লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
একজন হানিফউদ্দিন মিয়ার স্মৃতি
এই সেদিনও কেউ জানত না বাংলাদেশের প্রথম কমপিউটার প্রোগ্রামার কে? কার হাত ধরে ৫০ বছর আগে আমরা কমপিউটারের যুগে পা ফেলেছিলাম, সেটি বিস্তৃতপ্রায় অতীত। অতি সম্প্রতি বিষয়টি আমাদের মিডিয়ার নজরে পড়েছে। সেটিও একটি সম্মাননা পাওয়ার পর। এই বিষয়টি ঢাকার একটি দৈনিকে এভাবে বলা হয়েছে-‘দেশের প্রথম কমপিউটার প্রোগ্রামার হানিফউদ্দিন মিয়াকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছে আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি। সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো-২০১৫ শীর্ষক মেলার সমাপনী আয়োজনে হানিফউদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়।’ সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো-২০১৫ শীর্ষক মেলার সমাপনী আয়োজনে হানিফউদ্দিন মিয়ার সন্তান এবং স্ত্রীর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পত্রিকাটি আরও লিখেছে-জানা গেছে, মূলত তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জববারের প্রচেষ্টাতেই তাকে পুরস্কৃত করেছে আইসিটি বিভাগ ও বিসিএস। বাংলাদেশের প্রথম কমপিউটারটি আসে ১৯৬৪ সালে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। সেটি ছিল আইবিএম মেইনফ্রেম ১৬২০ কমপিউটার। বৃহদাকৃতির ওই কমপিউটারটি স্থাপন করতে দুটি বড় রুম ব্যবহার করতে হয়েছিল। ঢাউস আকারের সেই কমপিউটারটিকে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে স্থাপন করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ডিজিটাল মেইনফ্রেম কমপিউটার। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কমপিউটার আইবিএম ১৬২০ তার হাত ধরেই বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে (টিএসসি সংলগ্ন) স্থাপিত হয়। তবে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কমপিউটারটি কেনো স্থাপিত হয়েছিল তা জানা প্রয়োজন। মোস্তাফা জববার জানান, পাকিস্তান সরকার তখন কমপিউটারটি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপনের পরিকল্পনা করে। তবে হানিফউদ্দিন মিয়া ছাড়া অন্য কেউ এ কমপিউটার তদারকি এবং পরিচালনার যোগ্য ছিলেন না। এজন্য সরকার হানিফউদ্দিন মিয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার আহবান জানাল। তবে ওই আহবান প্রত্যাখ্যান করেন হানিফউদ্দিন। ফলে কমপিউটারটি ঢাকার আণবিক কমিশনে স্থাপনে অনেকটা বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।
বাংলাদেশের গৌরব, নাটোরের এই কৃতী সন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলশিক্ষক পিতা রজব আলী তালুকদারের দুই পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। সংসারে অভাব না থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য জায়গির থাকতে হয় তাকে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালে কৃতিত্বের সাথে বিএসসিতেও প্রথম বিভাগ লাভ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএসসি পরীক্ষায় ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণিতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশন, চেকোসেস্নাভাক একাডেমি অব সায়েন্স, প্রাগ থেকে অ্যানালগ কমপিউটার টেকনিক এবং ডিজিটাল কমপিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৬৪ সালে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স কমপিউটার প্রোগ্রামিং, অপারেশন রিসার্চে এমআইটি (যুক্তরাষ্ট্র) কমপিউটার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭৫ সালে আইবিএম রিসার্চ সেন্টার লন্ডন থেকে অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে ট্রেনিং করেন। তারপর তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় (আইএসিই) প্রোগ্রামার অ্যানালিস্ট হিসেবে অ্যানালাইসিস, ডিজাইন, সফটওয়্যার ইমপ্লিমেশন অব কমপিউটার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন শিক্ষকতা করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অঙ্কশাস্ত্র ও কমপিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ফরিদা বেগম, এক পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের জনক দেশের প্রথম কমপিউটার প্রোগ্রামার হানিফউদ্দিন উদ্দিন মিয়া। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের এই কৃতী সন্তান বাংলাদেশ অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের কমপিউটার সার্ভিস ডিভিশনের ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় কমপিউটার সায়েন্স ও নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস থাকা সত্ত্বেও শিল্প-সাহিত্যসহ আরও নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার ছিল অপরিসীম আগ্রহ। ২০০৭ সালের ১১ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তবে মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণিতশাস্ত্র ও কমপিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ গণিত সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশ কমপিউটার বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে মোহাম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়ার নাম গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
আমি ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে আসা প্রথম কমপিউটার নিয়ে আমার প্রথম টিভি অনুষ্ঠানটি সাজাই। তখনই জানা গেল কমপিউটারটি সাভারের পরমাণু শক্তি কমিশনে আছে। আমি চাইলাম, সেই কমপিউটার যিনি প্রথম ব্যবহার করেন তার একটি সাক্ষাৎকার নেব।
সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল বাংলাদেশের কমপিউটারের ইতিহাসে এক বড় ধরনের মাইলফলক। কারণ, হানিফউদ্দিন সেদিন বলেছিলেন এ দেশে কমপিউটার আসার কথা। আমি অবাক হয়েছিলাম এটি জেনে যে, তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের লাহোরে যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা কমপিউটারটি পাই।
এই বছরের শুরুতে আমি সাভারের পিএটিসিতে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি ব্যাচের ক্লাস নিতে গেলে সেখানে আমি হানিফউদ্দিনের কথা বলি। ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসার পর এক তরুণ এসে জানাল তার বাড়ি হুলহুলিয়া গ্রামে, যে গ্রামে হানিফউদ্দিন জন্ম নিয়েছেন এবং যেখানে তার কবরও আছে। তিনি তার ছেলে শরীফ হাসান সুজার ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা দিলেন।
এবার আইসিটি ডিভিশন ও বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি যখন বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপোর আয়োজন করে তখন কোনো এক কারণে আমি সেমিনার কমিটির চেয়ারম্যান হই। সেই সুবাদে এই ডিভিশনের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের সাথে কথা হয়। পলককে হানিফউদ্দিনের কথা উচ্চারণ করার সাথে সাথে তিনি এতে সম্মতি দেন। এই ডিভিশনের কর্মকর্তারা আমার ঘাড়ে একটি বাড়তি দায়িত্ব দিলেন- তার পরিবারকে খুঁজে বের করার। আমি সেই কাজটিও করলাম। জানা গেল, তার স্ত্রী মারাত্মকভাবে অসুস্থ। সম্মাননা দেয়ার আগের রাতে আমি সেই মহিলার সাথে কথা বললাম। তিনি আসতে রাজি হননি। কিন্তু একরকম জোর করেই আমি তাকে রাজি করালাম এবং সেদিন ১৭ জুন ২০১৫ সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে শুধু তিনি আসেননি তার তৃতীয় প্রজন্ম ছেলের ছেলে নাতি ইরফানকেও নিয়ে এলেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক ঘটনা
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com