘদিন ধরেই লাফ দিতে কিংবা উড়ে বেড়াতে পারে এমন ধরনের রোবট তৈরির গবেষণা করছেন। কাঠবিড়ালের লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ানো এবং মশা, মাছি ও ফড়িংয়ের উড়ে বেড়ানো দেখে তাদের এমন রোবট তৈরির চিমত্মাটা মাথায় আসে। শুধু যে খেলার ছলে তারা এ নিয়ে কাজ শুরু করেন তা নয়। একটি দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর ফল পাওয়াও ছিল তাদের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ওই প্রকৌশলীরা চেয়েছেন প্রকৃতিতে থাকা কীটপতঙ্গ বা প্রাণীর মতো লাফিয়ে বা উড়তে সক্ষম রোবট বানিয়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে। এলক্ষ্যেই তারা এ ধরনের দুটি রোবটের নকশা করেন এবং তৈরি করেন প্রাথমিক সংস্করণ। রোবট দুটির নাম দেয়া হয়েছে জলবোট এবং গ্লামপার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির ছাত্র রদরি আর্মার বলেছেন, তার তৈরি করা জলবোট এমন ধরনের রোবট যে কিনা ফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উড়তে এবং উঁচু বা নিচু যেকোনো এলাকা দিয়ে গড়িয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে মহাকাশ অনুসন্ধানে, বিশেষ করে কোনো গ্রহের ভূ-প্রকৃতিসহ অন্যান্য বিষয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজে এ রোবট পালন করবে অগ্রণী ভূমিকা। যেহেতু এটি যেকোনো ধরনের ভূ-পৃষ্ঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে পারে এবং চলার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা এলে লাফ দিতে পারে তাই মহাকাশ অনুসন্ধান ছাড়াও পৃথিবীতে ভূমি জরিপ কাজে এ রোবট ব্যবহার করা যেতে পারে।
মহাকাশে কোনো গ্রহ, উপগ্রহ বা অন্য কোথাও রোবট অভিযান করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেখানের এবড়োথেবড়ো বা উঁচু-নিচু ভূ-প্রকৃতি। পা-যুক্ত রোবট তৈরির বিষয়টি খুবই জটিল। তা ছাড়া এমন রোবট তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যয়বহুল এবং যদি পড়ে যায় তাহলে তাদের পক্ষে ফের উঠে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে সহজ সমাধান হলো রোবটের পায়ে চাকা লাগিয়ে দেয়া। কিন্তু এ পর্যায়ে সমস্যা হলো চাকাযুক্ত রোবটরা তাদের সামনে পড়া খুব কম প্রতিবন্ধকতাই এড়িয়ে বা টপকে যেতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করেছেন রদরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর বায়োমিমেটিক অ্যান্ড নেচারাল টেকনোলজিসে তার সহকর্মীরা। তারা প্রকৃতি থেকে আইডিয়া সংগ্রহ করেছেন। কীটপতঙ্গের চলাফেরা গভীরভাবে লক্ষ করে তারা এ সিদ্ধামেত্ম পৌঁছেছেন যে, রোবটকে হতে হবে এমন যে কিনা পতঙ্গের মতো উড়তে উড়তে কিংবা কখনোবা লাফিয়ে নিজের সামনের প্রতিবন্ধকতা এড়াতে সক্ষম হয়।
জলবোট দেখতে গোলাকার খাঁচার মতো। ফলে এটি গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে পারে, আলাদা করে কোনো চাকা বা পায়ের প্রয়োজন হয় না। এ কারণে তার পক্ষে চলার পথে পড়া যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। আর লাফ দেয়ার ক্ষমতা থাকায় কোনো কারণে যদি সে গড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা পেরুতে না পারে তাহলে লাফ দিয়ে তা অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। রোবটটি যথেষ্ট নমনীয় এবং আকারে ছোট। ওজন এক কিলোগ্রামেরও কম। তাই লাফ দিয়ে কোনো স্থানে অবতরণ করলেও তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। আরেকটা সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, মহাকাশ বা অন্য কোথাও অনুসন্ধানের কাজে এখন পর্যন্ত যেসব রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে তা সবই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু জলবোট তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যয় অনেক কম।
রদরি আর্মার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, অতীতে যেসব রোবট তৈরি করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কতগুলো লাফ দিতে এবং কতগুলো গড়িয়ে চলতে সক্ষম। কিন্তু আমরা যে রোবট তৈরি করেছি সেটি ওই দুটি কাজই করতে পারে। তিনি বলেন, প্রকৃতিতে দুই ধরনের লাফ দেয়ার ঘটনা লক্ষ করা যায়। একটি হচ্ছে ক্যাঙ্গারুর মতো লাফ এবং অপরটি ফড়িংয়ের মতো। দুটিরই লাফ দেয়ার প্রস্ত্ততি ও প্রক্রিয়া ভিন্ন। আমরা যে রোবটটি তৈরি করেছি সেটি ফড়িংয়ের মতো লাফ দেবে। ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলবে না। ফড়িংয়ের মতো উড়তে উড়তে প্রতিবন্ধকতা দেখে থামবে এবং লফিয়ে প্রতিবন্ধকতা পার হবে। লাফ দেয়ার আগে তার দেহের গোলাকার অবস্থা পরিবর্তিত হবে এবং একটু সময় নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে অন্তত আধা মিটার লাফিয়ে উঠতে পারবে। শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ বৈদ্যুতিক মোটর। দ্রুতগতির ক্যামেরা দিয়ে রোবটের লাফিয়ে ওঠা এবং কম মাধ্যাকর্ষণ পরিবেশে তার আচরণ কেমন হয়, বিশেষ করে মহাকাশে, তা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রোবটের পরবর্তী সংস্করণে এর দেহের চারদিকে সোলার সেল দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হবে। ফলে এটি নিজেই নিজের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। জলবোট এবং গ্লামপার নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বায়োইন্সপাইরেশন অ্যান্ড বায়োমিমেটিক জার্নালে। তিনি বলেন, জাম্পিং বা লাফাতে সক্ষম রোবট উঁচু-নিচু উপত্যকা, এমনকি সিঁড়ি বেয়েও উপরে উঠে যেতে পারবে। মহাকাশে প্রতি কিলোগ্রাম বস্ত্ত পাঠাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই ভারি যন্ত্রের চেয়ে কম ওজনের এবং দক্ষ রোবট যদি মহাকাশ অনুসন্ধানে ব্যবহার করা যায় তাহলে প্রকল্প বা মিশন ব্যয় অনেক কমে আসবে।
জলবোটের নামকরণ করা হয়েছে জাম্পিং এবং রোলিং মেশিন শব্দ দুটির সমন্বয়ে। এর কাঠামো গোলাকার এবং এর কেন্দ্রভাবে রয়েছে ব্যাটারি, নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি ও রেডিও রিসিভার। এর রয়েছে ক্যাচ ম্যাকানিজম, যা অতিরিক্ত শক্তি ছাড়াই রোবটকে লাফ দিতে সহায়তা করে।
গ্লামপারের নামটি এসেছে গ্লাইডার এবং জাম্পার শব্দ দুটি থেকে। জলবোটের চেয়ে এটির কার্যক্ষমতা অনেক বেশি। এর রয়েছে দীর্ঘ চারটি পা, প্রত্যেকটির হাঁটুতে রয়েছে স্প্রিং। এমন ব্যবস্থা সেখানে যুক্ত করা হয়েছে যাতে করে লাফ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা পেরুনোর পর রোবটটি কিছু সময় ভেসে থাকতে পারে। জলবোটের সঙ্গে তার আচার-আচরণের বেশ মিল রয়েছে। গ্লামপারের কন্ট্রোল বাক্স দুই ব্যাটারির শক্তিচালিত মোটরের হাতে রয়েছে। এর উচ্চতা দশমিক ৫ মিটার। ১ দশমিক ১৭ মিটার উঁচু প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে যাওয়া তার জন্য কোনো সমস্যাই নয়। পা ফেলতে পারে দুই মিটার দূরত্বে। গবেষকরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এ রোবটের গায়ে হালকা ওজনের সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব হবে। তখন আর ব্যাটারি থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে হবে না। সরাসরি সূর্যালোক থেকে তার শক্তি আসবে। এ পর্যায়ে তার কার্যক্ষমতা এবং কাজের ক্ষেত্রও অনেক বেড়ে যাবে।
এ দুটি রোবটই অনুসন্ধান কাজে দারুণভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এলোমেলো পথ, আগ্নেয়গিরির মতো বৈরী পরিবেশ, পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গলে কিংবা মহাকাশে বিরাজমান গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু বা উল্কায় অনুসন্ধান কাজে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে জলবোট ও গ্লামপার। ভবিষ্যতে হয়তো এমন আরো অত্যাধুনিক রোবট আমরা পাবো, যারা মানবসভ্যতায় পালন করবে অনবদ্য ভূমিকা।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : < /strong> sumonislam7@gmail.com