এটি একটি ওয়্যারলেস যন্ত্র। আকৃতি ছোট, যাতে করে একে যুদ্ধক্ষেত্রে বা বিক্ষুব্ধ অঞ্চলে গ্রেনেডের মতো ছুড়ে দেয়া যায়।
চলমান বিশ্বে রোবট হতে যাচ্ছে মানুষের পরম বন্ধু এবং কারো কারো জন্য চরম শত্রু। এই রোবট গৃহস্থালির কাজে যেমন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি শত্রুপক্ষের কাছে দেখা দিচ্ছে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে। জীবনের সবক্ষেত্রে এদের আধিপত্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বা চরম বিক্ষুব্ধ আতঙ্কজাগানিয়া অঞ্চলে এদের ব্যবহার মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা দেয়ার পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং যথোপযুক্ত সিদ্ধামত্ম নিতে সহায়ক হচ্ছে। মার্কিন এবং ব্রিটিশ সেনারা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে রোবটপ্রযুক্তি। ব্রিটিশ সেনারা সম্প্রতি এক ধরনের ক্যামেরা উদ্ভাবন করেছে, যেটিকে বলা হচ্ছে গ্রেনেড ক্যামেরা। আনুষ্ঠানিক নাম আই-বল। এটি একটি ওয়্যারলেস যন্ত্র। আকৃতি ছোট, যাতে করে একে যুদ্ধক্ষেত্রে বা বিক্ষুব্ধ অঞ্চলে গ্রেনেডের মতো ছুড়ে দেয়া যায়।
এই আই-বলে রয়েছে এমন ধরনের ক্যামেরা লেন্স যা ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ছবি দিতে পারে। যখন এটি কোথাও ছুড়ে দেয়া হবে, তখন তাৎক্ষণিকভাবেই সে স্থানের ছবি তুলে ওয়্যারলেস প্রক্রিয়ায় ঘাঁটিতে পাঠাতে পারবে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেনারা কোনো যুদ্ধাঞ্চলে অতর্কিত হামলা থেকে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। এই আই-বল হাতে বা গ্রেনেড লঞ্চারের মাধ্যমে নিক্ষেপ করা যাবে। এর মাধ্যমে শত্রুপক্ষের ঘাঁটির কোথায় কি আছে না আছে তা সহজেই জেনে নিতে পারবে সেনারা। ফলে অভিযানের সময় কোনো বিপদে পড়ার সম্ভাবনা তাদের জন্য বহুলাংশে কমবে।
আই-বলে আরো রয়েছে অনেকগুলো ইমেজ সেন্সর এবং দুইটি ফিশ আই (মাছের চোখ) লেন্স। এদের সংগৃহীত ডাটা ফিল্ড প্রোগ্রামেবল গেট অ্যারি নামে পরিচিত এক ধরনের প্রসেসরের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ করা হবে। পরে পাওয়া যাবে ঘটনাস্থলের প্রকৃত ৩৬০ ডিগ্রি ইমেজ। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক প্রতিযোগিতা থেকে এ গ্রেনেড ক্যামেরার ধারণাটি পাওয়া যায়। পরে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু হয় এবং এ পর্যায়ে এসে সাফল্য দেখা দেয়।
স্কটল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ড্রিমপ্যাক আই-বলের উন্নয়নের কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পল থম্পসন বলেছেন, আই-বলকে একটি পরিপূর্ণ যন্ত্রে পরিণত করার অবস্থা এখনো আসেনি। এটি আসলে রয়েছে প্রাথমিক অবস্থায়। আমরা আই-বল প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি। যুদ্ধক্ষেত্রে বা কোনো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিস্থিতি বুঝতে সেনাদের জন্য আশীর্বাদ হবে এই আই-বল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তি উন্নয়নবিষয়ক পরিচালক প্রফেসর অ্যান্ড্রু বাইরড নিজেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আই-বলের পেছনে যে প্রযুক্তি কাজ করছে, তা সত্যি চাঞ্চল্যকর এবং বর্তমান সময়ের একটা বড় ধরনের অগ্রগতি।
বহনযোগ্য, ওয়্যারলেস প্রযুক্তিসম্পন্ন এবং নিক্ষেপণযোগ্য এই আই-বল ক্যামেরা মাইনাস ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর পর্যমত্ম তাপমাত্রায় কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম। এটি ট্যাঙ্ক বা মাইক্রো আনম্যানড এয়ার ভেহিক্যাল (ইউএভি)-এ ব্যবহার করা যাবে।
