চার দিনের প্রাযুক্তিক ঝুটঝামেলার কারণে সৃষ্ট উৎকণ্ঠা আর ভোগান্তি শেষে ২৮ জুন মধ্যরাতের পর একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ফল প্রকাশ করা হয়। ফল প্রকাশের পর নতুন করে অদ্ভুত সব ভোগান্তিতে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। স্মার্ট অ্যাডমিশন সিস্টেম নামের একাদশ শ্রেণির অনলাইন পদ্ধতির ভোগান্তির যাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হওয়ার পর এখন ভিন্ন ধরনের মহাদুর্ভোগের কবলে ভর্তিচ্ছুরা। কারিগরি ত্রুটি আর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে শুরু থেকেই এ নিয়ে ভোগান্তি ও হয়রানি এখন চরমে পৌঁছেছে। অথচ হঠাৎ করে চালু করা এই নতুন পদ্ধতির জন্য পর্যাপ্ত প্রস্ত্ততি ছিল না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। আগে থেকে নেয়া হয়নি সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় হুট করেই নতুন এই পদ্ধতি অনেকটা একগুঁয়েমি করে চাপিয়ে দেয়া হয় ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের ওপর। এ পদ্ধতি চালু করার আগে ভালো করে প্রচারও চালানো হয়নি। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক পদ্ধতিটি ঠিকমতো বুঝেও উঠতে পারেনি। এমনকি শিক্ষকদের কাছেও পদ্ধতিটি ছিল দুর্বোধ্য ও জটিল। এ নিয়ে সময়ে সময়ে যে নির্দেশনা জারি করা হয়, তাও স্পষ্ট ছিল না।
সার্বিকভাবে এবারের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির কথিত স্মার্ট অ্যাডমিশন সিস্টেমটি হয়ে ওঠে পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর। এ কারণে ভর্তির আবেদন থেকে শুরু করে ফল প্রকাশ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পদে পদে বিপাকে পড়তে হয়। অনলাইনে ফল পেতে ভোগান্তি, অনলাইনে ভর্তির ফরম ডাউনলোডে বিড়ম্বনা, সার্ভারের দুঃসহ ধীরগতিসহ নানা কারিগরি দুর্গতিতে পড়ে শিক্ষার্থীরা। ওয়েবসাইটে ঢোকাই যেন যাচ্ছিল না। অনলাইনে কমান্ড দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ফল মেলেনি। উপায়ন্তর না দেখে ফল দেখার জন্য কেউ সশরীরে ছুটে গেছে তাদের দেয়া অপশনের কলেজগুলোতে। কাউকে হয়তো পছন্দের পাঁচটি কলেজেই দৌড়াতে হয়েছে। অনেকে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েও পড়েছে মহাদুর্ভোগে। অনেকে জিপিএ-৫ পেয়েও কোনো কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়নি। আবার জিপিএ-৫ পাওয়া কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়নি তার পছন্দের কোনো কলেজেই। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীকে ভর্তি হতে বলা হয়েছে কমার্স কলেজে, মেয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছে ছেলেদের কলেজে ভর্তির জন্য। ঢাকার কলেজগুলো পছন্দ করা ছাত্রদের ভর্তি হতে বলা হয়েছে ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অচেনা-অজানা কোনো কলেজে।
জিপিএ-৪.৭২ পাওয়া এক শিক্ষার্থীর পছন্দের কলেজ ছিল যথাক্রমে ঢাকার ধানম-- আইডিয়াল কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ফেনী সরকারি কলেজ ও ঢাকার মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ। কিন্তু তাকে ভর্তি হতে বলা হয়েছে ভোলার বোরহান উদ্দিন উপজেলার আবদুল জববার ডিগ্রি কলেজে। এই শিক্ষার্থীর বাবা ছেলের রেজাল্ট দেখে হতবাক। নিজ জেলা ফেনী থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বোর্ডে পৌঁছে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধির কাছে তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া- ‘জানি না-চিনি না কোথাকার কোন কলেজে ছেলেকে ভর্তি করাব। আমি কেনো, বোর্ডও জানে না কোথায় এই কলেজ। আমরা মানুষ, মেশিন না। চাইলেই দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রামেত্ম ছুটে যাওয়া যায় না।’ একজন সরকারি বিজ্ঞান কলেজের ব্যবসায় বিভাগে ৪০০ সিটের বিপরীতে আবেদন করে টিকে যায়। কিন্তু ভর্তি হতে গিয়ে মাথায় হাত। কলেজ কর্তৃপক্ষ থাকে জানায়, এ কলেজের ব্যবসায় বিভাগ দুই বছর আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকার অনেক কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েও ভর্তি হতে পারছে না অনেকে। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে পরে আসন খালি থাকলে অন্যদের ভর্তি করা হবে। ঢাকার একটি নামি-দামি কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীতদের তালিকার প্রথম ৪১ জন্যই অন্য প্রতিষ্ঠানের। তাদের ভর্তি হতে দেয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, নিজেদের শিক্ষার্থীদের ভর্তির পর আসন খালি থাকলে ওই ৪১ জন ভর্তির সুযোগ পাবে। কী অদ্ভুত ব্যাপার? পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ভোগান্তির রকমফের দেখলে রীতিমতো মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা।
প্রযুক্তির আশীর্বাদকে কাজে লাগিয়ে এভাবে হুট করে অপরিকল্পিতভাবে চালু করা অনলাইনে কথিত স্মার্ট অ্যাডমিশন সিস্টেম যে চরম ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীদের ফেলেছে, তা জনমনে প্রযুক্তি সম্পর্কে রীতিমতো এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি করবে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক হতে হবে বৈ কি।