লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:৯৩
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যপ্রযুক্তিতে উদ্যোক্তা আসছে না
তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক স্বপ্নটা মোটেও ছোট নয়। সেই ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ‘হাও টু এক্সপোর্ট সফটওয়্যার ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি সেমিনারে ভারতের নাসকমের প্রধান নির্বাহী দেওয়াং মেহতাকে ডেকে এনে আমরা হাজার কোটি টাকার সফটওয়্যার রফতানির স্বপ্ন দেখেছিলাম, এরপর আর সেই স্বপ্ন কখনও ছোট হয়নি। যদিও এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি আমরা শুধু ১০০ মিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার ও সেবা রফতানি করি, তথাপি আমাদের চাওয়া-পাওয়াটা মোটেই ছোট বৃত্তে আবদ্ধ নয়। সফটওয়্যার ও সেবা খাতের রফতানিকারকেরা আগামী চার বছরে ১০০ কোটি ডলার রফতানির স্বপ্ন দেখেন। আমি নিজে যেখানে ১০ কোটি ডলার রফতানির হিসাব মেলাতে পারি না, সেখানে এই অঙ্কটা বিশাল আকারের তো বটেই। তবে স্বপ্নটা ওখানেও থেমে নেই। প্রধানমন্ত্রী সামনের সাত বছরে ৫০০ কোটি ডলারের স্বপ্ন দেখেন। গত ৪ জুন ১৪ ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই স্বপ্নের কথা বলেছেন। ছোট দেশ হলেও বড় স্বপ্ন আমাদেরকে দেখতেই হবে। এর কারণটাও স্পষ্ট। বড় স্বপ্ন দেখে সেটি বাস্তবায়ন না করতে পারলে আমরা উন্নত বা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব কেমন করে? অন্যদিকে আমাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে, স্বপ্নটা বড় হলেও সেই স্বপ্ন পূরণ করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ কী, সেটি সম্ভবত বেসিস বা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়- কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। এমনকি যাদের দিয়ে এই স্বপ্ন পূরণ হবে, তারাও কি জানে কোন পথে আমরা এই বিশাল সফলতা অর্জন করব? আবার তারা কি জানে আমাদের ঘরের ভেতরের বাজারটা কেমন হতে পারে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেসিস বা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিদেশের দিকে যতটা তাকায়, তেমনটা দেশের ভেতরের দিকে তাকায় না।
আমি জানি না, আমরা শুধু রফতানির কথাইবা বলি কেনো? আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছি, তখন আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে আমাদের পুরো সমাজটাকে ডিজিটালে রূপান্তর করা। যদি তেমনটা করতে হয় তবে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সেবা মিলিয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারটাও হতে যাচ্ছে বিশাল। আমাদের নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এই বিশাল বাজারটির বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনো উদ্যোক্তাই জানে না এই বাজারটি কোথায়, কেমন করে গড়ে উঠছে এবং কোন খাতে উদ্যোগ নেয়া উচিত। এদেরকে শুধু বলা হচ্ছে, তুমি আউটসোর্সিং কর। সেটাও এরা করতে জানে না।
কোনো ধরনের অর্থনীতির হিসাব না করেও একথা বলা যায়, রফতানির স্বপ্নটা পূরণের একটি বড় হাতিয়ার হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ ও বিপুল বিনিয়োগ। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে বাজারজাতকরণ খাতে বিনিয়োগ যদিও বেশ উল্লেখযোগ্য আকারেই হয়েছে, সফটওয়্যার ও সেবা খাতে তেমন বড় কোনো বিনিয়োগ চোখে পড়ে না। দুয়েকটি বড় কোম্পানি আমরা পেয়েছি বটে, তবে এখনও বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির সেবা ও সফটওয়্যার উন্নয়ন খাতে মূল উদ্যোগগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও সেবা খাতে দুয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের সক্ষমতা থাকলেও এখানে ব্যক্তিকেই মূল ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটি অবশ্য ঠিক, আমরা যদি বিলিয়ন ডলারের রফতানির কথা ভাবি, তবে আমাদেরকে এই খাতে বড় বড় উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীর দেখা পেতে হবে। গত ২৭ বছর ধরে এই খাতকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, দেশের দুয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করলেও সাধারণ ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের এই খাতে বিনিয়োগের তেমন আগ্রহ নেই। এর যে কয়টি প্রধান কারণ রয়েছে, তা হচ্ছে- এখানে অভ্যন্তরীণ বাজার তেমন বড় ছিল না। ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর দেশীয় বাজারের অবস্থা বদলালেও এই খাতে সরকারের কর্মপ্রয়াস এখনও খুবই সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে। খুব বড় ধরনের কর্মকা- এখনও আমরা সরকারকে নিতে দেখছি না। অন্যদিকে রফতানির বাজারেও তেমন বড় ব্যবসায় নেই। অন্তত বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখানে বড় ব্যবসায় চোখে দেখছে না। মাঝখানে কলসেন্টার একটি বড় বিনিয়োগের জায়গা হওয়ার মতো পর্যায়ে গেলেও এখন সেটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। এই খাতের বিনিয়োগকারীরা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। দেশে তথ্যপ্রযুক্তির মানবসম্পদ উন্নয়নের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। সব মিলিয়ে দেশের ভেতরের নতুন উদ্যোক্তা বড় মাপের বিনিয়োগে যেতে চাইছেন না। যেটুকু উদ্যোগ আমরা লক্ষ করছি, তা একেবারেই ব্যক্তিপর্যায়ের। সম্প্রতি আউটসোর্সিং কাজে আমাদের নবীনদের বেশ আগ্রহ লক্ষ করছি। সরকারকেও এই খাতে আগ্রহী দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু খাতটি এখনও কোনো পরিকল্পিত পথে এগোচ্ছে না। জেলায়-উপজেলায়-কলেজে বা রাজধানীতে মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খোলার উপায় শিখিয়ে আর যাই হোক বড় উদ্যোক্তা তৈরি করা যাবে না। আমি লক্ষ করেছি, আউটসোর্সিং খাতে ব্যক্তির চেয়ে বড় উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই খাতে দক্ষতার একটি দারুণ সঙ্কট রয়েছে। হাজার ধরনের কাজের মাঝে কোন কাজটি শিখে দক্ষ হয়ে অর্থ উপার্জন করা যাবে, তা কেউ জানে না।
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের নতুন উদ্যোক্তাদের বস্ত্তত উদ্যোক্তা হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতিই বিরাজ করে না। তাদের দক্ষতার বিষয়টি বাদ দিলেও দেশের নিয়ম-কানুন মেনে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো তথ্য তাদের কাছে থাকে না। আবার শুরুতেই ট্রেড লাইসেন্স, কোম্পানি নিবন্ধন, ট্যাক্স-ভ্যাট নিবন্ধন ইত্যাদির চাপে পড়ে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হতে ভয় পায়। আমি এই খাতের নবী নদেরকে এজন্য ঘরে বসে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করতে অনেক বেশি আগ্রহী দেখতে পাই। নতুন উদ্যোক্তাদের কোনো প্লাটফরম নেই। এই খাতের বাণিজ্য সংগঠন বেসিস নতুন উদ্যোক্তাদেরকে কোনো সহায়তা করতে পারে না। বেসিসের সদস্য হতেই এক থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞতা লাগে। এ ছাড়া বেসিসের সদস্য হতে ১০ বা ২০ হাজার টাকা ফি দিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর রিটার্ন ছাড়াও বেসিস সদস্যদের প্রস্তাবনা বা সমর্থন লাগে। একজন নতুন উদ্যোক্তা এতসব ঝামেলায় যেতে চান না। যারা বেসিসের সদস্য নন, তাদেরকে এই সংগঠন সহায়তাও দেয় না। এই প্রতিষ্ঠান নানা খাতে প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু এর জন্য বিপুল পরিমাণ ফি চার্জ করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্য বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তেমন কোনো সহায়তা করে না।
অন্যদিকে এই খাতে পুঁজির অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে ইক্যুইটি এন্টারপ্রেনারশিপ ফান্ড নামের একটি সরকারি তহবিল থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে জোগান দেয়া হয়। কিন্তু এই তহবিল থেকে টাকা পেতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এত প্রবল যে, সাধারণ উদ্যোক্তার পক্ষে এই তহবিল থেকে ঋণ বা পুঁজি পাওয়া কঠিন। ফান্ডের জন্য আবেদন মূল্যায়ন করতেই লাখ টাকা লেগে যায়। এ ছাড়া অভিজ্ঞতা না থাকলে আবেদন করা যায় না। কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকার নিচে কোনো আবেদন করা যায় না। ইদানীং এই তহবিলের জন্য ফ্ল্যাটবাড়ি বা কোনো কোলাটেরল সিকিউরিটির ব্যবস্থা অলিখিতভাবে করতে হয়। এরই মাঝে এই তহবিল থেকে বেসিসের দুই সাবেক সভাপতি টাকা নিয়ে ঋণখেলাপী হয়ে যাওয়ায় সাধারণ উদ্যোক্তারা বেকায়দায় পড়েছেন।
কেউ কেউ মনে করেন, এই খাতে বিদেশী বিনিয়োগও হতে পারে। বিদেশী বড় উদ্যোক্তারাও আমাদের দেশে তাদের কর্মকা- শুরু করতে পারেন। আমি নিজে মনে করি বিদেশী উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে আসার জন্য অন্তত তিনটি বড় শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, দেশের নিজস্ব বাজার বড় হতে হবে। বিদেশী উদ্যোক্তারা যদি দেশের ভেতরে বড় বাজারের সন্ধান না পান, তবে এরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। দ্বিতীয়ত, তথ্যপ্রযুক্তিতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের বড় শর্ত হবে দেশীয় মানবসম্পদের সহজলভ্যতা। এরা যদি রফতানি বাজারের জন্য বাংলাদেশে বসে কাজ করতে চান, তবে স্থানীয় দক্ষ জনশক্তি তাদের জন্য উৎসাহের কারণ হতে পারে। এরই মাঝে বাংলাদেশে যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে, এরা উপযুক্ত মানবসম্পদ খুঁজে পাচ্ছে না। তৃতীয়ত, দেশের শেধাসম্পদ সুরক্ষা অবস্থার পরিবর্তন না হলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আমরা আশা করতে পারি না।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির যেসব উদ্যোক্তাদেরকে দেখতে পেয়েছি তাদের সংখ্যা বিশাল এবং তারা লাগসইভাবে এই খাতে নতুন উদ্যোক্তা হয়েছে। দেশজুড়ে মোবাইল বাজারজাতকরণ ও মোবাইল সংক্রান্ত সেবা খাতে ছোট ছোট উদ্যোক্তার জন্ম হয়েছে। ওরা সংখ্যায় হাজার হাজার। কমপিউটার পণ্য বাজারজাতকরণে বিপুল উদ্যোক্তার জন্ম হয়েছে। ১৯৮৭ সালে দেশে ডেস্কটপ বিপস্নব শুরু হলে সেই বিপস্নবের পথ ধরে ডিটিপি হাউস, ইন্টারনেট ক্যাফে ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম হয়েছে। সরকারিভাবে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র গড়ে তুলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এসব খাতে সরকারের নীতি ও কর্মপন্থার পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তাদের জন্য আয়কর ও ভ্যাটের বিষয়টি নতুন করে বিন্যস্ত করা দরকার। সরকার এখনও ১০০ বর্গফুট একটি দোকানের জন্য ঢাকায় ১১ হাজার টাকা ভ্যাট নিয়ে থাকে। অথচ এসব উদ্যোক্তা তেমন আয় করেন না যে তাদেরকে ভ্যাট দিতে পারঙ্গম মনে করা যায়।
আমরা যদি এই খাতে আরও নতুন উদ্যোক্তা চাই, তবে তাদের জন্য বিশেষভাবে নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এই পন্থায় ট্রেড লাইসেন্স, টিন-ভ্যাট ইত্যাদি বিষয়গুলো সহজ করা ছাড়াও প্রয়োজন হবে উপযুক্ত তহবিলের। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সহজলভ্য না করে নতুন উদ্যোক্তা পাওয়া কঠিন। এদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ওদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য করণীয় বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত হাতের কাছে দিতে হবে। যারা শিক্ষাজীবনের শেষ প্রান্তে, তাদেরকে বিশেষভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এই খাতে যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন, তা যদি তাকে না দেয়া যায় তবে সাধারণভাবে নতুন উদ্যোক্তা পাওয়া যাবে না। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়, তা দিয়ে আর যাই হোক সৃজনশীল উদ্যোগ নেয়া যায় না।
অন্যদিকে আমরা যখন জ্ঞানভিত্তিক কাজে বা সৃজনশীল জগতে উদ্যোক্তার সন্ধান করব, তখন তাদের মেধা, জ্ঞান ও সৃজনশীলতার সুরক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। দেশে মেধাস্বত্ব আইনের লঙ্ঘন চূড়ান্ত পর্যায়ে। সরকার এ বিষয়ে নীরব। বাণিজ্য সংগঠন বেসিস মেধাস্বত্ব নিয়ে একটি কথাও বলে না। আমরা যতক্ষণ মেধার সংরক্ষণ করতে না পারব, ততক্ষণ মেধা খাতে বিনিয়োগ পাব না, নতুন কাউকে এই খাতে উদ্যোগ নিতেও দেখব না।
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com