• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা এবং ই-লার্নিং
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মানিক মাহমুদ
মোট লেখা:২৪
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০০৮ - সেপ্টেম্বর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ই-লার্নিং
তথ্যসূত্র:
ই-গভর্নেন্স
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা এবং ই-লার্নিং

যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের দেশের শিক্ষা কতটা যুগোপযোগী? আমি নিশ্চিত, উত্তর আসবে হতাশাব্যঞ্জক৷ যদি পরের প্রশ্নটি হয়, আমাদের কেমন যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা দরকার? এর উত্তর আসবে মিশ্র৷ কেউ হয়তো বলবেন, পুরোটাই পাল্টে ফেলতে হবে, কেউ বলবেন কারিকুলাম পাল্টাতে হবে, কেউবা বলবেন শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে, এরকম নানা মত৷ আসলে সমাধান কোনটি? সমাধান যেটাই হোক, এখন প্রশ্ন হলো- সেই যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তি কতখানি এবং কী ভূমিকা রাখতে পারে?

মৌলিক ও বিশেষায়িত জ্ঞান

একটা সময় ছিল যখন আমরা জানতাম শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান থাকতে হবে৷ মৌলিক জ্ঞান ছাড়া কেউ খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না৷ পরে জানলাম, বিশেষায়িত জ্ঞান থাকতে হবে৷ বিশেষায়িত জ্ঞান ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়৷ বিশেষায়িত জ্ঞান মানে কারিগরি জ্ঞান, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞান জানা প্রভৃতি৷ আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এসব জ্ঞান অর্জন অনেকখানিই সম্ভব৷ এছাড়া পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন উত্স, যেমন- ট্রেনিং নিয়েও এ জ্ঞান অর্জন করা যায়৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই জ্ঞান দিয়ে একজন মানুষ বাস্তবতা মোকাবেলা করতে কতখানি সক্ষম হন? এটা আমাদের সবার কাছেই বোধগম্য, এই মৌলিক ও বিশেষায়িত জ্ঞান দিয়ে দৈনন্দিন ও সমাজ জীবনের যত সমস্যা তার খণ্ডাংশের সমাধান করা যায় মাত্র৷ পুরো সমস্যা সমাধান করার জন্য যে দক্ষতা দরকার, যে মানসিকতা দরকার, যে মনোবল দরকার, তা তৈরিই হয় না বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায়৷ এবং আপাতদৃষ্টে তা অসম্ভব৷ তবে কৌশল ও বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রয়োজন আছে৷

ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং

একবিংশ শতাব্দীতে দরকার ব্যক্তির ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এবিলিটি, সীমাবদ্ধতার বাইরে এসে চিন্তা করার সামর্থ্য৷ একসময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই সত্যেন বসুর মতো ক্রিটিক্যাল থিঙ্কার বের হতেন৷ এখন শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেড়েছে৷ কিন্তু ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এবিলিটির মানুষ কমে গেছে৷ অথচ, আমাদের দেশের মানুষই অন্য দেশে গিয়ে এখনো ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং সক্ষমতা দেখাচ্ছেন৷ এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিতও হচ্ছেন৷ এর মানে কী?

আসলে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং তৈরির সামর্থ্যই হারিয়ে ফেলেছে৷ ফলে পুরো শিক্ষণ প্রক্রিয়াটিই হয়ে পড়েছে দুর্বল৷ এ প্রক্রিয়ায় জানার, শেখার সুযোগই কমে গেছে৷ এর ফলে মানুষ বেশি জানতে চান না, বেশি শিখতে চান না৷ কারণ, এই শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির জানার ও শেখার আগ্রহই তৈরি হয় না৷ এই না জানা, না শেখা ব্যক্তি যখন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তিনিও শিক্ষার্থীর মাধ্যমে অনেক জানার, অনেক শেখার আগ্রহ তৈরির কাজে মনোযোগী হবেন না, এটাই স্বাভাবিক৷ ফলে দ্রুতই প্রতিফলিত হয় সেখানে অল্পজ্ঞানের ভয়ঙ্কর রূপ- শিক্ষক শেখতে সহায়তা করার চেয়ে, শেখাতে ও জ্ঞানদান করতে অধিক উত্সাহী হয়ে ওঠেন৷ এখানেই ই-লার্নিংয়ের ভূমিকা৷ ই-লার্নিং শিক্ষার্থীর ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এবিলিটি বাড়াতে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে৷

