• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > শিক্ষায় নতুন সূর্যোদয়
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: গোলাপ মুনীর
মোট লেখা:২৩৩
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৩ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ই-লার্নিং
তথ্যসূত্র:
শিক্ষা
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
শিক্ষায় নতুন সূর্যোদয়

ডালাস ব্রুকস কমিউনিটি প্রাইমারি স্কুল। এটি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের একটি স্কুল। এখন তাদের পাঠ মূল্যায়নের সময়। ১১ বছর বয়সের বেশকিছু ছাত্রের ভিডিও তোলা হচ্ছে। এরা ধাপে ধাপে ব্যাখা করছিল গুণ করার প্রক্রিয়াগুলো। পাশের একটি শ্রেণীকক্ষে শিশুরা ব্যবহার করছে তাদের পার্সোনাল কমপিউটার নানা তথ্য স্মার্টবোর্ডে আপলোড করার জন্য। স্মার্টবোর্ডটি মূলত একটি ইন্টারেক্টিভ হোয়াইট বোর্ড। এটি ব্যবহার হচ্ছে ক্লাসে শেয়ার করার জন্য।

প্রিপারেটরি ক্লাসে পাঁচ বছরের বয়সী শিশুরা ব্যবহার করছে ডিজিটাল মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা। এগুলো ব্যবহার করে এরা রেকর্ড করছে প্রতিদিনের পাঠ। এদের রঙিন শ্রেণীকক্ষটি পরিপূর্ণ ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, নিনটেন্ডো ডিএস ও আইপডে।

বললে ভুল হবে না, প্রযুক্তি ঢুকে গেছে শ্রেণীকক্ষে। শিশুদের পড়তে শেখার সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষ করা পর্যন্ত, তাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রচলিত পদ্ধতি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তা আজ পরিণত ডিজিটাল ও অনলাইন টিচিং মেথডে। ডালাস ব্রুকস প্রাইমারি স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ আমান্দা হেনিং যেমনটি বলছিলেন : ‘প্রযুক্তি শিশুদের শিক্ষার প্রতিস্থাপন ঘটাছে না, বরং বলা ভালো প্রযুক্তি শিশুদের শিক্ষায় সহায়তা দিচ্ছে। এখনও আমরা আশা করি শিশুরা শিখবে সময়ের ছক, বানান ইত্যাদি। কিন্তু আমরা তা শেখানোর নতুন নতুন উপায় খুঁজছি, যাতে করে শিশুরা তা আরও ভালোভাবে শিখতে পারে। সেজন্য আমরা শিশুদের কাছে নিয়ে যাচ্ছি প্রযুক্তি। শিশুদের সংশ্লিষ্ট করছি প্রযুক্তি ব্যবহারে।’

আগেকার দিনে একটি ক্লাসে একজনই ছিলেন, যার প্রবেশ ছিল জ্ঞানরাজ্যে। আর তিনি হলেন শিক্ষক। এখন সেই জ্ঞানরাজ্যে যেকেউ প্রবেশ করতে পারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিংবা আগে থেকে ধারণ করা তথ্যে। এর অর্থ শিক্ষকের ভূমিকা মৌলিকভাবে পাল্টে গেছে। আগে শিক্ষকেরা শিশুদের বলতেন ‘কী শিখতে হবে’। এখন শিক্ষকেরা শিশুদের বলেন ‘কীভাবে শিখতে হবে’। সিডনির নর্দার্ন বিচের ক্রিশ্চিয়ান স্কুলের ডিরেক্টর অব ডেভেলপমেন্ট অ্যানি নক বলেন, ‘আমি যখন স্কুলে পড়াতাম তখন আমাদের শিখতে হতো নিউ সাউথ ওয়েলসের সব নদীর কথা। এখন আর সে ধরনের পড়াশোনা নেই। এখন আছে শেখার অন্যান্য বিষয়। যেমন একটি Noun কিংবা একটি Verb-এর পরিচয় কী- সেটি আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটি হচ্ছে মৌল জ্ঞান। আমাদের এখন ছাত্রদের শেখাতে হয় ধারণা বা আইডিয়াগুলোর নানা দিক। কতগুলো তথ্য মুখস্থ করা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, ইন্টারনেটে মাউস ক্লিক করলেই তথ্য এসে হাজির হবে আমার সামনে।’ উল্লেখ্য, এই স্কুলের ছাত্ররা অবাধে ঘোরাফেরা করতে পারে একটি উন্মুক্ত ‘ওপেন লার্নিং স্পেসে’। এ লার্নিং স্পেসে রয়েছে এলসিডি স্ক্রিন। দেয়ালে চাইলেই লিখতে পারে ছাত্ররা যা কিছু ইচ্ছে। লিখতে পারে ছোট্ট ব্যাগ কিংবা সোফার উপরও।

এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে কোনো ধরনের চিন্তা-ভাবনা না করে মুখস্থ ও স্মৃতিনির্ভর লেখাপড়ার (rote learning) আমাদের কোনো দরকার নেই। এ ধরনের লেখাপড়া কোনো কাজে আসে না। আগামী দিনের নিয়োগদাতা খুঁজবে এমন স্টাফ, যারা ডাটা মূল্যায়ন বা ব্যাখা করতে পারবে, কাজ করতে পারবে দলবদ্ধভাবে সহযোগিতা ও উদ্ভাবনীর মাধ্যমে। কিন্তু ব্ল্যাকবোর্ডের জায়গায় স্মার্টবোর্ড এবং পাঠ্যবইয়ের জায়গায় আইপড নিয়ে এলেই সে ধরনের শিক্ষায় উত্তরণ ঘটে যাবে না। শিশুরা আগে যা করতে পারত না, প্রযুক্তি এখন তা তাদের করার সুযোগ হাতে এনে দিয়েছে। যেমন- শিশুরা এখন যেকোনো ঘটনা বা তথ্য সম্পর্কে জানতে নিজের বাড়িতে পড়ার টেবিলে বসেই ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করছে। ছাত্র-গবেষকেরা গবেষণা তথ্য একইভাবে চেপে যাচ্ছে ইন্টারনেট থেকে। এরা এখন শিক্ষকদের সাথে যে সময়টা খরচ করছে, সে সময়টায় শিখেছে কী করে তাদের জ্ঞানকে প্রয়োগ করতে হবে। এটাকে বলা হয় flipped learning। এর মাধ্যমে শ্রেণীর কাজ ও বাড়ির কাছ পেছন থেকে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে সামনে।

অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা গুঙ্গাহলিন কলেজের গণিতের শিক্ষক পিটার স্মাইথি প্রতিদিনের পাঠ রেকর্ড করে ইউটিউবে দিয়ে দেন এবং এর লিঙ্ক পাঠিয়ে দেন সেকেন্ড ইয়ার স্টুডেন্টদের কাছে। ছাত্ররা বাড়িতে বসে তা দেখতে পারে। তখন ছাত্ররা তাদের শেখার সুযোগ পায় আগে অথবা পরে সময়ের সুযোগ মতো। শ্রেণীকক্ষে তিনি শুধু জটিল ধারণাগুলোর ব্যাখ্যাই দেন। পিটার স্মাইথি বলেন, সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা হলো তাদের প্রবণতার মধ্যে, যখন তাদের যা শেখানো হয়েছে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাটুকু দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এক-দুই সপ্তাহ পড়ে এরা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারে, আগে তাদের যা শিখতে দেয়া হতো তা নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে এরা যা শিখত, তার চেয়ে এখন অবাক করা অনেক কিছুই শিখছে সক্রিয়ভাবে নিজেরাই শিক্ষাকে বিনির্মাণ করার মাধ্যমে।’

এমনকি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায়ও। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটিতে একটি ইনট্রুডাকটরি কমপিউটার মেথোডোলজি কোর্সে অনুসরণ করা হয় একটি অনলাইন রোল-প্লেয়িং গেম ফ্রেমওয়ার্ক, যেখানে ছাত্রদের অনলাইন কমিক স্টিপ দিয়ে নামিয়ে দেয়া হয় মিশনে, স্টারওয়ার্সের মতো মহাবিশ্বে। এরা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করার পর উন্মোচিত হয় ধারণা বা জ্ঞানে। পয়েন্ট দেয়া হয় কর্মকা- ও অ্যাসাইনমেন্টের ওপর কিংবা ‘মিশন অ্যান্ড সাইড কোয়েস্ট’-এর মাধ্যমে।

