লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
গ্লোবাল আইসিটি রিপোর্ট ২০১৫
গ্লোবাল আইসিটি রিপোর্ট ২০১৫
যেনো তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ব মানচিত্র
আইসিটি র্যারঙ্কিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯
গোলাপ মুনীর
ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি তথা আইসিটি অব্যাহতভাবে পাল্টে দিচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। পাল্টে দিচ্ছে আমাদের সমাজ। যদি আইসিটিকে হাতিয়ার করে আমরা আমাদেরকে এই পরিবর্তন ধারার সাথে সংশ্লিষ্ট রেখে অর্থনীতি ও সমাজকে এগিয়ে নিতে চাই, তবে কেমন করে, কীভাবে, কী আকারে-প্রকারে চলছে এই পরিবর্তনের কাজটি, তা জানার প্রয়োজন আছে। সেটুকু জানানোর লক্ষে্যই সেই ২০০১ সাল থেকে আইসিটির এই পরিবর্তন বিপ্লবের নাড়ির স্পন্দন পরিমাপ করে আসছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। এই ফোরাম এ কাজটি করছে এর প্রতি বছরের ‘গ্লোবাল আইসিটি রিপোর্ট’ সিরিজ এবং ‘নেটওয়ার্ক রেডিনেস ইনডেক্স’ (এনআরআই) প্রকাশের মাধ্যমে। এনআরআই চিহ্নিত করে একটি দেশের সার্বিক রাজনৈতিক এবং ব্যবসায় ও সরকার পরিস্থিতি। এর মাধ্যমে এনআরআই কার্যত চিহ্নিত করে একটি দেশ আইসিটি সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতি ও সমাজকে এগিয়ে নিতে কতটুকু সক্ষম। এর মাধ্যমে জানা যায়- একটি দেশের জনগণ, ব্যবসায়িক সমাজ ও সরকার আইসিটি ব্যবহারে কী মাত্রায় বা কী পর্যায়ে প্রস্ত্তত, আর অর্থনীতি ও সমাজের ওপর আইসিটির প্রভাবই বা কতটুকু।
গত ১৫ এপ্রিল ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশ করেছে ‘ওয়ার্ল্ড আইসিটি রিপোর্ট ২০১৫’। এতে পর্যালোচিত হয়েছে ১৪৩টি দেশের বা ভূখ--র আইসিটি পরিস্থিতি। এতে ধরা পড়েছে আইসিটির এই বিপ্লব সময়েও বিশ্বের দেশে দেশে যেমনি বিদ্যমান ডিজিটাল ডিভাইড, তেমনি একটি দেশের ভেতরেও চলছে কোনো না কোনো মাত্রার ডিজিটাল ডিভাইড। এই রিপোর্টের মাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছে ডিজিটাল পোভার্টি বা দারিদ্র্যচিত্র, যার ফলে অভাবী মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত আইসিটির সুযোগ ব্যবহারে।
গ্লোবাল আইসিটি রিপোর্টের ২০১৫ সালের সংস্করণে এই ডায়াগনোসিসের বাইরে ‘‘আইসিটি’স ফর ইনক্লুসিভ গ্রোথ’’ থিমের বা আপ্তবাক্যের আওতায় এক্সপার্ট ও প্র্যাকটিশনারদের মাধ্যমে ডিজিটাল পোভার্টি দূর করা ও আইসিটি বিপ্লবকে একটি বৈশ্বিক বাস্তবতায় দাঁড় করানোর উপায় বা সমাধান উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই বলা যায়, এই গ্লোবাল আইসিটি রিপোর্ট যেনো তথ্যপ্রযুক্তির এক বিশ্ব মানচিত্র।
কী আছে এবারের এ রিপোর্টে?
