সিউলের কুকমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সাং গুল হাং সিউল শহরের কোডা প্রশিক্ষণ একাডেমীতে গত ১৬ এপ্রিল ২০০৯ সকালে তার ল্যাপটপের পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিয়ে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে আগত মাত্র ৯ জন ছাত্রছাত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন; কেমন করে তেপ্পান্ন সালে মাত্র সাতষট্টি ডলারের বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের দেশটি ২০০৭ সালে ২০,৮৫০ ডলার বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। আমরা যারা তার ছাত্রছাত্রী তাদের জন্য এটি চরম বিস্ময়ের বিষয়। আমাদের দেশটিও ’৫৭ বা ’৬৩ সালের কোরিয়ার সমপর্যায়েরই ছিলো বরং কারও কারও অবস্থা কোরিয়ার চাইতে অনেক ভালো ছিলো। কিন্তু আমরা কোরিয়ার পঞ্চাশ ভাগের একভাগ অগ্রগতিও সাধন করতে পারিনি। ’৬১-৬২ সালে কোরিয়ার মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিলো ৮১/৮২ ডলার। বাংলাদেশের অবস্থা তখন এর চাইতে অনেক ভালো ছিলো। ১৯৪৫ সালে স্বাধীন হওয়া কোরিয়া তখন পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ ছিলো। সম্পূর্ণভাবে কৃষিনির্ভর এই দেশের মানুষের জীবনযাপনের অবস্থা পশুর চাইতেও অধম ছিলো। সেই সময়ে কোরিয়া আমাদের মতোই ইউএসএইড-এর ওপর ভিত্তি করে চলছিলো। বাজেটের শতকরা ৭০ শতাংশ এককভাবে যোগান দিতো মার্কিন এই সংস্থাটি। কার্যত তাদের বাজেট হতো ইউএসএইড থেকে কি পাওয়া যাবে তার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৫৭ সালে ইউএসএইড-এর পক্ষ থেকে বলা হলো, কোরিয়া হলো একটি তলাহীন ঝুড়ি। এর পেছনে কোনো সহায়তা দিয়ে কোনো অর্জন সম্ভব নয়। পরের বছর ইউএসএইড তার সহায়তার এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেয়। এর ফলে কোরিয়া প্রায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থায় পড়ে যায়। তখন থেকেই কোরিয়ারা ভাবতে থাকে যে অন্যের সহায়তায় উঠে দাঁড়ানো যাবে না। এখন ধন্যবাদ দিতে হয় ইউএসএইডকে যে তারা তাদের সহায়তার হাত বন্ধ করে দিয়েছিলো।
এরপরও কোরিয়ার সঙ্কট যায়নি। সামরিক শাসন এবং নানা ধরনের সঙ্কট কোরিয়াকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখে। সামরিক শাসন, অস্থির রাজনীতি, কৃষিনির্ভর সমাজের চাপ ইত্যাদি নানাবিধ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে কোরিয়া। কিন্তু তারপরও কোরিয়ার অগ্রগতির গ্রাফটি দেখে অাঁতকে ওঠার মতো। আলাদীনের চেরাগের মতো মনে হয় এই দেশটির উত্থান। প্রফেসর সাং গুল হাং নিজেই প্রশ্ন করছিলেন-এটি কি মিরাকল, জাদু? আবার নিজেই জবাব দিলেন, না এটি মিরাকল নয়, আমি এবং আমরা কোরীয়রা মিরাকলে বিশ্বাস করি না, নিজের শক্তিতে বিশ্বাস করি। এটি কোরীয় জনগণের অর্জন। পরে জেনেছিলাম, কোরিয়া হচ্ছে এশিয়ার এমন একটি দেশ যাতে ধর্মান্ধ লোক সবচেয়ে কম। আমাদের বন্ধু জেক জানালেন, কোরিয়ার শতকরা প্রায় ২৫ জন মানুষ ধর্ম নিয়ে মাথাই ঘামায় না।
সাম্প্রতিককালে যারা সিউলের ৫৫ কিলোমিটার দূরের ইনচিওন বিমানবন্দর হয়ে সিউলে প্রবেশ করেছেন বা শহরে দু-একটি চক্কর ঘুরেছেন কিংবা যারা কোরিয়ার উত্থানের কাহিনী পাঠ করেছেন তারা এসবে বিস্মিত হন না। আমার সহযাত্রী বীরেন থাইল্যান্ড দেখেছে। বিশাল দালানকোঠা তার কাছে নতুন নয়। তবুও কোরিয়ার বিশাল দালানগুলো তাকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছে। যদিও একই সাথে জাপান, তাইওয়ান, চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কথা আমরা স্মরণ করি, তথাপি বাংলাদেশের মানুষের সাথে কেমন করে জানি কোরীয়দের একটি বড় ধরনের মিল আছে বলে মনে হয়।
