লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
প্রথম ব্রেইন-টু-ব্রেইন ই-মেইল
আমরা কি একদিন আমাদের ব্রেইন বা মসিত্মষ্ককে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত করতে পারব? সম্প্রতি প্রথমবারের মতো দাবি শোনা যাচ্ছে, দু’টি মনের মধ্যে তথা মসিত্মষ্কের মধ্যে অনলাইন মেসেজ পাঠানো সম্ভব হয়েছে। সে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেই এই প্রতিবেদন।
একটি ইন্টারনেট কানেকশন আমাদের যোগাযোগকে দ্রুততর করে তোলে। আজকের দিনে আমরা যেসব ডিভাইস প্রতিনিয়ত বহন করি, এর বেশিরভাগই আমাদেরকে অনলাইনে থাকতে সাহায্য করে। কোনো কোনো সময় মনে হয়, আমরা এখন তাৎক্ষণিক অনলাইন যোগাযোগের দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছি।
হতে পারে আজকের প্রায়-তাৎক্ষণিক অনলাইন যোগাযোগকে আরও গতিশীল করে একদম তাৎক্ষণিক করে তোলার একটি উপায় হচ্ছে ওয়েবের মাধ্যমে সরাসরি ব্রেইন-টু-ব্রেইন যোগাযোগ গড়ে তোলা। যদি ব্রেইন বা মসিত্মষ্কগুলো সরাসরি সংযুক্ত থাকত, তবে বিরক্তিকর টাইপ করে মেসেজ বা তথ্য পাঠানোর ঝামেলারও দরকার হতো না। তখন আমরা শুধু একটি ধারণা বা বিষয় চিন্তা করতাম, আর তাৎক্ষণিকভাবে তা বন্ধুটির মসিত্মষ্কে পাঠিয়ে দিতে পারতাম। বন্ধুটির অবস্থান হতে পারত আমার কক্ষে কিংবা আমার কাছ থেকে বহুদূরে- অন্য কোনো দেশে। আমরা এখনও সে জায়গায় পৌঁছাইনি। অবশ্য একটি সাম্প্রতিক পরীক্ষায় এ ব্যাপারে প্রথম একটি উদ্যোগ পরিলক্ষেত হয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে, হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা দু’জনের মধ্যে সরাসরি ব্রেইন-টু-ব্রেইন ইন্টারনেট কানেকশন দেয়া সম্ভব হয়েছে। এ কাজটি এ প্রকল্পের গবেষক ও বার্সেলোনাভিত্তিক স্টারল্যাবের সিইও গিউলিও রুফিনির দেয়া ধারণার একটি প্রমাণমাত্র। প্রকাশিত খবর মতে, এই গবেষক দলের সদস্যরা একজনের মসিত্মষ্ক থেকে আরেকজনের মসিত্মষ্কে কোনো শব্দ (ওয়ার্ড), চিন্তা (থট) বা আবেগ (ইমোশন) পাঠাননি। বরং এর বদলে তারা যা করেছেন, তা এর চেয়ে আরও সরল।
ব্রেইনওয়েভ ডিটেক্ট করার প্রযুক্তি সরল মেসেজ ব্রডকাস্ট বা সম্প্রচার করার কাজে ব্যববহার করা যাবে। কীভাবে এটি কাজ করে তাই উল্লেখ করছি। যে ব্যক্তির ওপর তা প্রয়োগ করা হয়েছে, তিনি ছিলেন ভারতের কেরালায়। তার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে ব্রেইন কমপিউটার ইন্টারফেস। এটি মাথার খুলিতে প্রবাহিত হওয়া ব্রেইনওয়েভ রেকর্ড করে। এই ব্যক্তিকে তখন নির্দেশ দেয়া হয় এমনটি কল্পনা করতে যে, এরা চলাফেরা করছেন তাদের হাত বা পা দিয়ে। যদি তিনি পা দিয়ে চলার কথা ভাবেন, তবে কমপিউটারে রেকর্ড হয় শূন্য (০)। আর যদি হাত দিয়ে চলার কথা ভাবেন, তবে কমপিউটারে রেকর্ড হয় ১ (এক)।
এই শূন্য ও একের ধারা তখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠানো হয় রিসিভারে। আর এই রিসিভার ছিলেন একজন মানুষ, যিনি ছিলেন ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে। তার সাথে সংযুক্ত ছিল একটি টিএমএস রোবট। এ রোবট ডিজাইন করা হয়েছিল ব্রেইনে স্ট্রং ইলেকট্রিক পালস সরবরাহের জন্য। যখন প্রেরক ভেবেছিলেন তিনি হাত দিয়ে চলছেন, তখন টিএমএস রোবট রিসিভার বা গ্রাহকের ব্রেইনে এমনভাবে আঘাত করে যাতে তিনি আলো দেখতে পান, যদিও তার চোখ তখন বন্ধ ছিল। রিসিভার কোনো আলো দেখতে পেতেন না, যখন কেরালায় থাকা প্রেরক ভাবতেন তিনি পা দিয়ে হাঁটছেন।
মেসেজকে অধিকতর অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য গবেষকেরা নিয়ে এসেছেন একটি সাইফার (পযরঢ়যবৎ) : ০ ও ১ (হাত ও পা)-এর ধারা। রিসিভারকেও এই সাইপার শেখানো হয়। ফলে লাইট সিগন্যাল ডিকোড করে বুঝতে পারেন কোন শব্দটি প্রেরক পাঠালেন।
গভীর মনোযোগ
বিষয়টি খুব সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি পর্যায়ে আছে জটিলতা। প্রেরককে চরমভাবে গভীর মনোযোগ দিতে হয়েছে। মনোযোগটা শুধু থাকতে হয়েছে পা দিয়ে চলাচল করছেন, না হাত দিয়ে, এর মধ্যে। এর বাইরে কোনো কর্মকা- চললে সিগন্যালে গোলমাল দেখা দিতে পারে। তখন সঠিক মেসেজ পাওয়া কঠিন হতে পারে। আসলে প্রেরককে ভালোভাবে প্রশিক্ষেত করে তুলতে হবে, যাতে তিনি এ কাজটি যথাযথভাবে করতে পারেন।
পুরো প্রক্রিয়াটি কোনোভাবেই দ্রুত নয়। গবেষকেরা অনুমান করেছেন, ব্রেইন-টু-ব্রেইন ট্র্যান্সমিশন স্পিড ছিল প্রতি মিনিটে প্রায় ২ বিট (০ ও ১)। অতএব একজনের মসিত্মষ্ক থেকে আরেকজনের মসিত্মষ্কে এমনকি একটি সরল মেসেজ পেতেও একটু সময় নেবে। কিন্তু যখন ব্রেইন-টু-ব্রেইন মেসেজ পাঠানো গেছে এবং এটি কাজ করেছে, তখন এটি বিস্ময়কর বলে অভিহিত করেছেন রুফিনি। তিনি বলেছেন : ‘আমি বলতে চাই, আপনি এ পরীক্ষাটি দেখতে পারেন দুইভাবে। একদিকে এটি খুবই টেকনিক্যাল এবং এটি ধারণাটির নগণ্য প্রমাণ। অপরদিকে এই প্রথমবাবের মতো এ কাজটি সম্পন্ন করা হলো। অতএব, এটি কিছুটা হলেও একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমি ধরে নিলাম, এটি খুবই বিস্ময়কর। মোটের ওপর এ নিয়ে ১০ বছরের চিন্তাভাবনা ও তা করার উপায় খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি ভালো অনুভূতির ব্যাপার।’
শুধুই কি চমকবাজি?
আসলে এখানে একটা বিতর্ক আছে- এই পরীক্ষাটি কি আসলে এই প্রথমবার উপস্থাপিত হলো? গত বছর হার্ভার্ডের একটি দলের গবেষকরা একজন মানুষের মসিত্মষ্কে জুড়ে দেন একটি ইঁদুরের লেজ। আর এই লোকটি শুধু তার ভাবনার মাধ্যমে এই লেজটিতে কাঁপন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তা ছাড়া গত বছর ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক ব্রেইন-টু-ব্রেইন ইন্টারফেস তৈরি করতে সক্ষম হন, যেখানে একজন প্রেরক একজন গ্রাহকের মসিত্মষ্কের বহিরাবরণের মোটর করটেক্সের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হন। এর ফলে তিনি এমন মেসেজ পাঠানোর সুযোগ পান, যাতে করে গ্রাহক অবচেতনভাবে একটি কিবোর্ডে আঘাত করেন। এর ফলে একজন বিজ্ঞানী আইইইই স্পেকট্রাম পত্রিকাকে জানিয়েছেন- তিনি মনে করেন, রুফিনির কাজটি ছিল একটি ‘প্রেটি মাচ অ্যা স্ট্যান্ট’ এবং এটি ছিল এমন, যার ‘সবটুকুই আগেই দেখানো হয়েছে’। কিন্তু রুফিনির পরীক্ষা নিশ্চিতভাবেই প্রথম, যাতে একটি বড় দূরত্বে ব্রেইন-টু-ব্রেইন কানেকশনের চেষ্টা চালানো হয়। আর এই প্রথমবার সচেতনভাবে সিগন্যাল ইন্টারপ্রিট করা সম্ভব হয়েছে।
রুফিনির আরও স্বপ্ন আছে। তিনি মসিত্মষ্ক থেকে ট্র্যান্সমিট করতে চান ফিলিংস, সেনসেশন ও পুরো ভাবনাচিন্তা। তিনি বলেন, ‘টেকনোলজি এখন বেশ সীমিত, কিন্তু একদিন তা খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। একদিন আমরা মসিত্মষ্ক থেকে মসিত্মষ্কে মৌখিক যোগাযোগ পাঠাতে সক্ষম হব।
চিন্তাভাবনা পুরোপুরিভাবে পাঠাতে পারার আগে গবেষক দলের সদস্যদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে এই ০ ও ১-এর চেয়ে আরও বেশি জটিল কিছু ট্র্যান্সমিট করা। এর সাথে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে বহু দিকে ব্রেইনকে আরও উদ্দীপ্ত করার কাজটি এবং লাইট সিগন্যাল থেকে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়া।
অবশ্য এ ধরনের ক্ষমতা বিপদও নিয়ে আসবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো কিছু পাঠালে তা হ্যাকড বা ট্র্যাকড হতে পারে। কোনো ব্যক্তির মসিত্মষ্কে সরাসরি মেসেজ পাঠানো এক ভয়াবহ ধারণা হতে পারে। এর ব্যবহার একদিন ব্যাপক নেতিবাচকভাবে চলতে পারে। আপনি অন্যের মসিত্মষ্কের মোট করটেক্স নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পারেন। সে যা-ই হোক, গবেষকেরা বলছেন একদিন হয়তো এমন সময় আসবে, যেদিন আপনি শুধু একটি মেসেজ নয়, এমনটি আর্টিকল পর্যন্ত ব্রে্ইন-টু-ব্রেইন ট্র্যান্সমিট করতে পারবেন