অধ্যাপক আবদুল কাদের৷ এক বিশাল ব্যক্তিত্বের নাম৷ তিনি এক অনন্য ইনস্টিটিউশন৷ এই হতদরিদ্র দেশে একজন আবদুল কাদেরের খুব প্রয়োজন ছিল৷ আমরা পেয়েছিলামও বটে, কিন্তু তাকে আমাদের হারাতে হয়েছে অনেকটা অকালেই৷ তার মৃত্যু হয়েছে ২০০৩ সালের ৩ জুলাই৷ মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তার মতো ক্ষণজন্মা এক মানুষকে আমাদের হারাতে হয়েছে, যা ছিল আমাদের কাছে নিতান্তই অপ্রত্যাশিত৷ একজন আবদুল কাদেরের জ্যোতি সারাদেশকে জ্যোতির্ময় করেছিল৷ তিনি কমপিউটারকে দেশের মানুষের কাছে কত সহজে উপস্থাপন করেছিলেন, তা লিখে শেষ করা যাবে না৷ কমপিউটার জগৎ নামে বহুল প্রচারিত মাসিক পত্রিকাটির মাধ্যমে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে দেশের শিক্ষিত মানুষের কাছে তিনি অসম্ভব গ্রহণযোগ্য করে তুলেন৷ কিভাবে সাধারণ মানুষের কাছে কমপিউটারপ্রযুক্তি অতি সহজে পৌঁছে দেয়া যায়, সাধারণ মানুষের কাছে কমপিউটার কিভাবে সহজলভ্য করা যায়- এ সংক্রান্ত অনেক বিষয়ই তার সারা জীবনের চিন্তা-চেতনায় স্থান পেয়েছিল৷ কিন্তু তিনি বেশি দিন এ পৃথিবীতে থাকতে পারেননি৷ এই পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারেনি৷
এই ক্ষণজন্মা পুরুষ আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে কমপিউটার নিয়ে নিমগ্ন রেখেছিলেন৷ দেশ কিভাবে সমৃদ্ধি পাবে, সে ভাবনা তাকে সব সময় তাড়িয়ে নিতো৷ ইনফরমেশন টেকনোলজির মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়েছিলেন এই ভেবে যে, বিশ্ববাসী জানুক বাংলাদেশের মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশের কথা৷ প্রচারবিমুখ এই মানুষটি আচার-আচরণে ছিলেন অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল ও প্রাণবন্ত৷ জ্ঞানদীপ্ত দুটি চোখ যেন সবসময় আশা ও সম্ভাবনার কথা বলতো৷
এই দূরদর্শী লোকটির অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে৷ আবাসন শিল্পে ফ্ল্যাটবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট সম্বন্ধে স্বাধীনতার পর পর তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন৷ অসামান্য দেশপ্রেমিক ছিলেন আবদুল কাদের৷ দেশকে খুব ভালোবাসতেন৷ কিভাবে দেশের উন্নতি হবে, শিল্পায়ন হবে, কিভাবে দেশের মানুষ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে\ চায়ের টেবিলের আড্ডায় এটাই ছিল তার আলোচনার বিষয়বস্তু৷ মূলত তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী৷ ছাত্র জীবনেই তিনি নিরলস পরিশ্রম করে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টতার জন্য তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে ধরে রেখেছিলেন৷ ক্লাসে তিনি খুব সাবলীল ভাষায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন৷ তাদের কাছে তার খুব সুখ্যাতি ছিল, ছিল গ্রহণযোগ্যতা৷ প্রফেসর আবদুল কাদের খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের প্রথম ব্যাচের পাস করা ছাত্র হিসেবে তিনি এ বিষয় কলেজে পড়িয়েছেন দীর্ঘদিন৷ মাটিকে খুব ভালোবাসতেন বলেই হয়তো এ বিষয়ে তিনি কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা করে সাফল্য অর্জন করেছিলেন৷