এবারের রিপোর্টের প্রথম অংশে তুলে ধরা হয়েছে ১৪৩টি দেশের নেটওয়ার্ক রেডিনেস ইনডেক্স (এনআরআই) পরিস্থিতি (অধ্যায় ১.১)। এবং এতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয় ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথে’ সহায়তা জোগানোর ক্ষেত্রে আইসিটির ভূমিকা কোন দেশের কতটুকু ছিল (অধ্যায় ১.২-১.১১) ।
আলোচ্য রিপোর্টটির দ্বিতীয়াংশে প্রতিটি দেশের ব্যাপক ডাটা সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। এনআরআই নামের সূচকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে কোন দেশ আইসিটি ক্ষেত্রে কতটুকু সাফল্য দেখাতে পেরেছে। উল্টোভাবে বলা যায়, কোন দেশের ব্যর্থতাইবা কতটুকু।
প্রসঙ্গত, আলোচ্য রিপোর্টে যেসব তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান উপস্থাপিত হয়েছে, এর সবগুলোই সন্নিবেশ, বিন্যাস কিংবা সংগ্রহ করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। সুখ্যাত এই ফেরামের দেয়া এসব তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ আস্থার সাথে বিবেচিত। এই ফোরাম জেনেভাভিত্তিক একটি সুইস অলাভজনক ফাউন্ডেশন। ১৯৭১ সালে এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন ক্লাউস শ্চুয়াব। এটি নিজেকে অভিহিত করে একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে- যা ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজের অন্যান্য নেতাদের সংশি্স্নষ্ট করার মাধ্যমে বিশ্ব পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। এই ফোরাম সুপরিচিত এর বার্ষিক শীতকালীন বৈঠকের জন্য, যা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় সুইজারল্যান্ডের ড্যাভোসে। এ বৈঠকে যোগ দিয়ে থাকেন বিশ্বসেরা ২৫০০ ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ও সমাজের অন্যান্য নেতা, বাছাই করা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক। এরা বিশ্বে নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এ বৈঠকে যারা যোগ দেন তাদের সম্মিলিতভাবে উল্লেখ করা হয় ‘ড্যাভোস প্যানেল’ নামে এবং ব্যক্তিগতভাবে ‘ড্যাভোস ম্যান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রিপোর্টের প্রথম অংশ
আলোচ্য রিপোর্টের প্রথম অংশের শিরোনাম : ‘লেভারাইজিং আইসিটি ফর শেয়ারড প্রসপারিটি’। ২০০১ সালে এই গেস্নবাল আইসিটি রিপোর্ট সূচিত হওয়ার পর থেকে আইসিটি অধিকতর শক্তিশালী, অধিকতর প্রবেশযোগ্য ও আরো বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা জোরদার, উন্নয়ন সাধন ও সমাজের সব স্তরে অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য আইসিটি এখন শীর্ষবিবেচ্য। অধ্যায় ১.১ ও ১.২-এ উপস্থাপিত হয়েছে বিগত দশকে আইসিটির প্রভাব সম্পর্কিত এমপিরিক্যাল লিটারেচারের পর্যালোচনা। এতে পর্যাপ্ত অগ্রগতির প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু এনআরআই সূচক উদঘাটন করেছে- প্রধানত ধনী দেশগুলোই আইসিটি বিপ্লব থেকে উপকার পাচ্ছে। প্যারাডক্সিক্যালি (স্ববিরোধী মনে হলেও এটি মিথ্যে নয়) আইসিটি সূচিত করেছে নতুন নতুন ডিজিটাল ডিভাইড। এখন প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, আইসিটির দেয়া সুযোগ সুবিধা কী প্রকৃতিগতভাবে সবার জন্য, না তা ধনী-গরিবের বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তোলার জন্য? পুরো জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কি পিছিয়ে থাকা অন্য কোনো অংশের চেয়ে বেশি সুবিধা পাবে, যার ফলে সমাজের বৈষম্য পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে? সংশোধনের পদক্ষেপ না নিলে আইসিটি সৃষ্টি করতে পারে নন-ইনক্লুসিভ ধরনের প্রবৃদ্ধি। এর ফলে সমস্যার সমাধানের চেয়ে সমস্যা আরো বাড়িয়ে তোলা হতে পারে।
আলোচ্য রিপোর্টের প্রথম অংশে বাতলানো হয়েছে কিছু অবশ্যকরণীয় সমাধান। আছে অপ্রত্যাশিত বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে ডিজিটাল ডিভাইড দূর করার (ব্রিজিং ডিভাইড) জন্য কিছু নীতি-সুপারিশ। রয়েছে, আইসিটি বিপ্লবে অংশ নেয়ার এবং এ থেকে সবাই উপকৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির পরামর্শও।
অধ্যায় ১.১-এ তুলে ধরা হয়েছে আইসিটি রেডিনেস ইনডেক্স ২০১৫-এর ফলাফল, যাকে বিবেচনা করা হয় আইসিটি বিপ্লবের পালস বা নাড়ি হিসেবে। এই সূচক একটি দেশের আইসিটি উন্নয়নের সক্ষমতার পরিচায়ক। নেটওয়ার্ক রেডিনেস কাঠামো তৈরি ৬টি নীতির ওপর নির্ভর করে : ০১. আইসিটির পরিপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগানো ও এর বৃহত্তর প্রভাব সৃষ্টি করার জন্য একটি উঁচুমানের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায়িক পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ; ০২. আইসিটি ব্যবহারযোগ্যতা, দক্ষতা ও অবকাঠামোর মাধ্যমে পরিমাপ করা আইসিটি রেডিনেস প্রভাব সৃষ্টির পূর্বশর্ত; ০৩. আইসিটি সুযোগ-সুবিধার পরিপূর্ণ কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন একটি সমাজব্যাপী উদ্যোগ : সরকার, ব্যবসায় খাত ও জনগণকে এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে; ০৪. আইসিটি এর নিজের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে না; ০৫. এনভায়রনমেন্ট, রেডিনেস ইউজেস ইত্যাদি ড্রাইভারগুলো পরস্পরের সাথে আমত্মঃক্রিয়া, সহউদ্ভব ও পরস্পরকে জোরদার করে একটি ভার্চু্যয়াস সাইকল গড়ে তুলতে এবং ০৬. নেটওয়ার্ক রেডিনেস ফ্রেমওয়ার্কের থাকা চাই একটি সুস্পষ্ট নীতি-নির্দেশনা। এই ফ্রেমওয়ার্ক রূপান্তরিত হয় এনআরআই-এ। এটি একটি কমপজিট ইনডেক্স, যৌগিক সূচক। এটি তৈরি ৪টি মূল ক্যাটাগরি (সাব ইনডেক্স) ও ১০টি সাব ক্যাটাগরি (পিলার) ও ৫৩টি স্বতন্ত্র ইন্ডিকেটরের সমন্বয়ে। একটি দেশ এসব ক্ষেত্রে যে স্কোর অর্জন করে তারই সামগ্রিক ফলই হচ্ছে এই রেডিনেস ইনডেক্স।
রিপোর্টের দ্বিতীয় অংশ
দ্বিতীয় অংশ পরিপূর্ণ শুধু ডাটা আর ডাটায়। এই অংশে রয়েছে দেশওয়ারী আলাদা নানা ডাটা তথা স্কোর কার্ড। রেডিনেস ইনডেক্সে ১৪৩টি দেশের গ্লোবাল র্যা ঙ্কিং উপস্থাপন করা হয়েছে ৫৩টি স্বতন্ত্র ইন্ডিকেটরের মাধ্যমে। এসব ডাটার মাধ্যমে প্রতিটি দেশ ও অঞ্চল তাদের পারস্পরিক তুলনা করতে পারেবে সহজেই।