যখন খুশি তখন শেখার সুযোগ নেই

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ শিক্ষায় একাধিক সফলতা অর্জন করেছে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার বাড়ানো৷ কিন্তু ঝরেও পড়ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই৷ ঝরে পড়ার এ গতি মাধ্যমিক পর্যায়েও বিদ্যমান৷ কিন্তু কেনো? এর একাধিক কারণ বলা যায়৷ সমাধানও রয়েছে নিশ্চয়ই৷ কিন্তু যে শিশু পরিবারের আয় বাড়াতে শ্রম দিতে বাধ্য হয়, কৃষিকাজে যুক্ত হতে হয়, তার পক্ষে তো ওই কাজ ফেলে স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয়৷ এ শিশু তো ঝরে পড়বেই৷ কারণ, সে তো তার সুবিধামতো শিক্ষা নেয়ার সুযোগ পায় না৷ একজন বয়স্ক কৃষকের কথাই ধরুন৷ তিনি কি চাইলেই যখন খুশি তখন শিখতে পারেন? না৷ কারণ, শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাকে একটি ঘর আর সময় দিয়ে বেঁধে ফেলেছে৷ এর ফলে অনেকের আগ্রহ থাকলেও বিদ্যমান এ শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তাল মেলাতে পারছে না৷ কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা তো হবার কথা এমন- যেখানে সবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার সুযোগ থাকবে৷

কেমন যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চাই

আমরা এই বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চাই৷ কী চাই সে শিক্ষাব্যবস্থায়? আমরা চাই নতুন এমন সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা মৌলিক ও বিশেষায়িত জ্ঞানের মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলবে না৷ বরং প্রতিটি শিক্ষার্থী তার যাচাই করে বুঝার ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হবে৷ প্রতিটি শিক্ষার্থী তার ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এবিলিটি বাড়াতে সক্ষম হবে৷ চিন্তা করার সামর্থ্য বাড়াতে সক্ষম হবে বহুগুনে৷ শিক্ষার্থী সমন্বয়ক ও উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার রসদ পাবে ধাপে ধাপে৷ শিক্ষার্থীর উপলব্ধি হবে কেবল পড়ালেখা করাই তাদের একমাত্র কাজ নয়, সমাজের জন্য তাদের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে৷ কারণ, সমাজের কাছে এরা অনেক ঋণী৷ শিক্ষক এই পুরো প্রক্রিয়ায় হয়ে উঠবেন শিক্ষা সহায়ক হিসেবে৷ আর বিদ্যানুরাগীরা হবেন অনুঘটক৷

ই-লার্নিংয়ের ভূমিকা

শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হলে ই-লার্নিং অনিবার্য৷ কাঙ্ক্ষিত এই শিক্ষাব্যবস্থায় ই-লার্নিংয়ের ভূমিকা হবে সুদূরপ্রসারী৷ এর ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে বহু উন্নত দেশের কাছেও অন্যতম দৃষ্টান্ত৷ কিভাবে?