ব্রিটিশরা এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বেশ আগেই অর্থাৎ ২০০৫ সালে ইসরাইলের একটি কোম্পানি গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে নিক্ষেপ করা যায় এমন ক্যামেরা তৈরি করেছে। সেই ক্যামেরার প্রযুক্তি অবশ্য ভিন্ন। তারা একে বলছে ‘এ ট্যাকটিক্যাল মিনিয়েচার ইন্টেলিজেন্স গ্যাদারিং মিউনিশন’। এটি ক্ষুদ্র ক্যামেরা বিশেষ। যুদ্ধক্ষেত্রে এটি নিক্ষেপ করা হলে সেখানের চারদিকের ছবি তুলে সেনাদের কাছে থাকা পকেট পিসিতে পাঠাতে পারে এই ক্যামেরা। এর নাম দেয়া হয়েছে ফায়ারফ্লাই। এটি দুইটি সিসিডিভিত্তিক ক্যামেরা সংবলিত। সেনারা তাদের পকেট পিসিতে উঠে আসা ছবি দেখে সেখানের পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এই ছবি কারো সাথে শেয়ার করা যায় এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্লেষণের জন্য স্টোর করেও রাখা যায়। ফায়ারফ্লাই-এর ব্যাস ৩ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার এবং লম্বা ১৫ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। এটি ৬০০ মিটার দূর পর্যমত্ম নিক্ষেপ করা যায় এবং বাতাসে ভাসতে পারে সর্বোচ্চ ৮ সেকেন্ড পর্যমত্ম। এটি তৈরি করেছে রাফায়েল আর্মামেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি।
ব্রিটিশ সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ আগে থেকেই রোবটপ্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যে দুর্ঘটনাও ঘটছে অপেক্ষাকৃত কম। ইরাক এবং আফগানিসত্মানে সেনারা কাজ করছে ভয়ংকর পরিবেশে। প্রতিনিয়ত তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)-এর মতো মারণাস্ত্রকে।
মন্ত্রণালয়ের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি স্ট্র্যাটেজির মহাপরিচালক প্রফেসর ফিল সাটন বলেছেন, সর্বাধুনিক কমপিউটারভিত্তিক প্রযুক্তিপণ্য তাদের কাছে থাকলে তাদের জীবনের ঝুঁকি যেমন কমবে তেমনি তাদের কাজের মানও বাড়বে।
ইতোমধ্যেই যেসব প্রযুক্তিপণ্য হাতে আসতে যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে ইন্টেলিজেন্ট আর্মড ভেহিক্যাল। এটিতে ব্যবহার করা হয়েছে জিপিএস, লেসার এবং উত্তাপ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি। এই ভেহিক্যালকে বলা হচ্ছে মুল (মাল্টিফাংশনাল ইউটিলিটি/লজিস্টিক অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট)। হামভি যানের আকৃতিসম্পন্ন একটি সশস্ত্র রোবট এটি। জিপিএস ব্যবহার করে এই যান স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নিজের চলার পথ নির্ধারণ করতে পারে। ভবন, গাছপালা এবং খানাখন্দক এড়িয়ে চলার উপায়ও তার জানা। ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গোলা আকাশে থাকতেই ধ্বংস করতে সক্ষম এই রোবট। যানের ওপওে রয়েছে মেশিনগান। প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে ছুটে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। পুরো যানটিই একটি রোবট। এর রয়েছে ছয় চাকা। অন্য গাড়ি এবং প্রতিবন্ধকতার ওপর দিয়ে উঠে যেতে পারে এই মুল। শত্রুপক্ষের কব্জায় পড়া কোনো এলাকা উদ্ধার করতে এই রোবটের লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। আর কয়েক বছরের মধ্যেই লকহিড মার্টিন কোম্পানি যুদ্ধক্ষেত্রসমূহে মুল পাঠানো শুরু করতে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১ হাজার ৭০০ মুল চেয়েছে। ফিফটিন ওয়ারফাইটার ব্রিগেডকে এই রোবট দিয়ে সমৃদ্ধ করা হবে। মাইনফিল্ড পরিষ্কার এবং সমরাস্ত্র বহনের জন্যও ব্যবহার হবে এই যান। পুরো প্রযুক্তিটি কমপিউটারভিত্তিক।