স্বাভাবিক কারণেই, অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় আইসিটির সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে বেশি কাজে লাগাবে। এবারের বিশ্ব আইসিটি রিপোর্টে দেখা গেছে, হাইটেক অর্থনীতির দেশগুলোর প্রাধান্য রয়েছে সার্বিক এনআরআই র্যা ঙ্কিংয়ের প্রথম ৩১টি স্থানে। ৫০টি উচ্চ আয়ের দেশের ৪৪টি অবস্থান করছে সেরা পঞ্চাশে। সেরা পঞ্চাশের অন্য ৬টি দেশ হচ্ছে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়ার। এর অবস্থান ৩২তম স্থানে। এ র্যািঙ্কিংয়ের একদম তলদেশে ৩০টি দেশের মধ্যে ২৬টিই স্বল্প-আয় ও স্বল্প-মধ্য-আয়ের দেশ।
এ বছরের রিপোর্টের র্যােঙ্কিংয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড। তৃতীয় সুইডেন। সেরা দশের সাতটি দেশই ইউরোপের। ২০১৪ সালের র্যা্ঙ্কিংয়ে সেরা দশে স্থান পেয়েছিল ইউরোপের ৬টি দেশ। এবার যুক্তরাষ্ট্র আগের বছরের মতোই সপ্তম স্থানে। অষ্টম স্থানে যুক্তরাজ্য ও নবম স্থানে লুক্সেমবার্গ। কোরিয়া প্রজাতন্ত্রকে দুই ঘর পেছনে ঠেলে এবার দশম স্থানে জাপান। এ বছর কোরিয়া প্রজাতন্ত্র নেমে এসেছে দ্বাদশ স্থানে। হংকং ১৪তম স্থানে। সিঙ্গাপুরই সেরা দশের একমাত্র এশীয় টাইগার। সেরা দেশে সিঙ্গাপুর, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে অ-ইউরোপীয় তিন দেশ। ইউরোপ হচ্ছে বিশ্বে সেরা কানেকটেড ও ইনোভেশন-ড্রিভেন অঞ্চল। বিশেষ করে নরডিক দেশগুলো- দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফিনল্যান্ড, তৃতীয় স্থানের সুইডেন, পঞ্চম স্থানের নরওয়ে, পঞ্চদশ স্থানের ডেনমার্ক ও উনিশতম স্থানের আইসল্যান্ড- অব্যাহতভাব সাফল্য প্রদর্শন করছে। অবশ্য এই পাঁচটি দেশ ২০১২ সাল থেকেই ভালো সাফল্য দেখিয়ে আসছে এবং তাদের অবস্থান থেকেছে সেরা বিশেই। পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর গ্রুপ পারফরম্যান্সও বেশ জোরালো। চতুর্থ স্থানের নেদারল্যান্ডস, ৬ষ্ঠ সুইজারল্যান্ড, অষ্টম যুক্তরাজ্য ও নবম লুক্সেমবার্গ স্থান করে নিতে পেরেছে সেরা দশে। ২০১২ সাল থেকে আইসল্যান্ড ২৫তম স্থানটিতেই স্থির আছে।
দক্ষেণ ইউরোপের পর্তুগাল এবার পাঁচ ঘর এগিয়ে ২৮তম স্থানে, ইতালি তিন ঘর এগিয়ে ৫৫তম স্থানে, গ্রিস আট ঘর এগিয়ে ৬৬তম স্থানে। অতএব দক্ষেণ ইউরোপের এসব দেশের অবস্থান উত্তরণের দিকে। এসব দেশে সরকারি পর্যায়ে আইসিটি ব্যবহার বেড়েছে। অপরদিকে ২৯তম স্থানের মাল্টা, ৩৪তম স্পেন, এক ঘর ওপরে ওঠা ৩৬তম স্থানের সাইপ্রাস মোটামুটি স্থির অবস্থানেই।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়া পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো ২০০৪ সাল থেকে হয় আগের অবস্থানে, নয়তো পিছিয়ে পড়ছে : এবার সেস্নাভেনিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্র উভয়ে এক ঘর পিছিয়ে যথাক্রমে ৩৭তম ও ৪৩তম স্থানে, হাঙ্গেরি ছয় ঘর পিছিয়ে ৫৩তম স্থানে, ক্রোয়েশিয়া আট ঘর পিছিয়ে ৫৪তম স্থানে ও সেস্নাভাক প্রজাতন্ত্র আগের মতোই ৫৯তম স্থানে আছে। ইইউর পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো হয় আগের স্থানে, নয়তো পিছিয়ে পড়ছে। এদিকে পোল্যান্ড চার ঘর এগিয়ে ঢুকে পড়েছে প্রথম ৫০-এর দলে। এক সময়ের ব্যর্থতায় ডুবে থাকা রোমানিয়া এবার বারো ঘর এগিয়ে ৬৩তম অবস্থানে। আর বুলগেরিয়া ৭৩তম স্থানে।