ই-লার্নিং বাস্তবায়ন কঠিন নয়৷ কারণ, ই-লার্নিং কেবল কমপিউটারের মাধ্যমে ঘটবে না৷ ই-লার্নিং মানে মোবাইল, টিভি, রেডিও, ভিসিডি, ডিভিডি প্রভৃতি ইলেকট্রনিক ডিভাইসকেও শিক্ষার কাজে ব্যবহার করা৷ মোবাইলের কথাই ধরা যাক৷ মোবাইল শিক্ষার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে৷ চীনে ইতোমধ্যে মোবাইলের মাধ্যমে ইংরেজি শেখা শুরু হয়েছে৷ বাংলাদেশে তা কেনো সম্ভব হবে না? মোবাইল বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের কাছেও এখন সহজলভ্য৷ সে কারণে সমাজের সবচেয়ে সুবিধা ও অধিকারবঞ্চিত মানুষও এই ডিভাইস ব্যবহার করে শিক্ষার সুযোগ নিতে পারেন৷ এই সুযোগ এরা নিতে পারেন তাদের সুবিধামতো সময়ে- যখন খুশি তখন৷ টিভি, রেডিও, ভিসিডি, ডিভিডি শুধু বিনোদনের মাধ্যম না হয়ে, হয়ে উঠতে পারে ব্যাপক ব্যবহারের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে৷ সপ্তাহ বা দিনের নির্দিষ্ট সময় রেডিও ও টিভিতে বয়সভিত্তিক কোর্স চালু হতে পারে৷

শিক্ষাব্যবস্থার এত যে সীমাবদ্ধতার কথা বলা হলো তার সম্পূর্ণ সমাধান অবশ্যই আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাঙ্গে যুক্ত৷ কিন্তু এর মধ্যেও কিছু বিশেষ বিশেষ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা রাখার আছে৷ মূলত তিনটি ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ব্যবহার সুফল বয়ে আনার ক্ষমতা রাখে৷ এগুলো হলো- শিক্ষাদান পদ্ধতি আর কারিকুলাম উন্নত করতে, শিক্ষকসহ শিক্ষার সাঙ্গে যুক্ত সব প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে এবং মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রশাসনের সর্বত্র স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে৷

শিক্ষাদান পদ্ধতি আর কারিকুলাম উন্নত করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বুঝতে আমরা ভিন্ন দেশের উদাহরণ নিতে পারি৷ মালয়েশিয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন একটি স্বতন্ত্র টিভি চ্যানেল আছে যেখানে প্রতিদিন শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়েই অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে৷ আমাদের দেশে বিটিভির মাধ্যমে অনায়াসে এরকম কিছু চালু করা যায়৷ হতে পারে এমন একটি স্বতন্ত্র চ্যানেল, যা শুধু শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়েই অনুষ্ঠান প্রচার করবে৷ অবশ্যই এখন যেমন প্রচার করা হয়, তেমন একঘেয়ে লেকচারধর্মী অনুষ্ঠান নয়৷ হতে পারে অন্যরকম৷ যেমন ধরা যাক, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পড়ার মান ভালো এটা সারাদেশে অনেকেই মনে করেন৷ এজন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে এনে বক্তৃতা না করিয়ে স্কুলের একটি ক্লাস কার্যক্রমই টিভিতে প্রচার হতে পারে৷ এটা সারাদেশের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্যই কার্যকর হতে পারে৷ আর তা ছাড়া বিজ্ঞান, গণিতসহ সব বিষয়কেই আরও গভীরভাবে বুঝাতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারের বাস্তবতা তো থাকেই৷

চীনের উদাহরণটি স্পষ্ট করে বলা যায়৷ চীন চালু করেছে মোবাইলের মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষার পদ্ধতি৷ আমরা যেমন এখন মোবাইলে রিংটোন ডাউনলোড করি, চীনে এমনি করে ইংরেজি শিক্ষার পাঠ যেকেউ ডাউনলোড করতে পারে৷ যুক্তি হলো মোবাইলের ব্যবহার কেবল বিনোদনেই কেনো সীমাবদ্ধ থাকবে, শিক্ষাতেও এর ব্যবহার ঘটুক! যুক্তিটা অকাট্য৷

শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষকদের তো বটেই, প্রশিক্ষণ দেয়া যায় স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের৷ এই পর্যায়ে আমাদের দেশে যে গুরুতর সঙ্কট আছে সেটা একভাবে সবারই জানা৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে চালু হয়েছে ইন্টারেকটিভরেডিওশিক্ষণ৷ এ ব্যবস্থায় ক্লাসরুমে একটি ইন্টারেকটিভ রেডিও থাকে, স্টুডিওতে থাকেন একজন বিশেষজ্ঞ বা প্রশিক্ষক৷ তিনি শিক্ষককে নির্দেশনা দেন এখন ক্লাসে কী করা উচিত৷ সে নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষক পাঠ পরিচালনা করেন৷ এ পদ্ধতিতে সেখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ খুব কার্যকার হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়৷

অনেক সময় শিক্ষকরা অনেক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বুঝতে পারেন না৷ যেমন- আমাদের দেশে খুব অল্প করে হলেও সহায়তামূলক শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে৷ এ পদ্ধতিতে ছাত্ররা গোলাকৃতির টেবিলের চারধারে বসে৷ শিক্ষকের প্রতি নির্দেশনা থাকে তারা ছাত্রদের আলোচনায় উত্সাহিত করে দেবেন, যাতে তারা নিজেরাই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা সেই পুরনো কায়দায় বক্তৃতা করে যান; গোল টেবিলে গোল হয়ে বসে থাকা ছাত্রদের জন্য সে বক্তৃতা বুঝা আরও দুরূহ হয়ে পড়ে৷ এখন শিক্ষকদের করণীয় বিষয়টি দৃশ্যমান করে বুঝাতে টিভিতে যেমন অনুষ্ঠান প্রচার হতে পারে; হতে পারে শিক্ষক প্রশিক্ষণের সময় নানান মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনা৷

গণতান্ত্রিক প্রশাসন :

শিক্ষা প্রশাসনের স্বচ্ছতার ব্যাপারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির আছে সীমাহীন সম্ভাবনা৷ এ প্রযুক্তি যেভাবে সরকারকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে, তেমনটি আর কিছুই নয়৷ টিভির সীমিত পরিসরের একটি টক শোর কথাই চিন্তা করুন৷ অনেক কর্তাব্যক্তিকে জনগণ যেভাবে প্রশ্ন করতে পারে, জবাবদিহি চাইতে পারে, এটা গত দশকেও ভাবা যেত না৷ এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষার ফল ওয়েবে প্রকাশ করার সুফল তো আমরা দেখেছিই৷ আর একটি সুফলের ক্ষেত্র হলো প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ৷ এক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বহুল আলোচিত৷ কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষাটি কমপিউটারাইজড হওয়া এবং পরীক্ষার ফল ওয়েবে প্রকাশ করা নিয়োগ সংক্রান্ত অনেক বিতর্কেরই অবসান ঘটাতে পেরেছে৷ শুধু স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার ব্যাপারই নয়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের অনেক জটকে ছাড়িয়ে সহজ করে দিতে পারে৷ জনগণের শিক্ষার কল্যাণে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্ভব করে তুলতে এ প্রযুক্তি বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে৷

ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো এখানে সর্বশেষ তথ্য পাওয়া সম্ভব৷ এর ফলে যেকোনো পেশার মানুষের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে উঠবে৷ একইসাঙ্গে টিভি, রেডিও, ডিভিডি, ভিসিডি ব্যবহার করে শিক্ষা যেকোনো বয়সী মানুষের জন্যই আনন্দদায়ক করে তোলা সম্ভব৷ গণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা ও ইংরেজির অনেক জটিল বিষয় সহজ করে উপস্থাপন করা সম্ভব৷ এর ফলে বিজ্ঞানকে আরো জনপ্রিয় করে তোলা সহজ হবে৷ এক্ষেত্রে আর একটি তাত্পর্যপূর্ণ দিক হলো, এ প্রক্রিয়ায় গবেষণালব্ধ সর্বোচ্চ জ্ঞান ব্যবহার করা সম্ভব৷ যেখানে বিদ্যুৎ ও উল্লিখিত মাধ্যম আছে, সেখানে এখনই এ সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব৷ এর ফলে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের চাপ কমবে অনেক৷ শিক্ষার্থীরা ভিডিও দেখার পর যা বুঝা যায়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবে৷ শিক্ষক শুধুু এই প্রশ্নের সূত্র ধরে আলোচনা করবেন৷ যুক্ত করতে পারেন নতুন নতুন উদাহরণ৷ শিক্ষকের দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা দেয়ার আর দরকার পড়বে না- যা বর্তমানে শিক্ষার্থীর আগ্রহ বা প্রয়োজন না থাকলেও শুনতে হয়৷