মিলটা এমন, কোরীয়রা এখন থেকে মাত্র ষাট বছর আগে আমাদের চেয়ে দরিদ্র ও একইরকম কৃষিপ্রধান দেশ ছিলো। ওরা ষাট বছরে সেটি অতিক্রম করেছে, আমরা তা করতে পারিনি। কোরীয়রা দারুণভাবে তাদের নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। এক ভাষার দেশ, নিজের ভাষা ছাড়া দুনিয়াতে আর কিছু বোঝে না। আমরাও এমনটাই আমাদের ভাষাকে ভালো বাসতাম-তবে এখন কি তা বাসি, সেটি নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন করা যাবে? কারণ সেই ভাষার প্রতি আমাদের একাগ্রতা নেই। কোরীয়রা উপনিবেশের অধীনে ছিলো এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আমরাও দু-দুবার উপনিবেশ ছিলাম। আমাদেরকেও রক্তাক্ত যুদ্ধের স্মৃতি বহন করতে হচ্ছে। একসময় কোরীয়দেরকে আমেরিকানরা তলাহীন ঝুড়ি বলেছিলো ও ইউএসএইডের সহায়তা এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে এনেছিলো। আমরা কিসিঞ্জারের মুখে আমাদের সম্পর্কেও একই কথা শুনেছি। আমরাও ইউএসএইড-এর সাহায্যনির্ভর ছিলাম। কোরীয়রা দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের অধীনে ছিলো। তবে অর্থনৈতিক অগ্রগতির শীর্ষ চূড়াটা তারা গণতন্ত্রে থেকেই অর্জন করেছে। আমরাও সুদীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের অধীনে ছিলাম। অনেক লড়াই করে গণতন্ত্রে পৌঁছেছি।
প্রফেসর সাং গুল হাং কোরিয়ার জাপানী উপনিবেশের অধীনস্থ থাকা, জাপানী দখলদারিত্ব-নির্যাতন ও শোষণ, কোরীয় যুদ্ধ, সামরিক শাসন, কৃষি নির্ভরতা ও চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধার কথা বলছিলেন। ষাটের কোঠায় বয়স নিয়ে দিনব্যাপী শ্রেণীতে আবদ্ধ থাকা কঠিন হলেও প্রফেসরের কথাবার্তা মোটেই খারাপ লাগছিলো না।
আমার জন্য কোরিয়া যাবার বিষয়টি একেবারেই আকস্মিক। হঠাৎ করে একদিন বিসিএস-এর কোষাধ্যক্ষ শাহিদুল মুনির জানালো যে কোরীয়রা চাচ্ছে তাদের দশ দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে আমাকে যোগ দিতে। আমি কোরিয়ার আইসিটি সম্পর্কে জানতাম। তারা যে ডিজিটাল কোরিয়ার রূপান্তরে বিশ্বের সেরা পর্যায়ে আছে সেটিও জানতাম। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে তূলনা করার সুবিধার জন্য আমি কোরীয়দের প্রস্তাব গ্রহণ করি।
১৩ এপ্রিল ২০০৯ রাতে সিঙ্গাপুর হয়ে ১৪ এপ্রিল ২০০৯ বিকেলে প্রায় দশ ঘণ্টার বিমাণভ্রমণের পর আমরা কোরিয়া পৌঁছাই। বাংলাদেশ থেকে আমি, বিসিএস-এর সিওও বীরেন অধিকারী ও বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের শাহাদাৎ হোসেন মিলে আমরা তিনজনের দল। প্রশিক্ষণের বৃহত্তম দল আমরা। অন্য দেশগুলো থেকে একজনের বেশি অংশগ্রহণকারী নেই। সিউলে পৌঁছে শাহাদাৎ হোসেন খুব সহজে পার হলেও আমি ও বীরেন ইমিগ্রেশনের ঝামেলায় পড়ি। আমার নামটি মুসলমানের বলে এমন ঝামেলা এখন সারা দুনিয়াতেই পোহাতে হয়। নামটি মোস্তদাফা বলে বিপদটা আরও একটি বেশি। কিন্তু বীরেনকে নিয়ে কেন সমস্যা হলো সেটি বুঝতে পারলাম না। কয়েক মিনিটে বীরেন পার হলো। ওরা জানালো তাদের ভুল হয়েছে। বাংলাদেশ বিষয়ে সাধারণ সতর্কতার জন্যই বীরেনের পাসপোর্ট চেক করা হয়েছে। আমাকে বসিয়ে রাখা হলো অনেক ক্ষণ। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নানা জায়গায় ফোন করে, কমপিউটারে নানা খোঁজাখুঁজি করে আমাকে ছাড় দেয়া হলো। সম্ভবত কোডার বড় কোন কর্মকর্তাকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে তারা আমাকে ছাড়পত্র প্রদান করে। সিউলের লেক্সিংটন হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটি আমরা আগেই জানতাম। জানতাম না যে এটি হান নদীর পারে। সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল চারটায়) রাতের খাবার খেয়ে শীতার্ত সিউলে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে আমরা রাতের ঘুম সেরে নিই। পনেরো তারিখ সকালটা ফ্রি-নাস্তা, দুপুরের খাবার এসব করেই অলস সময় কাটাতে হয়। বিকেলে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। কথা ছিলো, আমাকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে হবে। এর সাথে অরেঞ্জ জুসের টোস্টও আমাকেই অফার করতে হয়। ছোট বক্তৃতার পর কোরিয়ানরা অবাক হয়ে জানতে চায়, আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াশোনা করেছি। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তাদেরকে জানাই যে, সাঁইত্রিশ বছরজুড়ে পেশাদারি কাজের জন্য ইংরেজি শিখতে বাধ্য হয়েছি এবং আমি ইংরেজি পছন্দ করি না। বিপদে না পড়লে ইংরেজি বলি না। কোরীয় ভাষা জানলে তাতেই বক্তৃতা দিতাম। সেই উদ্বোধনী সভায় আমার কিছুটা উপকার হয়। ওখানে কোডার পরিচালকের সাথে কথা বলে আমি জানতে পারি যে কোরীয়রা বাস্তবেই আইসিটিকে এতো বেশি গুরুত্ব দেয় যা আর কেউ দেয় কিনা সন্দেহ আছে। তারা বাংলাদেশের মতো দেশকে সহায়তা করতে চায় বলেও জানায়। দুনিয়াজুড়ে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তারা ব্যাপক কাজ করার কর্মসূচি নিয়েছে বলেও জানায়। বাংলাদেশে বিসিসি, বেনবেইজ এসব জায়গায় তাদের প্রকল্প আছে এবং আরও নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে বলে ওরা জানায়। তবে তার মতে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তেমন ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যোগ দেবার আগেই কোরিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জেনে গিয়েছিলাম। কোরিয়ার সাথে বাংলার একটি সম্পর্কের কথাও জানতাম। অনেকেই হয়তো অবাক হবেন এটি জেনে যে, কোরিয়া ভাষার লিপি হানগুল এবং বাংলা লিপি একই উত্তরাধিকার বহন করে। উভয়ের পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মীলিপি। মাত্র ২৪টি অক্ষর দিয়ে একটি ভাষাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে নিতে পারার কৃতিত্ব কোরীয়দের রয়েছে। প্রফেসর সানগুল জানালেন তারা চীনা ও জাপানী বর্ণমালার দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে এখন গর্বিত জাতি। মাত্র ১৪৪৩ সালে কোরীয়রা নিজেদের লিপি ব্যবহার করতে শুরু করে। এর আগে প্রথমে চীনা ও পরে জপানী লিপি তারা ব্যবহার করতো। তারা তাদের শতকরা প্রায় একশ’ ভাগ কাজ কেবল যে কোরীয় ভাষায় করে তাই নয় বরং ইন্টারনেট ও অন্যান্য ডিজিটাল যন্ত্রে কোরীয় ভাষায় ব্যবহার করে তারা গর্ববোধ করে। যে মানুষগুলোকে আমরা আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজি বলতে দেখলাম, তার মোবাইলের ভাষা, ই-মেইলের ভাষা, ইন্টারনেটের ওয়েবপেজের ভাষা, কমপিউটারের ভাষা একমাত্র কোরীয় দেখে অভিভূত হতে হয়। ভাষার প্রতি এমন দরদ এই ডিজিটাল যুগে আর কোথাও আমার চোখে পড়েনি। এমনকি জার্মানি, ফ্রান্স, চীন, জাপানের চাইতেও এদের দরদ অনেক বেশি বলে আমার মনে হলো।