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও পাকিস্তান অঞ্চলে ডিজিটাল ডিভাইড সব অঞ্চল থেকে বেশি। ৩৫তম অবস্থানের সৌদি আরব থেকে এবারও এগিয়ে। চার ঘর পিছিয়ে পড়া ২৩তম অবস্থানের আরব আমিরাত ও ২৭তম স্থানের বাহরাইন। আর ওমানের স্থান ৪২তম। এ দেশগুলো গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সদস্য। এসব দেশের সরকারগুলো আইসিটির মাধ্যমে উন্নয়ন সাফল্য অর্জনে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। কুয়েত আছে ৭২তম অস্থানে। জর্দান ৫২তম, মরক্কো ৭৮তম ও মৌরিতানিয়া এ অঞ্চলের সবচেয়ে খারাপ ১৩৮তম স্থানে।
বিকাশমান ও উন্নয়নশীল এশিয়া অঞ্চলের দিকে থাকালে দেখা যাবে- এ অঞ্চলের সবচেয়ে সফল ও সবচেয়ে বিফল দেশগুলোর অবস্থানের মাঝে একশত ঘর ব্যবধান। ৩২তম স্থানের মালয়েশিয়া এ অঞ্চলের একমাত্র দেশ, যা এনআরআইয়ের সেরা ষাটে আছে। এ অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ দেশই র্যায়ঙ্কিংয়ের নিচের অর্ধাংশে রয়েছে। মঙ্গোলিয়া ৬১তম, শ্রীলঙ্কা ৬৫তম, থাইল্যান্ড ৬৭তম স্থানে। এগুলো থেকে মালয়েশিয়া মোটামুটি ৩০ ঘর এগিয়ে। চীন স্থির আছে আগের ৬২তম স্থানে। অপরদিকে এবার ভারত ছয় ঘর পিছিয়ে নেমেছে ৮৯তম স্থানে। বাংলাদেশ ১০৯তম ও পাকিস্তান ১১২তম স্থানে।
বাংলাদেশ প্রোফাইল
এবার আইসিটি রেডিনেস ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। ভারত ৮৯তম ও পাকিস্তান ১১২তম স্থানে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ছিল ১১৪তম স্থানে, ২০১৪ সালে ১১৯তম স্থানে। লক্ষণীয়, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের রেডিনেস ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থানের যে ওঠানামা, বাস্তবে এর কোনো মূল্য নেই। কারণ, উল্লিখিত এই তিন বছরে আমাদের অবস্থানের কোনো উন্নয়ন বা অবনতি ঘটেনি। কারণ, এই তিন বছরেই আমাদের স্কোর ছিল ৭-এর মধ্যে ৩.২। র্যা ঙ্কিংয়ের যে হেরফের লক্ষ করা যাচ্ছে, এর কারণ অন্যান্য দেশের স্কোর ভ্যালুর উন্নতি বা অবনতির কারণে। তাই ধরে নিতে হবে উল্লিখিত এই তিন বছরে আমাদের আইসিটি রেডিনেসের উন্নতি বা অবনতি কোনোটিই ঘটেনি। তবে পরিসংখ্যানের নানা কৌশলী উপস্থাপনার মাধ্যমে সরকার পক্ষের আইসিটির ঢাকঢোল পেটানোর বিন্দুমাত্র কমতি নেই। আসলে আমরা নিশ্চল দাঁড়িয়ে।
রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রণ পরিবেশের দিক থেকে আমাদের অবস্থান স্বল্প আয়ের দেশগুলোর গড় অবস্থানের তুলনায় খারাপ অবস্থানে আছি। ব্যবসায় ও উদ্ভাবন পরিবেশ বিবেচনায় আমাদের ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোর গড় অবস্থানের সমতুল্য। তবে অবকাঠামোর উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থানে। একইভাবে অ্যাফরডেবিলিটির দিক থেকে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর অবস্থার চেয়ে আমরা ভালো। কিন্তু দক্ষতা, আইসিটির ব্যক্তিগত ব্যবহার, ব্যবসায়িক ব্যবহার, সরকারি পর্যায়ে ব্যবহার, অর্থনীতির ও সমাজের ওপর আইসিটির প্রভাব ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও আমরা রয়ে গেছি স্বল্প আয়ের দেশগুলোর পর্যায়েই- এমনটিই বলা হয়েছে ২০১৫ সালের বিশ্ব আইসিটি রিপোর্টে।