এভাবে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করে তোলা সম্ভব৷ এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকরা হয়ে উঠতে পারেন সহায়ক যা খুবই তাত্পর্যময়৷ ক্লাসে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করবে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী, শিক্ষক সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবেন৷ উত্তর যে তাকেই দিতে হবে এমন কথা নয়৷ ক্লাসে এমন শিক্ষার্থী থাকতে পারে, যার সে প্রশ্নের উত্তর জানা আছে৷ শিক্ষকের প্রথম দায়িত্ব হবে তাকে খুঁজে বের করা৷ এভাবে চললে, প্রাইভেট পড়ানোর যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে দেশে, তা দ্রুতই কমিয়ে আনা সম্ভব, যা শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রশ্নে খুবই জরুরি৷ উল্লেখ্য, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ইতোমধ্যে প্রাইভেট পড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ অন্যদিকে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষকরা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশের বা দেশের বাইরের ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন৷ একই কাজ আমাদের দেশের শিক্ষকেরাও শুরু করতে পারেন৷

ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের আর একটি বিশেষ দিক হলো এতে শিক্ষকনির্ভরতা কমবে৷ কারণ, একজন শিক্ষক ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে কম সময়ে বেশি কাজ করতে সক্ষম হবেন৷ এতে করে সারাদেশে যে শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে, তা ধীরে ধীরে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব৷ বিদ্যমান ব্যবস্থায় যা অকল্পনীয়৷

করণীয়

এখন এই কাঙ্ক্ষিত যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা এবং তাতে ই-লার্নিং নিশ্চিত করতে হলে কার ভূমিকা কী হবে? আইসিটি সম্পর্কে সব পর্যায়েই কমবেশি অসচেতনতা ও গতানুগতিক মানসিকতা রয়েছে৷ কিন্তু দেশে ই-লার্নিং নিশ্চিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবারই বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই তাদের গতানুগতিক মানসিকতা ও চিন্তার বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে৷ আইসিটি সম্পর্কেও তাদের যে অস্বচ্ছ ধারণা রয়েছে, তা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷ এ নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ কাজ চলছে৷

শিক্ষকরা কী করতে পারেন? শিক্ষকদের ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই তাত্পর্যপূর্ণ৷ প্রাথমিকভাবে ই-লার্নিং বিকশিত হবে শিক্ষকের মাধ্যমেই৷ ই-লার্নিং তৃণমূল পর্যায়েও জনপ্রিয় ও সহজলভ্য করতে শিক্ষকদের ভূমিকা হবে সহায়কের৷ একজন শিক্ষক ই-লার্নিং প্রক্রিয়ায় সহায়ক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেন৷ শিক্ষক যাতে করে সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন সে লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণেও মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে৷ সে বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা শুরু করতে হবে৷

বিদ্যানুরাগী যারা তাদের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ৷ সমাজের সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে আইসিটি সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে বিদ্যানুরাগীরা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারেন৷ একজন বিদ্যানুরাগীই অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হয়ে সমাজে বলতে পারেন- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে ই-লার্নিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম । এ জন্য আমাদের সমবেত হয়ে কাজ করতে হবে৷ এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে তিনিই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করতে পারেন ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় নেতৃত্ব, অভিভাবক, শিক্ষার্থী সবাইকে৷ এভাবেও নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হতে পারে৷

গণসচেতনতার ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে শিক্ষার্থীরা৷ এ জন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ই-সচেতনতা গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিতে হবে৷ ই-লার্নিং সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও গণসচেতনতা বাড়াতে টিভি টক-শো হতে পারে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার৷ কজ ওয়েব


ফিডব্যাক : manikswapna@yahoo.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
২০০৮ - সেপ্টেম্বর সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস