ওয়্যারলেস রিচার্জিং বা তারবিহীন প্রক্রিয়ায় ল্যাপটপ বা সেলফোনে সরাসরি বিদ্যুৎ সরবরাহ অথবা ব্যাটারি রিচার্জ করার পন্থা উদ্ভাবন নিয়ে প্রযুক্তিবিদরা কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই৷ চূড়ান্ত সাফল্য এখনো আসেনি৷ তবে তাদের দাবি এ কাজটিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার খুব কাছাকাছি চলে গেছেন তারা৷ শেষ পর্যন্ত যদি সাফল্য ধরা দেয় তাহলে যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে তারের মাধ্যমে ব্যাটারি রিচার্জের সুযোগ নেই অথবা ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে ওয়্যারলেস রিচার্জিং ব্যবস্থায় ল্যাপটপ, সেলফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে৷ চার্জার, তার এবং সকেটের আর প্রয়োজন থাকবে না৷
এ ব্যাপারে সাম্প্রতিক সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তিবিদরা চোখ বন্ধ করেই দেখতে পাচ্ছেন আগামী দিনের ল্যাপটপ, সেলফোনসহ সব ইলেকট্রনিক যন্ত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে ওয়্যারলেস রিচার্জিং প্রযুক্তিতে৷ বৈদ্যুতিক সকেটে প্লাগ ঢোকানোর দরকার হবে না৷ তারা একে বলছেন ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন প্রযুক্তি৷ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পর সান ফ্রান্সিসকোতে ইন্টেল করপোরেশনের গবেষকরা ২১ আগস্ট এই প্রযুক্তির সাফল্যজনক ব্যবহার দেখিয়েছেন৷ তারা ওয়্যারলেস প্রক্রিয়ায় ৬০ ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বালিয়েছেন যার বিদ্যুৎ উত্স ছিল তিন ফুট দূরে৷ কোনো বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ ছিল না৷ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তারা ছিল৷ একদিকে বৈদ্যুতিক বাল্ব, মাঝখানে তিন ফুট ফাঁকা, এর পর বিদ্যুতের উত্স৷ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা গেছে৷ এক্ষেত্রে বিদ্যুতের সিস্টেম লস হয়েছে এক-চতুর্থাংশ৷
ইন্টেলের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা জাস্টিন ৠাটনার এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে তিন ফুট দূরে থাকা ৬০ ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বালাতে পারা এ পর্যায়ে নিঃসন্দেহে একটি বড় সাফল্য৷ তবে এ গবেষণা আরো এগিয়ে নিতে হবে, যাতে সিস্টেম লস না থাকে৷ অর্থাৎ তারবিহীন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে পুরো বিদ্যুত্টাই যেনো ব্যবহার করা যায়৷ এতে কেবল ল্যাপটপ এবং সেলফোন ব্যবহারকারীরা যে লাভবান হবেন তা নয়, সব ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রে এভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে৷ তখন তারবিহীন বিশ্বের যে স্বপ্ন প্রযুক্তিবিদরা লালন করছেন তা বাস্তবে রূপ পাবে৷
ওয়্যারলেস রিচার্জিং বিষয়টি অলৌকিক কিছু নয়৷ এটি মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়৷ এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের কিছু মৌলিক তত্ত্বের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে মাত্র৷ একই ফ্রিকোয়েন্সিতে ইলেকট্রিক কয়েল একে অপরের কাছ থেকে দূরে থেকেও বিদ্যুৎ পরিবহন অর্থাৎ ট্রান্সমিট করতে পারে৷ তবে একথা সত্য যে ওয়্যারলেস রিচার্জিং ব্যবস্থা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী করার আগে আরো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে৷ যদিও ৠাটনারের বিশ্বাস আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই প্রযুক্তি পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে৷
জাস্টিন ৠাটনার বলেছেন, ল্যাপটপ যাতে ওয়্যারলেস পাওয়ার বা বিদ্যুৎ গ্রহণ করতে পারে সে জন্য তারা ল্যাপটপ সংস্কারের চেষ্টা করছেন৷ তিনি বলেন, ইন্টেল এ কাজের প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে৷ ভবিষ্যতে তারা এমন ল্যাপটপ তৈরি করবেন যা তারযুক্ত এবং তারবিহীন উভয় প্রযুক্তিতেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাবে৷ তবে এ ব্যাপারে প্রধান যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা হলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা৷ কারণ এটি ব্যাটারির বাইরেও কমপিউটারের অন্যান্য অংশে বিঘ্ন ঘটাতে পারে৷
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক মেরিন সোলজাসিক বলেছেন, তার দল গত বছর একটি বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকীতে এই ওয়্যারলেস রিচার্জিংয়ের বিষয়টি প্রকাশ করলে প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়৷ তারা বিষয়টিকে বাস্তবে রূপ দিতে অনেক পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন৷ এর মধ্যে পেসমেকার এবং কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে তারহীন বিদ্যুৎ সরবরাহের সম্ভাবনার বিষয়টিও রয়েছে৷ তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহনের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সিস্টেম লস৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ ট্রান্সমিট করার সময় এর বড় একটি অংশ হারিয়ে যায়৷ এটা যাতে না হয় গবেষকরা এখন তা নিয়েই কাজ করছেন৷ এমআইটির গবেষকরা পুরো প্রযুক্তিটির নাম দিয়েছেন ওয়াইট্রিসিটি৷ ওয়্যারসে এবং ইলেকট্রিসিটির যুগ্ম অবস্থান এটি৷ এর আগে তারা চার্জিং কয়েল ব্যবহার করে ৭ ফুট দূর থেকেও বাল্ব জ্বালাতে সক্ষম হয়েছেন৷ অবশ্য দক্ষতার বিবেচনায় এটি ৪০/৪৫ শতাংশ৷ এর অর্থ বিদ্যুতের একটা বড় অংশই বাল্ব জ্বালানোর কাজে ব্যবহার হচ্ছে না, বরং হারিয়ে যাচ্ছে৷
কিন্তু এখন এ কাজে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেছেন সোলজাসিক৷ তিনি বলেন, ইন্টেল যে ডেমো দেখিয়েছে তার দলের সাফল্য তার চেয়ে বেশি৷ তবে ইন্টেলের মতো বিশ্বের বৃহৎ কমপিউটার চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যে এমন একটি প্রযুক্তির পেছনে রয়েছে এবং সার্বিক সহায়তা করতে তার জন্য সোলজাসিক সন্তোষ প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, এ ধরনের একটি প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর৷ মানুষ অবশ্যই এ প্রযুক্তি চাইবে৷ এখন প্রশ্ন হলো, সত্যি এ ধরনের প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব, নাকি নয়? সার্বিক গবেষণা বিশ্লেষণে এ কথাটাই এই মুহূর্তে বলা যায়, দিনকে দিন এই প্রযুক্তিটি কল্পনা থেকে বাস্তবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷
সান ফ্রান্সিসকোতে ইন্টেল ডেভেলপার ফোরামের গবেষক অ্যালানসন স্যাম্পল তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ব্যবহার প্রদর্শন করেছেন৷ তিনি দেখিয়েছেন তিন ফুট দূর থেকে তারবিহীন প্রক্রিয়ায় কিভাবে বিদ্যুৎ দিয়ে বাল্ব জ্বালাতে হয়৷ তিনি জানান, এখন তারা কাজ করছেন ল্যাপটপ এবং সেলফোনের মতো ইলেকট্রনিক যন্ত্র কিভাবে রিচার্জ করা যায় তা নিয়ে৷ এ জন্য কয়েলের আকার ছোট করতে হবে, যাতে সেটি ল্যাপটপে বসানো যায়৷ এই ছোট করার কাজ ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে৷ এটিই মূলত বিদ্যুৎ রিসিভারের কাজ করবে৷ এই কয়েল বসানো থাকবে মনিটর, ছবির ফ্রেম বা টেবিলে৷ কিংবা এমন কোনো জায়গায় যেখানে থাকলে মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র রিচার্জ করতে সুবিধা হয়৷
এন্ডারলে গ্রুপের বিশ্লেষক রব এন্ডারলে বলেছেন, বিশ্বকে পাল্টে দেয়ার মতো ক্ষমতা রয়েছে এই প্রযুক্তির৷ আর আমরা ওয়্যারলেস রিচার্জিং প্রযুক্তি বাস্তবে হাতে পাওয়ার খুব কাছাকাছিই অবস্থান করছি৷
ইন্টেলের আগে এমআইটির গবেষকরাই যে প্রথম ওয়্যারলেস রিচার্জিং নিয়ে কাজ শুরু করেন তা নয়৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলী নিকোলা টেসলা প্রথম দূরপালার ওয়্যারলেস এনার্জি ট্রান্সফারের বিষয়টি পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু অর্থাভাবে তার সে পরীক্ষা আর করা হয়নি৷ অন্যরাও এ বিষয়ে কাজ করেছেন৷ যুক্তরাজ্যের কোম্পানি স্পাশপাওয়ার তৈরি করেছে ওয়্যারলেস রিচার্জিং প্যাড৷ এই প্যাডের ওপর ল্যাপটপ, সেলফোন, এমপিথ্রি প্লেয়ারসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র রাখতেই চার্জ হয়ে যায়৷ এতে ব্যবহার হয়েছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ৷
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com