‘চতুরভাবে বুদ্ধিমত্তার সাথে গেম মেশিন প্রয়োগ করে আমরা দেখিয়েছি, একগুঁয়েমির অবসান ঘটিয়ে মজাদার উপায়ে শেখানো সম্ভব’- এ অভিমত এ পাইলট প্রকল্পের নেতা ও সহকারী অধ্যাপক বেন লিয়ংয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার এখন হয়ে উঠছে অতীতের এক বিষয়। লেকচারেরা এখন তাদের লেকচার পোস্টিং করছেন অনলাইনে। ছাত্ররা বাড়িতে বসে সে লেকচার শুনছে-দেখছে। মেলবোর্নের আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সিনিয়র লেকচারার ড. মার্ক গ্রেগরি বলেন, ‘মানুষের মনোযোগের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে, আর এদের কাজের উপায়েও পরিবর্তন আসছে। তরুণ প্রজন্মের কথা যদি ধরি তবে দেখা যাবে এরা এক জায়গায় বসে কোনো একজনের লেকচার এক-দুই ঘণ্টা শুনতে চায় না, সে লেখার যতই আকর্ষণীয় হোক।’

বিশ্বব্যাপী আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ফ্রি অনলাইন কোর্স অফারের একটি প্রবণতা শুরু হয়ে গেছে। গত বছর হার্ভার্ড ও এমআইটি প্রতিশ্রম্নতি দেয় এরা ৬ কোটি ডলার মূল্যমানের কোর্স ফ্রি অনলাইনে পড়ার সুযোগ দেবে। আর অনলাইন এডুকেশন প্রোভাইডার Coursera উদ্বোধন করেছে এশিয়ায় প্রথম ব্যাপকধর্মী ওপেন অনলাইন কোর্স। এ কোর্সের হোস্ট হচ্ছে হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। এ বছর এপ্রিলে এ কোর্স উদ্বোধনের পর এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ছাত্র এ কোর্স রেজিস্ট্রেশনে করেছে।

খান অ্যাকাডেমি
শিক্ষার নব-আবিষ্কার

‘Let’s Use Video To Reinvent EducationÕÑ এটি অলাভজনক খান অ্যাকাডেমির স্রষ্টা সালমান খানের ১৮ মিনিটের একটি TED
Talk । এটি অনলাইনে আজ পর্যন্ত ২৬ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে। খান অ্যাকাডেমির বীজটি প্রথম বপন করা হয় ২০০৪ সালে। তখন সালমান খান তার এক জ্ঞাতিবোন নাদিয়াকে গণিতের হোমওয়ার্ক করতে সহায়তা করতেন। তখন সালমান খান পেশায় ছিলেন একজন হেজ ফান্ড অ্যানালিস্ট (Hedge Fund Analyst) । ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পঠিত তার প্রধান পাঠ্য ছিল গণিতসহ কমপিউটার সায়েন্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এরপর এ ইনস্টিটিউশন থেকেই মাস্টার্স ডিগ্রি নেন কমপিউটার সায়েন্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। তারও পর এমবিএ করেন হার্ভার্ড থেকে। যেহেতু সালমান খান থাকতেন বোস্টনে, আর নাদিয়া নিউ অরলিন্সে, তাই নাদিয়ার কাছে তার আইডিয়ার ব্যাখ্যা দিতে তিনি ব্যবহার করতেন ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারের Doodle ফাংশন। তখন এরা কথা বলতেন ফোনে। তিনি কিছু কোডও লেখেন, যা নাদিয়ার জন্য সৃষ্টি কিছু অনুশীলন অনলাইনে সম্পূর্ণ করার জন্য।