কমপিউটার তিনি খুব ভালোবাসতেন৷ মাসিক কমপিউটার জগৎ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ তারই প্রমাণ বহন করে চলছে৷ তিনি আশান্বিত ছিলেন, এ দেশের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ কমপিউটার জ্ঞানে জ্ঞানী হবে, দেশ সমৃদ্ধ হবে, অর্থনৈতিক উন্নতি হবে৷ একটি আধুনিক সুখী-সমৃদ্ধি দেশ হিসেবে বিশ্ব দুয়ারে প্রতিষ্ঠিত হবে৷
অধ্যাপক আবদুল কাদেরের ইন্তেকাল, কথাটি বলতে ইচ্ছে হয় না৷ নামের আগে মরহুম শব্দটি ব্যবহার করতে ইচ্ছে হচ্ছে না৷ সত্যিই তিনি যেনো বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে৷ তিনি মরেননি, মরতে পারেন না, এই ধরনের মানুষের মরণ হয় না, তারা অমর-অক্ষয়৷ যেখানে কমপিউটার, সেখানে আবদুল কাদের৷ যেখানে সততা ও আদর্শের কথা হয়, যেখানে নীতির ও নৈতিকতার কথা হয়, যেখানে সফলতার কথা হয়, যেখানে প্রবৃদ্ধির কথা হয়, যেখানে বিজ্ঞানের কথা হয়, সেখানেই আবদুল কাদের৷ অধ্যাপক আবদুল কাদের যেনো জীবন্ত ও প্রাণবন্ত কিছু৷
ছোট ছেলেমেয়েদের তিনি খুব ভালোবাসতেন৷ তিনি রীতিমতো তাদের পরম বন্ধু ছিলেন৷ নাতি-নাতনি, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্না-ভাগ্নীদের সাথে তার খুব সখ্যভাব ছিল৷ তুই করে ডাকতেন৷ যেনো বাল্যবন্ধু৷ দেশের ভবিষ্যৎ যোগ্য নেতাদের যেনো তিনি ছোটদের মধ্যে খুঁজে পেতেন৷ ছোটদের প্রতি তিনি ছিলেন সীমাহীন ধৈর্যশীল৷ তাদেরকে সম্ভাবনার কথা শোনাতেন৷ থেমে থেমে ইতিহাসের অনেক বর্ণিল বর্ণময় কথা শোনাতেন৷ পকেট থেকে চকলেট বের করে দিতেন, আবার কথায় কথায় জোঁক করতেন৷ পোশাক পরিচ্ছদে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল৷ রুচিসম্মত পোশাক পরিধান করার অভ্যাস তার ছোটবেলা থেকেই ছিল৷ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা তো অবশ্যই৷ ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধতা ছিল তার চক্ষুশূল৷ স্বল্পভাষী নির্ভীক এই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আবদুল কাদেরের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আমরণ৷ তার শিক্ষা আমাদের পথের পাথেয়৷
অধ্যাপক আবদুল কাদের৷ মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা৷ বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক ও প্রেরণাপুরুষ৷ এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান অসমান্তরাল৷ এক্ষেত্রে তার রেখে যাওয়া অবদান আগামী দিনেও জাতি স্মরণ করবে শ্রদ্ধাভরে৷ শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাত উন্নয়নেই তার ভূমিকা ছিল না, তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এদেশের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও৷ তার হাতে গড়া অনেকেই আজ তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকতায় সুপ্রতিষ্ঠিত৷ তাছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত মাসিক কমপিউটার জগৎ এদেশের প্রথম ও সর্বাধিক প্রচারিত তথ্যপ্রযুক্তি পত্রিকা৷ আগামী ৩১ ডিসেম্বর তার ৫৮তম জন্মবার্ষিকী৷ তার এই জন্মবার্ষিকীর দিনে তাকে স্মরণ করে এ লেখাটি লিখেছেন মিয়া মো: জুনায়েদ আমিন৷