বর্তমানে ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনা খরচে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য চ্যাটিং সফটওয়্যারের ব্যবহার বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে মেসেঞ্জারে সবসময় বন্ধুর অনলাইনে নাও থাকতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে জন্ম নিয়েছে ব্লগিং, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, ফোরাম, পারসোনাল ওয়েবসাইট ইত্যাদি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ব্যাপারটি সবার মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে। প্রায়শ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই এমন লোক খুঁজতে যাওয়া মানে হচ্ছে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা। এই সার্ভিসগুলোর মাঝে টুইটার ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। টুইটারের উৎপত্তি, সুযোগসুবিধা, সেবার ধরন ও জনপ্রিয়তার কারণগুলো নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন।
টুইটার কি?
টুইটার একাধারে একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সার্ভিস ও সেইসাথে মাইক্রো ব্লগিং সার্ভিসের সুবিধা দিয়ে থাকে। তাই একে শুধু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট বললে ভুল হবে। কেননা এটি পূর্ণাঙ্গ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবগুলোর (ফেসবুক, মাইস্পেস, হাইফাইভ ইত্যাদি) মতো করে বানানো হয়নি। আবার এককভাবে এটিকে কোনো ব্লগিং সাইটও বলা যাবে না। কারণ সাধারণত ব্লগে একজন ব্যবহারকারী অনেক বড় আকারের লেখা প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু টুইটারে যেকোনো লেখা প্রকাশ করতে হয় খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে। ব্লগের সাথে টুইটার ব্যবহারের মূল পার্থক্য হলো-টুইটারের তথ্য প্রদর্শনের সংক্ষিপ্ততা। টুইটার ব্লগারদের এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীদের একীভূত করেছে। টুইটার ইঞ্জিনিয়ার বিজ স্টোনের মতে-টুইটারের সার্ভিস তার ব্যবহারকারীরা পছন্দ করে, কারণ টুইটার তার ব্যবহারকারীদের কোনো টেকনিক্যাল ডিভাইস অথবা মেসেঞ্জারের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই সর্বক্ষণিক যোগাযোগের সুবিধা দিতে সক্ষম। তার মতে, টুইটার একটি সহজ সরল ডিভাইস ইন্ডিপেন্ডেন্ট, সোশ্যাল রাউটিং ব্যবস্থা, যা কেউ ব্যবহারের চেষ্টা না করা পর্যন্ত বুঝতে পারবে না এর সরলতা।
টুইটারের ইতিবৃত্ত
২০০৬ সালে জ্যাক ডরসির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা লাভ করে টুইটার.ইঙ্ক নামের প্রাইভেট কোম্পানি। যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো জনমাধ্যমে মোবাইল সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সার্ভিস ও মাইক্রোব্লগিং ব্যবস্থার সুযোগসুবিধার বিকাশ ঘটানো। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে প্রতিষ্ঠানটির হেডকোয়ার্টার রয়েছে, যার কর্মচারী সংখ্যা ১৪১ জন। কোম্পানির চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন জ্যাক ডরসি, সিইও পদে আছেন ইভান উইলিয়ামস এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর পদে রয়েছেন বিজ স্টোন। টুইটার ইঙ্কের বানানো যোগাযোগ ক্ষেত্রে সুবিধাদানকারী টুইটার নামের এ সাইটটির ঠিকানা হচ্ছে www.twitter.com।
টুইটারের সেবা
টুইটার তার ব্যবহারকারীদের তথ্য দেয়া-নেয়ার যে সুবিধা দেয় তা টুইট নামে পরিচিত। টুইট হচ্ছে ১৪০ অক্ষর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন টেক্সটভিত্তিক পোস্ট। লেখক তার টুইট পোস্ট করার পর তার অনুসরণকারীরা সেই টুইট পড়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারে। প্রেরক তার ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের তথ্যের প্রচার ব্যক্তিগতকরণ করতে পারেন। টুইটারকে অনেক সময়ে SMS (Short Message Service) অব দ্য ইন্টারনেট বলা হয়ে থাকে। টুইটারের এ সেবার ফলে একজন ব্যক্তি অনায়াসে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীদের সাথে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন খুব দ্রুত তথ্য দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে। ২০০৯ সালের শেষের দিকে ব্যবহারকারীরা একের অধিক লেখকের টুইট দেখার এবং মন্তব্য করার সুবিধা পাওয়া শুরু করেন। টুইটারের অ্যাপ্লিকেশন ইন্ডিপেন্ডেন্সি একটি উল্লেখযোগ্য ফিচার। টুইটারে পোস্ট করতে ব্যবহারকারীরা টুইটার ওয়েবসাইট, টেক্সট