যখন দেখা গেল নাদিয়া এর মাধ্যমে শিখেতে পারছে, তখন তার ভাই আরমান এবং আলীও সালমান খানের সহায়তা চাইল। তাদের বন্ধুরাও একই পথ ধরল। কিন্তু তা ততক্ষণ চলল যতক্ষণ পর্যন্ত না আলাদা আলাদাভাবে একেকজনকে শেখানোর কাজটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। তখন সালমানের এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দিলেন, তার লেকচার ভিডিও করে ইউটিউবে ছাড়ার জন্য। সালমান খান তার প্রথম ভিডিও ইউটিউবে পোস্ট করেন ২০০৬ সালে। এখন সালমান খান সিলিকন ভ্যালিতে তার বাড়ির একটি ওয়াক-ইন ওয়্যারড্রোবকে রূপ দিয়েছেন একটি ছোট আকারের অফিসে। সেখানে বিকেল বেলা তার ফ্রি টাইমে তার ভিডিও লেসনের সফটওয়্যার ও অ্যানালাইটিক্যাল টুল ডেভেলপ করতে শুরু করলেন। তৈরি করলেন একটি ডেশবোর্ডও, যাতে করে প্রতিটি ছাত্রের অগ্রগতি জানা যায়। এতে দেখানো হয়, ছাত্ররা যেসব মডিউল সম্পন্ন করেছে, সেগুলো অনুশীলনে এরা কতটুকু ভালো করতে পেরেছে। আর এরা কোন ভিডিওটি দেখেছে, আর ভিডিও দেখায় এরা কতটুকু সময় খরচ করেছে। যে ছাত্রটি ‘সবুজ মার্ক’ পেল, তার অগ্রগতি ভালো। ‘হলুদ মার্ক’ অর্থ মডিউলটি অসম্পূর্ণ। ‘লাল মার্ক’ নির্দেশ করে ছাত্রটি সমস্যায় আছে। ছাত্ররাও নলেজ ম্যাপ অনুসরণ করে একটি বিষয় শেখায় পর পরবর্তী বিষয়ে চলে যাওয়ার সময় তাদের অগ্রগতি মনিটর করতে পারে।

পাঁচ বছর এভাবে চলার পর খান হেজ ফান্ড ছেড়ে নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করলেন খান অ্যাকাডেমির রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের কাজে। যদিও তিনি তখনও কাজ করে যাচ্ছিলেন তার ওয়্যারড্রোব থেকেই। শুরুটা খুব পরিমিত ও সংযত থাকলেও খানের এ নিয়ে তখনই একটা ভিশন বা রূপকল্প ছিল। ২০০৭ সালে যখন তিনি ট্যাক্স পেপারওয়ার্ক ফাইল করছিলেন, তখন তার কাছে চাওয়া হলো একটি নন-প্রফিট কোম্পানি হিসেবে একটি বিস্তারিত মিশন স্টেটমেন্ট দাখিল করতে। আমি লিখতে পারতাম ‘I want to make a repository of videos and exercises on the web for free’, but a mission is something you should chase.’- বললেন সালমান খান। তিনি আরও বলেন, কিন্তু তা না লিখে আমি লিখলাম : ‘A free world-class education, for any one, anywhere.’।

খান এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন : ‘‘We wanted a mission statement on purpose that we could never say, ‘we are done’|”

সালমান খানের ক্রমেই বড় হয়ে ওঠা দলের মধ্যে যারা আছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- ব্যবসায়ের কাজে গতিশীল ভূমিকা রয়েছে এমন ক’জন স্টাফ, তার পুরনো হাই স্কুলের গণিত প্রতিদ্বন্দ্বী, কলেজ রুমমেট, প্রেসিডেন্ট ও চিফ অপারেটিং অফিসারের ভূমিকায় রয়েছেন শান্তনু সাহা এবং স্কুল ইমপিস্নমেন্টেশন লিড সুন্দর সুব্রায়ন। ‘সাধারণত যখন কেউ কোনো নতুন শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানে আসে, তখন প্রতিশ্রম্নতি থাকে শেষ পর্যন্ত একে সমৃদ্ধ করে তোলার। কিন্তু এখানে (খান অ্যাকাডেমির ক্ষেত্রে) রয়েছে বিশ্ব পাল্টে দেয়া প্রভাব (ওয়ার্ল্ড চেঞ্জিং ইমপেক্ট), ব্যক্তিগত সম্পদ নয়।’-বললেন সুব্রায়ন।