আমরা জানতাম প্রফেসর এবং তার সহকর্মীরা দশ দিনের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের সহায়তায় একদিকে কোরিয়ার সাফল্য তুলে ধরবেন, অন্যদিকে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বিদ্যমান তথ্যপ্রযুক্তির দুর্দশার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও জানবেন। প্রফেসরের আলাপ থেকে খুব সহজেই বোঝা যায় যে, তিনি নিজেদেরকে একটি গর্বিত জাতি বলেই মনে করেন। ডিজিটাল যুগে কোরিয়ার অগ্রগতি যে কারও জন্য ঈর্ষণীয় সেটি মুহূর্তের জন্যও তিনি ভুলতে পারেন না। বরং শিল্প ও অন্যান্য খাতে কোরিয়ার অগ্রগতিকে তিনি যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেন এবং কেবলমাত্র তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশটিকে অসাধারণ ও অনন্য বলে মনে করেন।
বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, মেক্সিকো ও মঙ্গোলিয়ার এই ছাত্র-ছাত্রীরা যথেষ্ট বয়সী। ইথিওপিয়া ও থাইল্যান্ডের দুজন ছাত্রী-অন্যরা পুরুষ। মেক্সিকোর ভদ্রলোক একটি বেসরকারি সংস্থার-কাস্টমসের লোক। বাংলাদেশের তিনজনের দুজন বেসরকারি ও একজন সরকারি লোক। কোরিয়ার কোডা নামের একটি সরকারি সংস্থা বছরে গোটাবিশেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। যে কোর্সটির কথা আমি বলছি সেটির নাম জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তিকরণ প্রশিক্ষণ কোর্স।
আর কোনো দেশ ইনফরমাইটেশন বা তথ্যপ্রযুক্তিকরণ অথবা তথ্যপ্রযুক্তিয়ায়ন ধরনের কোনো শব্দ ব্যবহার করে বলে আশি জানি না। কিন্তু কোরীয়রা তাদের মতো করে এই শব্দটিকে অনেক গুরুত্ব দেয়। ১৯৯৬ সাল থেকে কোরিয়া আইসিটিকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। স্মরণ করুন, তখন আমাদের দেশের শেখ হাসিনার সরকারও বাংলাদেশে আইসিটি খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং তার মেয়াদকালেই একে থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কোরীয়রা তথ্যপ্রযুক্তিকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে প্রথম ব্যবহার করে ১৯৯৯ সালে। ২০০২ সাল পর্যন্ত তারা সাইবার কোরিয়া নামের এই স্লোগানটি দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির কাজ করে। আমাদের দেশের প্রফেসর সোবহান তখন নিজে নিজে আইসিটি নীতিমাল তৈরি করতে থাকেন। আমাদের দেশে যখন বেগম খালেদা জিয়ার সরকার, তখন ২০০২ সালে কোরিয়া ই-কোরিয়া (ডিজিটাল কোরিয়া) স্লোগান গ্রহণ করে এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত পুরো দেশটির ব্যাপক ডিজিটাইজেশন করে। বস্ত্তত বাংলাদেশের পেছনে পড়ার সময় সেটি। বাংলাদেশে তখন বেগম খালেদা জিয়ার সরকার আইসিটির সব কাজ বন্ধ করে দেয় এবং আমাদের পায়ের পাতাটি উল্টোদিকে ঘুরতে থাকে। ২০০৭ সালে কোরিয়া ইউ-কোরিয়া স্লোগান গ্রহণ করে। আমরা বেসরকারিভাবে তখন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে থাকি। সৌভাগ্য আমাদের যে ২০০৮ সালে নির্বাচিত ও ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণকারী শেখ হাসিনার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ শ্লোগানটি গ্রহণ করেছে। খুব সঙ্গত কারণেই তথ্যপ্রযুক্তিতে হলেও আমরা কোরিয়ার মতো সামনে এগিয়ে যেতে পারবো বলে আশাবাদ জন্ম নিয়েছে।
