দেশী সফটওয়্যার শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবাকে দেশ বিদেশের বাজারে পরিচিত করার সাথে সাথে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করতে ‘লিঙ্কিং পিপল উইথ টেকনোলজি’ থিমকে উপজীব্য করে ২৭-৩১ জানুয়ারি ২০০৯ ঢাকার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো দেশের সবচেয়ে বড় বার্ষিক সফটওয়্যার মেলা ‘বেসিস সফটএক্সপো ২০০৯’। বেসিস নিয়মিতভাবে প্রতি বছরই সফটওয়্যার মেলা আয়োজন করে আসছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস তথা বেসিস আয়োজিত এ মেলার এবারকার আয়োজন পঞ্চমবারের মতো।
বেসিস সফটএক্সপো ২০০৯ উদ্বোধন করেছেন অথর্মন্ত্রি আবুল মাল আবদুল মুহিত
দেশের বৃহত্তম সফটওয়্যার মেলা ‘বেসিস সফটএক্সপো ২০০৯’ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান এবং বাণিজ্যমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মো: ফারুক খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেসিস সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম। এতে উপস্থিত ছিলেন বেসিসের জাতীয় অনুষ্ঠানবিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এ তৌহিদ, বেসিসের ওই কমিটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এম এ মুবিন খান এবং গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ওডভার হেশজেডালসহ অন্যান্য কর্মকর্তা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদেই ই-কমার্স চালু হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য কমপিউটার সাক্ষরতা, ই-গভর্নেন্স, সফটওয়্যার তৈরির জন্য দক্ষ জনশক্তি ও কমপিউটার সেবাখাতের বিস্তারে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহবান জানান।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বেসিস, বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি ও তরুণ প্রজন্মের সাথে মিলে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে।
বিশেষ অতিথি প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের আইটি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। ঘরে ঘরে আইটি সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে।
বেসিস সভাপতি তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তথ্যপ্রযুক্তির আউটসোর্সিং বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, চলতি অর্থবছরে এ খাতে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে তিন কোটি ডলার।
স্বাগত বক্তব্যে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ওডভার হেশজেডাল বলেন, গ্রামীণফোন সিআইসি প্রজেক্টের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে আইটি সেবা যোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এবং এ ধরনের কর্মকান্ড অব্যাহত থাকবে।
বেসিস আয়োজিত এবারের সফটএক্সপোতে দেশী-বিদেশী ছোট-বড় ৯৩টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। স্টল সংখ্যা ছিল ১৫৬টি। এ মেলায় ১৬টি বিদেশী তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। দর্শকদের সুবিধার্থে এ মেলা বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা হয়। যেমন : ব্যবসায় জোন, আউটসোর্সিং জোন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ জোন, ইন্টারনেট ও আইটি সেবা জোন।
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তথ্যপ্রযুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পাঁচদিনব্যাপী সফটএক্সপো ২০০৯-এর বিভিন্ন সেমিনারে তারই সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এসব সেমিনার ও কর্মশালায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব ছাড়াও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ মেলাকে উপনীত করে এক ভিন্ন মাত্রায়। শুধু তাই নয়, তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায়, এখাতে সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, যা এর আগে দেখা যায়নি। বলা যেতে পারে, এবারের সফটএক্সপোর উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম একটি।
বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টিতে বেসিস কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে- এ প্রশ্নের জবাবে বেসিস সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, বেসিস দেশে নিয়মিত সফটওয়্যারের মেলা আয়োজন করে আসছে। সেখানে থাকছে দেশী সফটওয়্যার প্রস্ত্ততকারক ও সেবাপ্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাদের পণ্যসামগ্রী। ফলে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক এবং ক্রেতারা দেশী সফটওয়্যার পণ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে। শুধু তাই নয়, সফটওয়্যার মেলায় বিদেশী প্রতিষ্ঠান থাকায় বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরা যেমনি সম্ভব হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশী নির্মাতারা তাদের সাথে মতবিনিময়ও করার সুযোগ পাচ্ছে। ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বেসিস ইপিবির সহযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি ও দুবাই প্রভৃতি দেশের মেলায় ও সেমিনারে অংশ নেয়, যেখানে আমরা আমাদের মেধা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরি। দেশীয় সফটওয়্যার শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে আমাদের নিজেদের মধ্যে পেশাদারি মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। বাজার সম্প্রসারণের জন্য প্রথমে ছোটখাটো কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে পরে বড়মাপের কাজে হাত দেয়া উচিত। এ জন্য দেশের অভ্যন্তরে সফটওয়্যারের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। শুধু তাই নয়, এসব কাজের ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সেই সাথে চাই সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা অর্থাৎ সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, অতীতের মতো নেতিবাচক মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো দোহাটেক। এ প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তাদের ডেভেলপ করা বিভিন্ন সফটওয়্যারের কারণে। দেশের সফটওয়্যার শিল্প বিকাশের প্রধান বাধা চিহ্নিত করতে গিয়ে দোহাটেকের চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুদ্দোহা বলেন, শুধু দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে সফটওয়্যার শিল্প বিকাশের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা তা পারছি না। এ খাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত যেসব তরুণ-তরুণী বের হচ্ছে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের কারণে তাদেরকেও আমরা ধরে রাখতে পারছি না।
জেনুইটি সিস্টেমসের সিইও কমপিউটার জগৎ প্রতিনিধিকে বলেন, আউটসোর্সিংয়ের আন্তর্জাতিক বাজারে ঢুকতে হলে প্রথমেই দরকার আমাদের নিজেদেরকে এক্ষেত্রে দক্ষ হওয়া, আর এজন্য চাই স্থানীয় বাজারে কাজ করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা। তারপর আন্তর্জাতিক বাজারে কাজের চেষ্টা করা। বিদেশীরা আমাদেরকে তখনই কাজ দেবে, যখন আমরা আমাদের স্থানীয় কাজের বাস্তব দৃষ্টান্ত তাদেরকে দেখাতে পারবো।
ডিভাইন আইটির বিপণনবিষয়ক পরিচালক জানান, সফটওয়্যার শিল্প বিকাশের জন্য দরকার দক্ষ জনবল তৈরি করা এবং দেশীয় সফটওয়্যারের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা।
দেশের আইটি খাতে বিশেষ অবদানের জন্য বেসিস সফটএক্সপো-২০০৯-তে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং সাবেক বাণিজ্য সচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরীকে আইসিটি চ্যাম্পিয়ন পদক দিয়ে বিশেষ সম্মাননা জানায় বেসিস।
এবারের বেসিস সফটএক্সপো ২০০৯-এর যৌথ আয়োজক ছিল বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। পৃষ্ঠোপোষক ছিল আইসিটি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল তথা আইবিপিসি। মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল ডেইলি নিউএজ, রেডিও টুডে, এটিএন বাংলা, মাসিক কমপিউটার বিচিত্রা এবং বিডি নিউজ ২৪ ডট কম। সার্বিক আইটি প্রোভাইডার হিসেবে ছিল লিঙ্ক থ্রি টেকনোলজি।
ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৩১ জানুয়ারি ২০০৯-এ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় এবারের মেলা। সমাপনী অনুষ্ঠানে বেসিস নেতৃবৃন্দ ও বক্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ শুধু সফটওয়্যার এবং আইটি এনাবল্ড সার্ভিসখাত থেকেই আগামী ৫ বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় করবে। তারা আরো বলেন, বর্তমানে সফটওয়্যার খাতে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ বাজার এবং ২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। জ্যামিতিকহারে আইসিটি খাতের প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে এ খাতে তিনি নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য সচিব ফিরোজ আহমেদ এবং বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সচিব মো: নাজমুল হুদা খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেসিস সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেসিসের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তা।
শেষ কথা
কোনো কিছু অর্জনের পূর্বশর্ত হলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ার যে ঘোষণা দেন তা যথেষ্ট ইতিবাচক হলেও আমরা জানি না, কিভাবে তা সম্ভব? এ নিয়ে অনেক সংশয় থাকলেও বাস্তবে হয়ত তা সম্ভব হবে যদি সেধরনের কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়। অবশ্য এর জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হতে হবে বাস্তবতার আলোকে আন্তরিক ও উদ্যমী। বর্তমান সরকারের রয়েছে আইসিটি খাতের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, যা আগের সরকারগুলোয় দেখা যায়নি। সরকারের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে দেশের আইসিটি খাতকে এগিয়ে নেয়ার দায়-দায়িত্ব এখন বেসিস ও বিসিএসের ওপর। বেসিস ও বিসিএসের সৎ ও আন্তরিক প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। সেই সাথে আমরা সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে শুনতে চাই না আইসিটি খাতকে নিয়ে কোনো কটাক্ষ উক্তি।
কজ ওয়েব