একটি দেশে হালনাগাদ প্রযুক্তি পাওয়ার সুযোগ কতটুকু বিদ্যমান, তা পরিমাপ করার জন্যও একটি অবস্থান তালিকা সংযোজিত হয়েছে আলোচ্য এ রিপোর্টে। এতে ১ থেকে ৭ পর্যন্ত স্কোর ভ্যালুর উল্লেখ রয়েছে। স্কোর ভ্যালু ১ অর্থ হালনাগাদ প্রযুক্তি মোটেই পাওয়া যায় না। আর ৭ অর্থ ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে গড় স্কোর ৪.৯। আমাদের স্কোর এ গড় স্কোরের নিচে- ৪.৩। এ তালিকার শীর্ষে আছে ফিনল্যান্ড এবং নিমণপাদে ১৪৯তম অবস্থানে মিয়ানমার। আর বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম। পাকিস্তান ৮৬তম ও ভারত ১১০তম স্থানে।
একইভাবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের প্রাপ্যতার তালিকায় আমাদের অবস্থান ১১৯তম আর স্কোর ২.৩, যেখানে গড় স্কোর ২.৮। এ ক্ষেত্রে সেরা কাতার। আর অধম বার্কিনা ফাসো, ১৪৫তম স্থানে। ব্যবসায় শুরুর জটিলতার বিষয়টি উল্লেখ আছে এ রিপোর্টে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ৯৯তম, সেখানে পাকিস্তান ও ভারতের অবস্থান যথাক্রমে ৮৬তম ও ১১০তম স্থানে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে একটি ব্যবসায় শুরু করতে সময় লাগে যথাক্রমে ২০ দিন, ১৯ দিন ও ২৮ দিন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কানাডায় একটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একটি ব্যবসায় শুরু করা যায়। এ ক্ষেত্রে কানাডার অবস্থান এক নম্বরে। আর বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে সম্পন্ন করতে হয় যথাক্রমে ৯টি, ১০টি ও ১২টি প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে দেশ তিনটির অবস্থান যথাক্রমে ১০৭তম, ১১৯তম ও ১৩২তম স্থানে।
বাংলাদেশের মোবাইল কভারেজ রেট ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। বাংলাদেশে এই রেট ৯৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ৯২.১ শতাংশ আর ভরতে ৯৩.৬ শতাংশ। একটি দেশে একজন ব্যবহারকারী প্রতি সেকেন্ড কত কিলোবাইট ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ ব্যবহারের সুযোগ পান, সে বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম স্থানে, পাকিস্তান ১১২তম ও ভারত ১১৩তম স্থানে।
বিজ্ঞান ও গণিতে মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে সেরা দেশ সিঙ্গাপুর। এ শিক্ষার মান সবচেয়ে খারাপ দক্ষেণ আফ্রিকায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম, পাকিস্তান ১০৪তম ও ভারত ৬৭তম স্থানে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের নিচে। এমনকি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, নেপাল ও ভুটান আমাদের চেয়ে উন্নত মানের বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে এ দেশগুলোর অবস্থান যথাক্রমে ৮১তম, ৮২তম, ৮৭তম ও ৮৪তম স্থানে।
৩৮১ পৃষ্ঠার আলোচ্য এই সুদীর্ঘ রিপোর্ট এমনই তুলনামূলক অসংখ্য তথ্য-পরিসংখ্যানে ঠাসা। এসবের বিস্তারিত যাওয়ার অবকাশ এখানে একেবারেই নেই।
রিপোর্টটির সারকথা
এক. আইসিটি ক্ষমতা রাখে অর্থনীতি ও সমাজকে পাল্টে দিতে। প্রযুক্তি এ সময়ের অনেক সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। ইনক্লুসিভ গ্রোথ অর্জনে সহায়তা করতে পারে। নেটওয়ার্ক রেডিনেস ইনডেক্স কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের সক্ষমতা পরিমাপ করা হয়েছে। এই রিপোর্টিকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলা একটি নীতি-নির্দেশনা বা পলিসি গাইডলাইন হিসেবে কাজে লাগিয়ে আইসিটির সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। এনআরআই উদঘাটন করেছে- বিশ্বব্যাপী এখনও আইসিটি বিপ্লব ঘটেনি।