প্রশিক্ষণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে যেসব বিষয়ে শেখানো হয় সেই সম্পর্কে ডাটার অভাব দেখা যায়নি। কোরীয়দেরকে একটি বিষয়ে খুবই সচেতন মনে হলো যে, তারা ডাটা বা উপাত্ত ছাড়া কোনো কথা বলতে চায়নি। সেই উপাত্তগুলোর মাঝে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাকে প্রথমেই আকৃষ্ট করে। সেই তথ্যটি হলো ষাঠের দশকে কোরীয়ার শিল্পের অবস্থা এবং ২০০২ সালে কোরিয়ার শিল্পের অবস্থার তুলনামূলক একটি চিত্র। ষাটের দশকে কোরিয়ার জনগণের জন্য শতকরা ৬৩ ভাগ কর্মসংস্থান করতো কৃষি ও মৎস্য খাত। তখন এই খাতের পক্ষ থেকে জাতীয় আয়ে অবদান ছিলো শতকরা ৩৬.৮ ভাগ। আমরা জাতীয় আয়ের শতকরা ২২ ভাগ পাই কৃষি থেকে। ২০০৫ সালে শতকরা ৪৮.১ ভাগ শ্রমজীবী কৃষি খাতে কর্মরত ছিলো। কোরিয়া ২০০২ সালে জাতীয় আয়ের মাত্র ৪.৩ ভাগ পেয়েছে কৃষি খাত থেকে। আমাদের যেসব নীতিনির্ধারক সমাজ বা রাষ্ট্রের ডিজিটাল রূপান্তর কি সেটি বুঝতে পারেন না, কোরিয়ার আরেকটি তথ্য তা তাদেরকে বুঝিয়ে দেবে। ১৯৬০ সালে কোরিয়ার জাতীয় আয়ের ৩৮.৮ ভাগ আসতো কৃষি থেকে। তখন শিল্প থেকে আয় হতো শতকরা ১৫.৯ ভাগ। সেবা খাতে তখন জাতীয় আয়ের শতকরা ৪৭.৩ ভাগ আসতো। ২০০২ সালে সেই অবস্থাটি এতটাই বদলে যায় যে সেবা খাত থেকে আয় হতে থাকে ৪৭.৩ ভাগের বদলে শতকরা ৬৩.২ ভাগ। শিল্প খাতের আয় হয় শতকরা ১৫.৯ থেকে ৩২.৫ ভাগ।
একেবারে অর্থনীতি না বুঝলেও কোরিয়ার এই তথ্যগুলো থেকে এটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি অন্যতম লক্ষ্য হবে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান এবং জাতীয় আয়ের ভাগ কমিয়ে সেটি সেবা খাতে ব্যাপকভাবে বাড়ানো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে সব উন্নত দেশেরই রূপান্তরটি কোরিয়ার মতোই হয়েছে।
কোরীয়দের দেয়া তথ্য থেকে আরো একটি বিষয় আমি নিশ্চত হয়েছি যে ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য দুটি কাজ প্রথমে করতে হবে। কোরীয়রা প্রথমে দেশব্যাপী ইন্টারনেট ছড়িয়েছে। একই সাথে কোরীয়রা ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের জন্য এই কাজটির সাথে আরও একটি নতুন কাজ জুড়ে দিতে হবে। সেই কাজটি হচ্ছে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করা।
আকস্মিকভাবে যেদিন সিউল বিমানবন্দর থেকে ঢাকার পথে পা বাড়াই তখন এই তথ্যগুলো বারবার মাথার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। খুব সহজ হিসাব, কোনো জটিলতা নেই; সামান্য কিছু পরিসংখ্যান বলে দিতে পারছে কোন পথে যেতে হবে আমাদের। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ ১৬ ফ্লাইটের পুরো সময়টা ছাড়াও সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে বসে থাকা সাড়ে ছয় ঘণ্টা সময় স্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, আমরা কোরিয়া থেকে বহু বছর পেছনে থাকলেও আমাদের জন্য কোরিয়া হওয়া মোটেই কঠিন কিছু নয়। একটি আইসিটিবান্ধব সরকার, শেখ হাসিনার সরকারকে যা আমার মনে হয় এবং জনগণের চেষ্টা, যা অবশ্যই আমাদের করার ইচ্ছে আছে; মাত্র এক দশকে বদলে দিতে পারে পুরো দেশটার চেহারা।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com