সালমান এ উচ্চাকাঙক্ষাতাড়িত এ শিক্ষার লক্ষ্য এমনি-এমনি পাননি। তার জন্ম নিউ অরলিন্সে। বাবা একজন বাংলাদেশী। আর মা ভারতীয়। তার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছে পারিবারিক পর্যায়ের সমঝোতার মাধ্যমে। সোজা কথায় তাদের বিয়ে ছিল একটি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। সালমান খান একবার কৌতুক করে বলেছিলেন লুইজিয়ানার প্রতি তার পরিবারের আগ্রহের কারণ সোজা সাফটা : ‘It had spicy food, humidity, giant cockroaches, and a corrupt government - অনেকটা তার দক্ষেণ এশীয় মাতৃভূমির মতোই।

তিনি এককভাবে মায়ের হাতে বড় হন। পড়াশোনা করেন পাবলিক স্কুলে, গণিতে দক্ষতা আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘হাই স্কুলে আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো-প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র হতে চান, যদি শ্রেণীতে উচ্চ নম্বর পেতে চান, তবে একটু বেশি মনোযোগী হতে হবে বৈকি। আর আমি তা করেছিলাম।’

ব্যক্তি হিসেবে সালমান খানের মধ্যে কোনো ত্রাণকর্তার অস্তিত্ব নেই। তিনি সংগঠন পরিচালনায় পটু, তবে তার রয়েছে কৌতুক করার বাতিক। তিনি আত্মপ্রকাশবিমুখ ও মনোযোগী। একজন কমপিউটার বিজ্ঞানী হিসেবে তার রয়েছে অসীম কল্পনা। সেই সাথে যথার্থ অর্থেই তিনি একজন গণিতবিদ। গণিত কমপিউটার বিজ্ঞান, এই উভয় বিষয়ের প্রতি আছে তার প্রবল আগ্রহ। তিনি যেমন ভিডিও তৈরি করেন তাতে তার সহৃদয়তা ও নিশ্চয়তাবোধ ধরা পড়ে। আজ পর্যন্ত তিনি ৪১০০-রও বেশি ভিডিও তৈরি করেছেন। এসব ভিডিওতে তিনি ইচ্ছে করেই নিজেকে উপস্থাপন করেছেন খুবই সাধারণভাবে। তিনি যখন ধাপে ধাপে চিত্র বর্ণনা করেন ইলেকট্রনিক ব্ল্যাকবোর্ডে, তখন আপনি শুধু তার কণ্ঠই শুনবেন। মনে হবে যেনো আপনার কোনো বন্ধু পাশে বসে কথা বলছেন। এ সাইট এখন গর্ব করতে পারে একটি পরিপূর্ণ পাঠক্রমের জন্য-এর উৎস ও বিশেষত্বের ওপর প্রতিফলন ঘটিয়ে তা করা হয়েছে। পাশাপাশি আছে বিজ্ঞান, কমপিউটার বিজ্ঞান, অর্থায়ন বিদ্যা, অর্থনীতি ও মানবিক বিদ্যা ইউনিট বা ভাগও।

খান তার এডুকেশন ভিশন বা শিক্ষা রূপকল্প সম্পর্কে একটি বইও লিখেছেন। বইটির নাম : ‘দ্য ওয়ান ওয়ার্ল্ড স্কুল হাউস : এডুকেশন রিইমাজিন্ড’। তিনি এ বইয়ে স্ব-উদ্যোগের শিক্ষা (self-paced learning) এবং Ôflipped classroomÕ -এর ধারণা দেন, যেখানে ছাত্র ক্লাসের বাইরে অনলাইন ইনস্ট্রাকশন পায় এবং তাদের বাড়ির কাজ করে শ্রেণীকক্ষে। তিনি ওয়েস্টার্ন অর্থোডক্সিগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন- যেমন আমরা কত বছর স্কুলে পড়ব, কত বছর বয়সে স্কুলে পড়া শুরু করব।