দুই. এনআরআই থেকে পাঁচটি মুখ্য বিষয় পাওয়া গেছে : ০১. ডিজিটাল ডিভাইড এখনও বিদ্যমান, ০২. প্রয়োজন দেখা দিয়েছে একটি ইন্টারনেট বিপ্লবের, ০৩. আইসিটি ব্যবহারের বিস্ফোরণে নীতি-নির্ধারকদের বাধা অব্যাহত, ০৪. সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন আইসিটির অবদান ভাগাভাগি করা এবং ০৫. প্রয়োজন আরও উন্নততর ডাটা।
তিন. সরকারি ও বেসরকারি উভয় স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনকে অংশ নিতে হবে ডিজিটাল কনটেন্ট ও সার্ভিস ইকোসিস্টেম ডেভেলপ করা ও টিকিয়ে রাখার কাজে, যা একটি দেশে ডিজিটাল ইনক্লুশন আনে।
চার. ইন্টারনেট শুধু নিছক নতুন নতুন অনলাইন কোম্পানি খোলা নয়, বরং উপাদান সংগ্রহ করা, যা উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ বিকাশে সহায়তা করতে পারে। যারা সিলিকন ভ্যালির সফলতা নকল করতে চেয়েছে, তাদের সফলতা সীমিত। হাইটেক ক্লাশ্চার নকল করার পরিবর্তে সরকারকে নজর দিতে হবে পরিবেশ সৃষ্টির কাজে। এ পরিবেশে থাকবে সহজপ্রাপ্য ও ব্যাপকভাবে ব্যবহারযোগ্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেস।
পাঁচ. যদিও ইন্টারনেটকে গ্রহণ করে নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে ও ইন্টারনেট সার্ভিসের অমিত সম্ভাবনা বিদ্যমান, তবুও বিশ্ব জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত, অনেকের নেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা। ফলে এরা আইসিটির পুরো সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। সরকারগুলোর উচিত বিবেচনায় আনা, কী করে এই জনগোষ্ঠীকে ইন্টারনেট সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তবেই কাটবে ডিজিটাল ডিভাইড।
ছয়. আমাদের সন্তানদের জোগাতে হবে মানসম্পন্ন শিক্ষা। এজন্য চাই শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানো। এটি হতে হবে নীতি-নির্ধারকদের অগ্রাধিকার বিবেচ্য।
সাত. আইসিটি ফর ডি-এর ক্ষেত্র দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এটি বৃহত্তর পরিসরের সুযোগ সৃষ্টি করছে কৃষি, প্রশাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাক্ষেত্রে। কিন্তু একই সাথে আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে মানুষের মান বাড়িয়ে তোলা যায়, যাতে এরা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
আট. দীর্ঘমেয়াদি আইসিটি পরিকল্পনায় নীতি-নির্ধারকদের নজর দিতে হবে পাঁচটি বিষয়ে : ডিজিটাল অবকাঠামো, শিক্ষা, প্রতিযোগিতা, উদ্ভাবন ও বেসরকারি বিনিয়োগ।
নয়. এখনও বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এর অর্থ বিশ্বের ৪৫০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট থেকে দূরে। উন্নয়নশীল বিশ্বের মাত্র ৩২ শতাংশ এবং উন্নত বিশ্বের ৭২ শতাংশ মানুষ পাচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ। আফ্রিকার মাত্র ১৯ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে