লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
হিটলার এ. হালিম
মোট লেখা:২২
লেখা সম্পর্কিত
দেশে নেই কোনো আইসিটি ইনকিউবেটর
দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে নতুন উদ্যোক্তা আসবেন, তাদের আসার জন্য সব ধরনের আয়োজন নিয়ে উপস্থিত থাকবেন সেই অঙ্গনের কর্তা-ব্যক্তিরা, তাদের কী লাগবে না লাগবে সেদিকে নজর দেবেন সবাই। কিন্তু এর কিছুই নেই। অথচ এত কিছু না থাকার পরও দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণেরাই।
কম মূল্যে জায়গা, উচ্চগতির ইন্টারনেট, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ- এই তিনটি থাকলে নবীন উদ্যোক্তাদের আর কিছু লাগে না। কিন্তু নবীনেরা হালে এটুকুও পাচ্ছে না। যদিও তাদের জন্য সব আয়োজন ছিল। কিন্তু সেই আয়োজন তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়েছে বা সেই সুযোগ পাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অন্তত তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নবীনদের বিকাশের জন্য দেশে অবশ্যই আইসিটি ইনকিউবেটর থাকতে হবে। কিন্তু তা কি দেশে আছে?
দেশে কোনো আইসিটি ইনকিউবেটর নেই। যা ছিল তার নাম বদলে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক (এসটিপি-১) করা হয়েছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তিতে নবীন উদ্যোক্তাদের আগমন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ছে, উদ্যোক্তারাও আসতে চাইছেন, কিন্তু তাদের ব্যবসায়ের বিকাশে নেই কোনো ইনকিউবেটর। দীর্ঘদিন ধরেই তথ্যপ্রযুক্তির উদ্যোক্তারা এর অভাব অনুভব করছেন, কিন্তু সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে লক্ষণীয় কোনো উদ্যোগের খবরও জানা যায়নি। প্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন, সারাদেশে বেশ জোরেশোরে একাধিক হাইটেক পার্ক তৈরির কথা বলা হচ্ছে। এটা তথ্যপ্রযুক্তির জন্য বিরাট পাওয়া, তবে এর পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে দেশে আইসিটি ইনকিউবেটর গড়ে তুলতে হবে, যেখান থেকে ছোট উদ্যোগগুলো বড় হবে। আইসিটি ইনকিউবেটরে ‘নার্সিং’ হয়ে তৈরি হবে আরেকটি বিডিজবস ডটকম, এখনি ডটকম, আজকের ডিলের মতো প্রতিষ্ঠান।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিডিবিএল ভবনে গড়ে তোলা হয়েছিল দেশের প্রথম আইসিটি ইনকিউবেটর। ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ইনকিউবেটরকে ‘সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক-১’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন সে সময়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা ফারুক মোহাম্মদ। ওইদিন বেসিস আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ ঘোষণা দেন। ‘সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেন, আইসিটি ইনকিউবেটরকে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক (এসটিপি-১) হিসেবে ঘোষণার বিষয়ে ইতোমধ্যেই স্টিয়ারিং কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় একে এসটিপি-১ ঘোষণা করা হলো। সেদিন সারাদেশে আরও ১০টি এসটিপি স্থাপনের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
দেশের সফটওয়্যার ও সেবা খাতের উদ্যোক্তাদের ‘অবকাঠামোগত’ সুবিধা দিতে গড়ে তোলা আইসিটি ইনকিউবেটরকে এক ঘোষণাতেই সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক-১ করার ফলে এ খাতে ইনকিউবেশনের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির পথ বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো ইনকিউবেটর তৈরির উদ্যোগও নেয়া হয়নি।
সফটওয়্যার ও সেবা খাতের নবীন উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে বিডিবিএল ভবনের ৬০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে আইসিটি ইনকিউবেটর গড়ে তোলে সরকার। ২০০২ সালে গড়ে ওঠা ইনকিউবেটরে ৪৮টি সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, কম দামে উচ্চগতির ইন্টারনেট, কম ভাড়া সুবিধা ছাড়াও আরও অনেক ধরনের সুবিধা ছিল ইনকিউবেটরে।