সালমান খানের মতে, সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা হচ্ছে পুরো প্রকল্পটি হতে কোনো কোনোভাবে মানব-শিক্ষকের অপসারণ। কিন্তু তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে মানব-শিক্ষক আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বড় উঠবে। কারণ শ্রেণীকক্ষ হবে আরও বেশি মিথস্ক্রিয় বা ইন্টারেকটিভ একটি স্থান। আর শিক্ষকেরা তখন এমন সব কাজ করতে যাচ্ছেন, যা কমপিউটার করতে পারে না।’

সুব্রায়ন সহমত প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনি যদি ধরে নেন এটি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের জন্য বড় ধরনের একটি সহায়তা, তখন আপনি পাবেন কোথা থেকে আমরা আসছি। এটি ছাত্রকেন্দ্রিক শেখা (স্টুডেন্ট-সেন্ট্রিক লার্নিং)। অতএব...অতএব শিক্ষকেরা হবে আরও বেশিমাত্রায় অর্কেস্ট্রেটার এবং শেখার কাজে ছাত্রদের আরও সক্রিয় নির্দেশক বা গাইড...যেখানে শিক্ষকদের গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে।’

সালমান খান তার প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইন্টারনেট শিক্ষাকে যেভাবে প্রশস্ততর করছেন, যেভাবে তৈরি করে চলেছেন ফ্রি এডুকেশন ভিডিও, তাতে করে তিনি প্রযুক্তিকে যথার্থ উপকরণ করে তুলেছেন। সৃষ্টি করেছেন নতুন উদাহরণ। নজর কেড়েছেন বিশ্ববাসীর। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক টাইম সাময়িকী যে ‘Ô100 Most Influential People : 2012’ তালিকা প্রকাশ করে, তাতে সালমান খানের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। আর তার ছোট্ট অনলাইন অলাভজনক খান অ্যাকাডেমি আজ বিশ্বব্যাপী অতি সুপরিচিত এক নাম। মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছেন : ‘Sal Khan is a true Education pioneer. His impact on education might be truely in Calculable.’

শ্রেণীকক্ষে ভিডিও গেম

এটিও একটি অবাক করা ব্যাপার, কেনো শিশুরা নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ভিডিও গেমের পেছনে লেগে থাকবে। বরং এরচেয়ে ভালো ছিল যদি এরা ব্যস্ত থাকত তাদের ক্লাসে দেয়া বাড়ির কাজ নিয়ে। সণায়ুবিজ্ঞানী ও শিক্ষক জুড়ি উইলসের অভিমত- এর কারণ তাদের মগজটা সাজানোই হয়েছে এমন করে। ভিডিও গেম এতটা আকর্ষণীয় হওয়ার কারণ শিশুরা তাদের ভুল থেকে যা শেখে তা পুনঃব্যবহার করার সুযোগ পায় ভিডিও গেমে। যখন এরা সাফল্যের সাথে কোনো একটা লেভেল সম্পন্ন করে তখন তার দেহে নিউরোকেমিক্যাল ডোপামাইন তরঙ্গ উদ্বেলিত হয় (একই নিউরোকেমিক্যাল ডোপামাইন আরও বেশি পাওয়ার জন্য জোয়ায় আসক্ত হয় কোনো ব্যক্তি)। তখন এরা উদ্দীপ্ত হয় পরবর্তী চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য। কারণ তাদের মগজ ব্যাকুলভাবে কামনা করে আরেকটি ডোপামাইন প্ররোচিত সুখাঘাত। জুডি উইলস চেষ্টা করছেন এ প্রিন্সিপাল শ্রেণীকক্ষে শেখানো কাজে প্রয়োগ করতে। তিনি বলেন, ‘শিশুদের মগজে মোটেও এক্সিকিউটিভ ফাংশন বা নির্বাহী কর্মকা- থাকে না। এদের দরকার তাৎক্ষণিক সমেত্মাষ। তাদের মগজের সণায়ুতন্ত্র দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশা করার উপযোগী করে গঠন করা হয়নি। অতএব আমাদের কাজ করতে হবে ডোপামাইন সাড়ার বিষয়ের ওপর।’

পুরনো প্রচলিত পদ্ধতি শিশুদের একগুঁয়েমির বিরক্তির দিকে ঠেলে দেয়। জুডি উইলস দেখতে পেয়েছেন, যেসব গেম থেকে শিশুরা শেখার উপাদান পায় এবং তাৎক্ষণিক ফিডব্যাক পায় এমন ভিডিও গেমে শিশুদের আগ্রহ বেশি।