মেসেজিং অথবা যেকোনো এক্সটারনাল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করতে পারেন। ওয়েবসাইট ও ডেস্কটপ অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে টুইটারের সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে- GamerDNA, NutshellMail, Qapacity, TweetMyGaming, TwitArt.com, Twitpic, Feedalizer, TweetGlide, Twhirl ইত্যাদি। বিভিন্ন প্লাটফর্মের জন্য টুইটারের অ্যাপ্লিকেশনের রয়েছে ভিন্ন রূপ। উইন্ডোজের জন্য সেবা দেয়ার পাশাপাশি ম্যাক ওএস, আইফোন ওএস ও লিনআক্সের জন্যও রয়েছে তাদের কিছু অ্যাপ্লিকেশন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- Mixero, TwwetDeck, Tweetie, Twitterfall, Twitterrific, Choqok (লিনআক্সের জন্য)। এ অ্যাপ্লিকেশনগুলো টুইটার সাইটে ছবি আপলোড, ব্যাকগ্রাউন্ড ইমেজ পরিবর্তন, ফন্ট স্টাইল বদলানো, টেক্সট এডিট করা, মোবাইল থেকে টুইটারে টেক্সট পোস্ট করাসহ আরো অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়।
টুইটারের ব্যবহার
বর্তমানে টুইটার ব্যবহার করে লোকজন তাদের বন্ধু ও স্বজনদের সাথে বিনামূল্যে মেসেজ দেয়া-নেয়া করতে পারছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি তাদের নতুন পণ্যের প্রচারণা চালাতে, কোনো কোম্পানি তাদের মিটিংয়ের বা অনুষ্ঠানের তারিখ সম্পর্কে কর্মচারীদের জানাতে, রাজনৈতিক প্রচারণা, শিক্ষকরা ক্লাসের সময় শিক্ষার্থীদের জানাতে, জরুরি কোনো খবর প্রকাশ করার জন্য, গেমাররা সংক্ষেপে গেম রিভিউ করার জন্য টুইটার ব্যবহার করছেন। সেলিব্রেটিরা তাদের আসন্ন কোনো ইভেন্ট বা শো সম্পর্কে ভক্তদেরকে অবগত করতে এবং মিডিয়াগুলো তাদের সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ব্যাপারগুলো জনসাধারণের সাথে শেয়ার করতে টুইটারকেই বেছে নিচ্ছে। সেলিব্রেটিদের প্রোফাইলের টুইট দেখার জন্য ব্যবহারকারীকে সেই সেলিব্রেটির ফলোয়ার হিসেবে টুইটারের নিবন্ধন করতে হবে। সেলিব্রেটিরা টুইটার ব্যবহার করে তার ভক্তসংখ্যার পরিমাণ দেখে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে পারেন। তাই ইদানীং সেলিব্রেটিরা বেশ তোড়জোড় করেই নেমেছেন টুইটারের দুনিয়ায়। টুইটারে খুঁজে পাওয়া যাবে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, লেখক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মিউজিশিয়ান এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও। সম্প্রতি বারাক ওবামাও টুইটারে খুলেছেন নিজের অ্যাকাউন্ট।
টুইটারের জনপ্রিয়তা
২০০৬ সালেই বিশ্লেষকদের তথা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নজরে আসে এবং বেশ ভালোভাবেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাঝে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। টুইটার ইঞ্জিনিয়ার বিজ স্টোন-এর মতে, গত বছরের মার্চ মাসে টুইটার ১০০,০০০ ইউজারের মাইলফলক অর্জন করে এবং প্রতি ৩ সপ্তাহ অন্তর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিবগুণ হচ্ছে। টুইটার ব্যবহারকারীরা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের ছোটখাটো ঘটনা থেকে শুরু করে কোনো বৈশ্বিক অথবা দেশের অভ্যন্তরীণ খবরও শেয়ার করে থাকে। ইউজার ভিসিটের ওপর জনপ্রিয়তার তালিকা প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান অ্যালেক্সার তালিকানুসারে টুইটার প্রথম ২০টি জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের একটি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। প্রথম স্থানে রয়েছে গুগল (www.google.com), দিবতীয় স্থানে ফেসবুক (www.facebook.com) ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইয়াহু (www.yahoo.com)। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সার্ভিসগুলোর মাঝে টুইটার অন্য সার্ভিসগুলোর পাশাপাশি বেশ পাল্লা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাইক্রোবগ্লিং সাইটগুলোর মাঝে টুইটার শীর্ষের দিকে অবস্থান করছে। ২০০৭ সালের শেষের দিকে টুইটারের পোস্ট সংখ্যা বা টুইট ছিলো পাঁচ লাখ, ২০০৮ সালের শেষে ছিলো একশ’ মিলিয়ন বা দশ কোটি, ২০০৯ সালের শেষার্ধে ছিলো দুই বিলিয়ন এবং ২০১০ সালের তিন মাস যেতে না যেতেই টুইটারে টুইট সংখ্যা চার বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কত দ্রুত টুইটারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং দ্রুততার সাথে তা বিস্তার লাভ করছে বিশ্বব্যাপী।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : tazbirs@gmail.com