দীর্ঘদিন হয়ে গেলেও ইনকিউবেটরের শুরুতে চালু প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অন্য জায়গায় চলে গিয়ে নতুনদের সেখানে কাজ করার সুযোগ করে না দিয়ে ইনকিউবেটরে থেকে যায়। অভিযোগ ছিল, শুরু থেকে ইনকিউবেটরে ঠাঁই পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসায় চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেই আইসিটি ইনকিউবেটরকে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক করা হয়েছে। সফটওয়্যার ও সেবা খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেসিসের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা দীর্ঘদিন ধরে ইনকিউবেটরে থেকে তাদের ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অভিযোগ, বর্তমান সরকার গত মেয়াদে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল দেশে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণের। নানা জটিলতায় হাইটেক পার্ক (কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক) নির্মাণ না হওয়া এবং একটিও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক চালু করতে না পারার ‘ব্যর্থতা’ ঢাকতে তড়িঘড়ি করে আইসিটি ইনকিউবেটরকে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার।
সে সময় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং বর্তমান সভাপতি শামীম আহসান বলেন, ঢাকার মহাখালীর কড়াইল বসিত্ম এলাকায় সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে কৌশল অবলম্বন করে এগোনো হচ্ছে। শিগগিরই এ বিষয়ে সমেত্মাষজনক অগ্রগতি হবে।
সম্প্রতি এ বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারিভাবে অনেক কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাইটেক পার্ক তৈরি করা হচ্ছে। আইসিটি ইনকিউবেটরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আইসিটি ইনকিউবেটর তৈরির বিষয়ে এ মুহূর্তে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনার কথা তার জানা নেই।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জববার বলেন, জন্মের সময় এর নামটা ছিল ইনকিউবেটর বটে, তবে প্রকৃত অর্থে দেশে ইনকিউবেটরের জন্মই হয়নি। একটি ভবন রেডি ছিল। সরকার মাত্র ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির উদ্যোগ বিকাশের জন্য কিছু অবকাঠামোগত সুবিধা ছিল। পরে আরও অনেক কিছু করার কথা ছিল ওই ইনকিউবেটরে, কিন্তু সেসবের কিছুই করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, শুরুতে যারা ইনকিউবেটরে ঢুকেছিল তারা আর বের হয়নি। এখন তাদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক। কিন্তু রয়ে গেছে ওখানেই। ফলে ওটা তার প্রকৃত চরিত্র হারিয়েছিল।
আইসিটি ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইনকিউবেটরের প্রকৃত আদর্শ তৈরি করা দরকার। তরুণদের সব কিছু আছে। তাদের দরকার অবকাঠামোগত সুবিধা। কারণ তাদের সামর্থ্য নেই। এটা ব্যক্তি উদ্যোগে করা কঠিন। সরকারকেই এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
এর পাশাপাশি মোস্তাফা জববার আশার কথাও শোনালেন। বলেন, দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে ছোট ছোট কিছু ইনকিউবেটর হচ্ছে। ঢাকার পান্থপথসহ দুয়েকটি জায়গায় ব্যক্তি উদ্যোগে ছোট ছোট আকারে কাজের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সেসব জায়গায় একটি চেয়ার ও একটি টেবিল দিয়ে নবীন উদ্যোক্তাদের বলা হচ্ছে, ‘এখানে বস। কাজ কর। যা আয় হবে তার ২৫ শতাংশ আমাদের দিতে হবে। আর কিছু দিতে হবে না।’ তরুণেরা দিব্যি সেখানে ল্যাপটপ-কমপিউটার নিয়ে বসে পড়ছে।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এমএ হাকিম বলেন, দেশে অবশ্যই আইসিটি ইনকিউবেটর প্রয়োজন। ইনকিউবেটর ছাড়া নতুন উদ্যোক্তা উঠে আসতে পারবে না। তিনি মনে করেন, যে উদ্দেশ্যে কারওয়ান বাজারে ইনকিউবেটর তৈরি করা হয়েছিল তা ‘ফুলফিল’ হয়নি। এ সময় নবীন বা তরুণদের জন্য আরও বেশি বেশি ইনকিউবেটর প্রয়োজন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিনিয়োগ বাড়ছে, উদ্যোক্তারা আসতে চান, কিন্তু সেই পথ আটকে আছে ইনকিউবেটর না থাকায়
ফিডব্যাক : hitlarhalim@yahoo.com