প্রথম অনাবাসী বাংলাদেশী সম্মেলনের তাগিদ দ্রুত উন্নত প্রযুক্তি আমাদের গ্রহণ করতে হবে কমপিউটার জগৎ প্রতিবেদক - একসাথে করবো আগামী দিনের বিশ্ব জয়- এ স্লোগান নিয়ে গত ২৭, ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার হোলে শেরাটনে আয়োজিত হয় প্রথম অনাবাসী বাংলাদেশী সম্মেলন ২০০৭৷ এনআরবি কনফারেন্স ঢাকা ২০০৭ শীর্ষক এ সম্মেলনে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃতী সন্তানকে একত্রিত করা হয়৷ তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এ সম্মেলনের প্রতিদিনই ছিল আনন্দমুখর৷ এনআরবি সম্মেলনে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আয়োজিত হয় দুটি সেমিনার৷
সেমিনারের মূল বিষয় ছিল সাবমেরিন ক্যাবলের যথার্থ ব্যবহার এবং বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে করণীয় এবং তারহীনযোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার ওপর স্পেকট্রাম প্রযুক্তিপ্রভাব৷ এ সেমিনার দুটিতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন কনে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রেনারশিপ প্রোগ্রামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সহপরিচালক ইকবাল জেড কাদির এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিভাগের স্পেস ও টেরেস্ট্রিয়াল কমিউনিকেশন ডিরেক্টরেট (এসটিসিডি)-এরপ্রোগ্রাম পরিচালক ও প্রধান বিজ্ঞানী ড. মাহবুব হক৷ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিটিআরসি-এর চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মঞ্জুরুল আলম৷ বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বোর্ডের সদস্য মো: আশরাফুল আলীম৷ সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী৷
সেমিনারের সঞ্চালক ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল৷ ইকবাল জেড কাদির বলেন, উন্নত প্রযুক্তি আমাদেরকে দ্রুত গ্রহণ করতে হবে এবং সারাদেশে সাবমেরিন ক্যাবলের সুবিধা পাওয়ার জন্য উপযুক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে৷ ড. মাহবুব হক বলেন, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিদেশে সবাই এর গুণগত মানটাকেই দেখে৷ একটা প্রতিষ্ঠানের সফলতার চাবিকাঠি এর পরিকল্পনা৷ অনাবাসীরা দেশের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ভূমিকা পালন করতে পারেন৷ প্রধান অতিথি তার বক্তৃতায় বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন৷ সাবমেরিন ক্যাবলের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে তিনি বলেন, এ দায়িত্ব বিটিটিবির৷ বিটিআরসি দুমাস আরো সরকারকে ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে৷ শিগগিরই এটি কমে আসবে৷ তিনি বলেন, টেলিসেন্টার বিষয়টির সাথে সাধারণ মানুষের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারটি জড়িত৷ মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বিটিআরসি বর্তমানে একটি সুবিধাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে৷ তবে এটি অবশ্যই কোনো মোবাইল ফোন অপারেটরের দুর্নীতি সহ্য করবে না৷ ফাইবার অপটিক ক্যাবল কাটা পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের তুলনায় ফাইবার অপটিক ক্যাবল কাটার পরিমাণ কমেছে৷ সাবমেরিন ক্যাবলের অব্যবহৃত শতকরা ৮০ ভাগ ব্যান্ডউইডথ শিগগিরই উন্মুক্ত করা হবে৷ বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে সংযুক্ত হবে কিনা, প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই এ কাজটি শুরু হবে৷ তিনি বলেন, গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে৷ কমিটি গঠন করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে৷ ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসট্যান্স (আইএলডি) পলিসি তৈরি করা হয়েছে৷ উন্মুক্ত অকশনের মাধ্যমে বিডিং করে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে লাইসেন্স দেয়া হবে৷ ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শিগগিরই করা হবে বলে তিনি জানান৷ তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি নিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনা আছে৷
চিত্র : সাবমেরিন ক্যাবল এবং বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
বিশেষ অতিথি মো: আশরাফুল বলেন, আমাদের আগেই উচিত ছিল একই সাথে দুটি সাবমেরিন ক্যাবল লাইন নেয়া৷ এ ব্যাপারে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে৷ মোবাইল ফোনের কলচার্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশের বর্তমান মোবাইল ফোন কলচার্জ অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম৷ এছাড়া দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি জানান৷
সভাপতি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ২০১১ সাল নগাদ বাংলাদেশে ৪০ হাজার টেলিসেন্টার স্থাপন করা হবে৷ পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচশর বেশি টেলিসেন্টার স্থাপন করা হয়েছে৷ বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক নামের একটি সংগঠন এ কাজটি করেছে৷ আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোক কমপিউটার থেকে তথ্য আহরণের যোগ্য হয়নি৷ আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কমপিউটারে বাংলা কনটেন্ট তৈরি করা৷ আর এগুলো লাইসেন্স করা সফটওয়্যার দিয়ে সম্ভব নয়৷ ওপেন সোর্স দিয়ে কিছু করতে হবে৷ মেশিন রিড্যাবল পাসপোর্ট (এমআরপি) সম্পর্কে কোনো এক দর্শক প্রশ্ন করলে তিনি জানান, এমআরপি হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার৷ আগে এটার একটা পরিকল্পনা ছিল৷ কিন্তু এখন এ প্রকল্পটি স্থগিত রয়েছে৷ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেমিনারটি শেষ হয়৷ সেমিনার শেষে বাংলাদেশের সফটওয়্যার আউটসোর্সিং বিষয়ে মাসিক কমপিউটার জগত্কে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে এমআইটির পেশাজীবী ইকবাল জেড কাদির বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের সফটওয়্যার আউট সোর্সিং বাড়ানোর জন্য প্রবাসীরা দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে বিদেশী ক্লায়েন্টদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে৷
বাংলাদেশে ই-গভর্নমেন্ট : সামনের পথ শীর্ষক অপর এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক আহমেদ ইমরান৷ এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান৷ বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রেক্টর আবু মো: মুনিরুজ্জামান খান৷ এ সেমিনারটির সঞ্চালক ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ৷
মূল বক্তব্যে আহমেদ ইমরান বলেন, বাংলাদেশে ই-গভর্নমেন্ট চালু করার জন্য আগে দেশের প্রধান সমস্যাগুলো দূর করতে হবে৷ আর এ সমস্যাগুলো হলো- আচরণ ও সুন্দর মানসিকতার অভাব, জ্ঞানের অভাব, পুরস্কার কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা, প্রতিশ্রুতি না রাখা ইত্যাদি৷
অনাবাসী সম্মেলন ২০০৭-এর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক সেমিনারগুলোর আলোচনা থেকে এ কথা সহজেই বলা যায় যে, উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং অনাবাসীদের সাথে দেশের তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের যথাযোগ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে আমাদের এ ক্ষেত্রটি খুব শিগগিরই আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবে৷