লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:৯৩
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০০৯ - ফেব্রুয়ারী
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশই-গভর্নেন্স,
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ৩
ডিজিটাল বাংলাদেশে বাংলা ভাষার সঙ্কট
ব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ করে একদিন এক ভদ্রমহিলা ফোন করে জানালেন, আমাকে ঢাকার বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে একটি ক্লাস নিতে হবে। সচরাচর এমন অনুরোধ আমি পেয়েই থাকি। ক্লাসটির নাম উন্মুক্ত আলোচনা। বিষয় অবশ্যই আইসিটি। ‘না’ বলার কোনো কারণ নেই। কারণ, আমি এ বিষয়ে যেখানেই হোক কথা বলতে পছন্দ করি। হবু আমলাদের সামনে কথা বলার সুযোগ আমি সহজে ছাড়তে চাই না। শুনেছি ওরা নাকি আগামী দিনের ম্যাজিস্ট্রেট। এর আগে বিচার প্রশাসনে আমি একইভাবে কথা বলতাম। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া আমার সেই সুযোগটি কেড়ে নেন। আমার অপরাধ ছিল আমাকে তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে মনে করতেন। যাহোক, সেদিন যথাসময়ে বিসিএস প্রশাসনে উপস্থিত থেকে হোঁচট খেলাম একেবারে গোড়াতেই। আমার ক্লাস শুরুর আগে যখন ঘোষণা দেয়া হয় বা আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, তখন শোনা গেলো ইংরেজি আওয়াজ।
আমি ঠিক ভাবতেই পারিনি, বাংলাদেশের আমলাদেরকে প্রশিক্ষণ দেবার মাধ্যম ইংরেজি হতে পারে! এটি কি বাংলাদেশ! যদিও আমি আমার বক্তব্য বাংলাতেই উত্থাপন করি, তথাপি এতে আমার বিষম ওঠার মতো অবস্থা হয়েছিল। এটি অবশ্যই আমার অবাক হবার মতো ঘটনা ছিল না। কারণ আমি জানি, এদেশের প্রশাসন এখন সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ইংরেজি করার পেছনে ছুটছে। তারা স্বপ্ন দেখছে ইংরেজিতে। কথা বলছে ইংরেজিতে। লিখছে ইংরেজিতে। রাজনীতিবিদরা এই মহত্ত্বকে প্রশংসা করছেন এবং বাংলাদেশে ইংরেজি জানা একটি বাহাদুরির কাজে পরিণত হয়েছে। বাংলা না জানলেও কিছু আসে যায় না। তবে ইংরেজি না জানলে ওপরে ওঠা যায় না। অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। কারণ, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা স্বাধীনতার ফসল সংবিধান এদেশে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (আমার কাছে যে কপিটি আছে তা এপ্রিল ২০০৮-এ মুদ্রিত) অনুসারে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ (অনুচ্ছেদ ৩)। এই বিধান অনুসারে রাষ্ট্রের কাজে কোনোভাবেই বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করার উপায় বলা নেই। এটি এমন নয় যে, বিসিএস প্রশাসন একাডেমি প্রয়োজনে ইংরেজি ব্যবহার করতে পারবে।
স্বাধীনতার আটত্রিশ বছর পরে সংবিধানের এই বিধান নিয়ে কি আলোচনা হওয়া উচিত? না সেটি চলতে পারে? ভাষার নামে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এই যে, এখনও শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই স্লোগানই নয়, আমাদেরকে ভাষা আন্দোলন আবার নতুন করে শুরু করার কথা ভাবতে হচ্ছে। উনিশ শ’ বায়ান্ন সালে রক্ত দিয়ে যে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেই ভাষাকেই এখন স্বাধীন দেশে তার অসিত্মত্ব নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে। এটি তথাকথিত শিক্ষিত লোকদের কাছে দ্বিতীয় ভাষায় পরিণত হয়েছে।
বিষয়টি আরও দুর্ভাগ্যজনক যে এই কাজটির অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কমপিউটারায়নকে। এরই মাঝে সরকারের সব অঙ্গে কমপিউটারের প্রচলন মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলা ভাষাকে ঝেটিয়ে বিদায় করা। যখন মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের ফল কমপিউটারে প্রকাশ করা শুরু হলো, তখন বাংলাকে ইংরেজি দিয়ে স্থলাভিষিক্ত করা হলো। যখন সরকার জনগণের জন্য ইন্টারনেটে তথ্য প্রকাশ করা শুরু করলো তখন বাংলাকে বিদায় করে ইংরেজির দৌরাত্ম আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জন্ম নেয় তখন বাংলা শেখানো বন্ধ হয়। কারণে-অকারণে বাংলা ভাষা বিদায় করার এই প্রক্রিয়া প্রতিদিন জোরদার হচ্ছে।
এখন এই প্রশ্নটি করার সময় হয়েছে যে, ডিজিটাল বাংলাদেশে বাংলা ভাষার কি হবে? বিশেষ করে তখন যখন প্রতিদিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার। বলা যেতে পারে, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দটি তখন থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, যখন শেখ হাসিনা সেটি উচ্চারণ করেন। ঘটনাটি সেদিনের। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮-এর। সেদিন তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেন। এরপর ডিজিটাল বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এর আগে থেকেই আমরা এই শব্দ অনেকবার উচ্চারণ করেছি, কিন্তু তাতে এটি জাতীয় পরিচিতি পায়নি। এখন সেই শব্দ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে উচ্চারিত হয়। সরকারের মন্ত্রী, শিক্ষাবিদ, পন্ডিত, ব্যবসায়ী বা চাটুকার কেউ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের বাইরে থাকতে চান না। মাত্র কিছুদিন আগেও যিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটিকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করেছেন, তিনি এখন সবার আগে লেখেন ‘টুওয়ার্ডস ডিজিটাল বাংলাদেশ’। তবে সত্যি কথা হলো, এদের মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ শুনে আমার ভয় হয়। বিশেষ করে আমি প্রতি মুহূর্তে এটি ভাবি, একবার কমপিউটারের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে, এবার কি ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে বাংলা ভাষাকে জবাই করা হবে?
যারা এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে চাটুকারিতা করছেন, তারা এক সময়ে হয়তো বলে বসবেন যে ইংরেজি ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ করা যাবে না।
বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার আটত্রিশ বছরে বাংলা ভাষার নামে জন্ম নেয়া রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য সরকারসমূহের কোনো সদিচ্ছা দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নামের পাকিস্তানী প্রতিষ্ঠানটি একীভূত করার পরও বাংলা একাডেমী বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য কোনো কাজ করেনি। টাইপরাইটার যন্ত্রে বাংলা লেখার জন্য বাংলা একাডেমী লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেও কোনো সুফল পায়নি। কমপিউটারে বাংলা ভাষা বেসরকারি উদ্যোগে প্রচলিত হয়। সরকার বা বাংলা একাডেমী সেই বেসরকারি উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা করার বদলে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। সরকার নিজে প্রমিতকরণের জন্য কাজ না করে অন্যের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি চুরি করেছে। আমরা দিনের পর দিন সরকারকে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য হবার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু তা হয়নি। মাত্র বারো হাজার ডলার সরকার তার রাষ্ট্রভাষার জন্য ব্যয় করেনি। আমরা সরকারকে বাংলা অভিধান, বাংলা বানান পরীক্ষা করা, ব্যাকরণ পরীক্ষা করা, যথাশব্দ খুঁজে পাওয়া, অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিডার, টেক্সট টু স্পিচ কনভার্সন ও স্পিচ টু টেক্সট কনভার্সন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু কারও নজর পড়েনি সেখানে।
এবার যখন সাত বছরের অবিরাম শ্রমের ফসল হিসেবে আমরা শেখ হাসিনার একটি সরকার পেলাম, তখন বলা যেতে পারে, পুরো জাতি আশায় বুক বেঁধে আছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এই দলের কাছে বাংলা ভাষা প্রিয় হবে সেটি খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যে দলের নেতা বলেছিলেন যে, শুদ্ধ হোক বা অশুদ্ধ হোক, ব্যাকরণ ঠিক হোক বা না হোক আমাদেরকে অফিস-আদালতে বাংলা লেখা শুরু করতে হবে এবং আমরা লিখতে লিখতে শুদ্ধ বাংলা লিখবো- সেই মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগ কি বাংলা ভাষার সঙ্কট দূর করবে না?
ক্ষমতায় যাবার পঁচিশ দিনের মাথায় বাংলা একাডেমীর বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর যাই হোক কিছুটা আশার সঞ্চারতো করেছেনই।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষাকে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, বাংলা একাডেমীর গবেষণাসহ সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে। তার সরকার শিক্ষিত ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান জাতি গঠন করতে চায়। সেই লক্ষ্যে তারা ডিগ্রি পর্যন্ত বিনা বেতনে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু, ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১০০ শতাংশ ভর্তি নিশ্চিত করবেন। ২০১২ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চান। ২০১৪ সালের মধ্যে পূর্ণ সাক্ষরতা চান। ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্রে্যর হার ৪৫ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। এ লক্ষ্যে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কমপিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং ২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রাগ্রসর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে এবং এ ইন্সটিটিউটে বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর সব ভাষার গবেষণাও সংগ্রহ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার বাংলা একাডেমীতে মহান একুশের গ্রন্থমেলা উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।- দৈনিক যুগান্তর, ২রা ফেব্রুয়ারি ২০০৯। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জোয়ারের মাঝে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে ব্যবহারের এই ঘোষণা অবশ্যই একটি বিশাল পজেটিভ আশার বিষয়। একই সাথে শিক্ষার প্রসার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় পুরো জাতির জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
আমি কামনা করি, শেখ হাসিনার সরকার কেবল যে শিক্ষার মাধ্যম বা কমপিউটার শিক্ষার কথাই ভাববেন তা নয়, বরং তারা বাংলা ভাষার উন্নয়নে সব শ্রম ঢেলে দেবেন।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com