নিজেকে শিক্ষিত করুন

স্কুলে কোনো বিষয় পড়া হয়নি? নতুন কিছু শিখতে চান? ইন্টারনেট সবার জন্য শেখার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। এখন আপনি বিশ্বের সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখতে পারবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনার ডিগ্রি হয়তো জুটবে না, তবে খুলে যাবে আপনার মগজ। নিচে এ ধরনের শেখার কিছু উপায় উপস্থাপন করা হলো :

খান অ্যাকাডেমি : ৪১০০ হাজার ভিডিও’র একটি লাইব্রেরি। ইন্টারনেট শিক্ষার্থীরা এসব ভিডিও দেখেছে ২৫ কোটি বার। khanacademy.org

কোরসেরা : অনলাইন ডিগ্রি। বিশ্বের সেরা অধ্যাপকদের লেকচার। coursera.org

টেড টেক্সস : ১৪০০-এরও বেশি টকসের ভিডিও। বিশ্বের সেরা চিন্তাবিদদের টক এগুলো। ted.com

ওপেনকোর্স ওয়্যার কনসোর্টিয়াম : সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার ও ভিডিও কোর্স। ocwconsunlun.org

আইটিউনস ইউ : আইপড, আইফোন অথবা আইপডের লেকচার ডাউনলোড অথবা ক্রিয়েট।
apple.com/education/itunes_le

উইকি ভার্সিটি : উন্মুক্ত এডুকেশনাল রিসোর্স ও কলাবরেটিভ লার্নিং কমিউনিটি। en.wikivarsity.org

টেক্সটবুক রেভ্যুলেশন : ইন্টারনেটে ফ্রি পাঠ্যবই। centbookrevotion.org

ই-এডুকেশন : প্রেক্ষেত বাংলাদেশ

নতুন এ শতাব্দীর প্রথম দশকেই সবার কাছে এটুকু স্পষ্ট ধরা পড়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির প্রবৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সে পরিবর্তন ব্যাপকভাবে ঘটছে শিক্ষাঙ্গনেও। বিশেষ করে এ পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠছে আমাদের এ বাংলাদেশেও, যদি সে পরিবর্তন পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো ততটা জোরালো নয়।

ই-লার্নিং প্রক্রিয়াটিকে বর্ণনা করা যায় এমন একটি শিক্ষা-ব্যবস্থা হিসেবে, যেখানে শেখার কাজ সম্পন্ন হয় প্রযুক্তি আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বিশেষ করে কমিপউটার ও টেকনোলজির প্রবৃদ্ধির পথ ধরে ই-লার্নিং শিক্ষার এক অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ই-লার্নিং বাস্তবায়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের একটি হচ্ছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে দূরশিক্ষণের সূচনা করা। বাংলাদেশ সরকার নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে প্রথম তৈরি ‘দোয়েল’ ল্যাপটপ, ২০১০ সালের শেষার্ধে। এছাড়া সরকার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের সব স্কুলছাত্র একটি করে ল্যাপটপ দেয়ার।

আজকের সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব নানা উদ্যোগ নিচ্ছে ই-লার্নিং প্রক্রিয়াকে জোরদার করে তোলার জন্য। এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের শিক্ষাঙ্গনকে করে তুলেছে ওয়াই-ফাই জোন। এতে করে ছাত্রছাত্রীরা বিনা খরচে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। সেই সাথে কিছু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়- যেমন ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি ছাত্রকে একটি করে ল্যাপটপ জোগান দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ‘ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ’ প্রকল্পের আওতায়। বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষাকে ডিজিটালাইজ করার জন্য।

তারপরও বলা দরকার ই-লার্নিং প্রক্রিয়াকে জোরদার করে তোলার জন্য প্রয়োজন আরও নতুন নতুন উদ্যোগ। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে নিতে হবে এসব পদক্ষেপ। তবেই দেশে ই-এডুকেশন বা ই-লার্নিং কাঙিক্ষত মাত্রায় গতি পাবে।

কজ
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৩ - আগস্ট সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস