• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > কেমন ছিল বাংলাদেশের বিগত প্রযুক্তিবর্ষ
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: ইমদাদুল হক
মোট লেখা:৬২
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৫ - জানুয়ারী
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
আইসিটি
তথ্যসূত্র:
রির্পোট
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
কেমন ছিল বাংলাদেশের বিগত প্রযুক্তিবর্ষ
বিদায় নিলো আরও একটি বছর। বছর সায়াহ্নে সেই হিসাব মিলিয়েই দেখতে চাই প্রযুক্তিতে আমরা কোন দিকে হাঁটছি। পথের বাঁকে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কেমন ছিল প্রযুক্তির ঘটনাবহুল ২০১৪? কী পেলাম এই সময়টুকুতে? প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই স্মৃতি আমাদের গন্তব্যকে চিনিয়ে দেবে নিশ্চয়। এ নিয়ে লিখেছেন ইমদাদুল হক
এ বছরেই দেশে কমপিউটার ব্যবহারের সুবর্ণজয়মত্মী পালন করেছি আমরা। ই-বাণিজ্য সংস্কৃতি নাগরিক জীবন থেকে ছড়িয়েছে গ্রামীণ জনপদে। অনলাইনে আয়-রোজগারে মুক্তপেশা ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যক্তি-উদ্যোগ সম্প্রসারিত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গনে। সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি খাত হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই খাতে শুরু হয়েছে বিদেশী বিনিয়োগ।
বিদায়ী বছরের শুরুতে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্প ঝা-াবাহী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রথম মেয়াদের প্রতিশ্রুত হাইটেক পার্ক প্রকল্প, সফটওয়্যার পার্ক বিনির্মাণ, ডিজিটাল প্রশাসন ও ডিজিটাল জনসেবা বাস্তবায়নের অপূর্ণতা, উড়ন্ত ‘দোয়েল’ ল্যাপটপের ডানা ভেঙে যাওয়া, স্থানীয় অফিস স্থাপনে ইন্টারনেট দৈত্য গুগলের পিছুটান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে বিলম্ব, কর ভারে বিটিআরসি, টেলিকম অপারেটর ও প্রযুক্তিপণ্য এবং সেবাদানকারীদের আক্ষেপের মধ্য দিয়ে যথারীতি আমরা স্বাগত জানাচ্ছি ২০১৫ সালকে।
তবে এতসব অপূর্ণতার মধ্য দিয়েই দেশের তরুণ প্রজন্মের নিত্যনতুন উদ্ভাবন প্রচেষ্টা বছরজুড়েই আলোচিত থেকেছে। বছরজুড়ে প্রাপ্ত অর্জনের মধ্যে মোট পাঁচ বিভাগের তিনটিতেই ‘উইটসা গ্লোবাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ পায় বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে পাবলিক সেক্টরে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, মোবাইল এক্সিলেন্স ক্যাটাগরিতে বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন এবং মেরিট উইনার হিসেবে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সম্মাননা অর্জন করে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অগ্রগতি ও শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখার জন্য জাতিসংঘের ‘সাউথ সাউথ কো-অপারেশন ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করে অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন তথা এটুআই প্রকল্প। বিপুল ভোটে দ্বিতীয় মেয়াদে আইটিইউর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তথা বিটিআরসি। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ‘বাংলা ব্রেইল’, ‘ইউমেন চ্যাপ্টার’ ও ‘জিরো টু ইনফিনিটি’র বেস্ট অব ব্লগ প্রাপ্তি, বুয়েট ইমাজিনেরিয়ামের মাইক্রোসফট ইমাজিন কাপ জয়, স্বস্তি ও কৃষি জিজ্ঞাসার এমবিলিয়নথ সম্মাননা লাভ ইত্যাদি অনেক অর্জন রয়েছে বিদায়ী বছরে।
বছরের শুরুতেই দেশে বসে প্রোটোটাইপ ড্রোন তৈরি রীতিমতো প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। কমপিউটারকে বাংলা হরফের প্রতিলিপি পাঠে টিম ইঞ্জিন উদ্ভাবিত ‘ডিজিটাল পুঁথি’র অন্তরালেই ক্ষুদ্র উদ্যোগে প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের চিত্র প্রকাশ করেছে প্রত্যেক বাংলাভাষী কাছেই। আর শেষ দিকটায় আমরা পরিচিত হই সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় গ-- পেরিয়ে আমাদের তরুণ উদ্ভাবকদের ‘মানবগাড়ি’র মতো রোবট তৈরির সাথে। বাংলা ভাষায় কমপিউটিং শেখার আয়োজন চা-স্ক্রিপ্ট কিংবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ই-ব্রেইলের মতো গস্নাভস তৈরি করে ডিজিটাল সাম্য তৈরির নমুনা। স্বপ্নবাজ টেক-হবিস্টদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশ প্রতিনিধিত্ব করে দিকে দিকে উড়িয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। প্রথমবারের মতো ঢাকায় ১১ হাজার উদ্যোক্তা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার সম্মেলন। অভিষেকের বর্ষপূর্তিতে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই থ্রিজি মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় এসেছে। ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি। ই-তথ্যসেবা থেকে শুরু করে লার্নিং-আর্নিং প্রকল্প ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে ‘ক্লিক’ বাণিজ্যের ধূম্রজাল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। চলতি বছর থেকেই প্রযুক্তিপণ্য ও সেবা রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে সফটওয়্যার নির্মাতাদের সংগঠন বেসিস। ‘ওয়ান বাংলাদেশ’ রূপকল্পের মাঝি বেসিস সভাপতি শামীম আহসান বললেন, ২০১৪ সালের মধ্যে আমি মোটা দাগে তিনটি সফলতা ও তিনটি ব্যর্থতার ছবি দেখতে পাই। এর মধ্যে হাইটেক পার্ক, জনতা টাওয়ার ও দোয়েল প্রকল্পকেই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলে মনে করি। আর সফলতার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড সম্মেলন শুরু করা, বিদেশী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং এলআইসিটি ও এডিবি প্রকল্পের আওতায় বিআইটিএম থেকে প্রায় ৫০ হাজার তরুণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি। বিদেশী বিনিয়োগ কাজে লাগিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রযুক্তি ছড়িয়ে যাবে আগামী বছরে- এমনটাই দেখতে চান শামীম আহসান।
বিদায়ী বছরের ২৩ নভেম্বর আমরা হারিয়েছি বায়ুচালিত মোটরসাইকেল উদ্ভাবক হাফেজ মো: নুরুজ্জামানকে। স্বপ্নপূরণ না হতেই অপরাহ্ণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জের সোনারামপুর কলেজের কাছে প্রাইভেট কার ও ট্রাকের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হওয়ার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আধুনিক হাসপাতালে নেয়ার পথে অঙ্কুরেই ঝরে পড়ে প্রযুক্তি দুনিয়ার সম্ভাবনাময় এই কুঁড়ি। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি গ্রামের কৃষক মো: সৈয়দ আলী ও মোছাম্মৎ রোকেয়া বেগমের ছয় সমত্মানের মধ্যে সবার ছোট ২২ বছরের তরুণ উদ্ভাবক হাফেজ মো: নুরুজ্জামান ছোটবেলা থেকেই বেড়ে ওঠেন আবিষ্কারের নেশায়। ২০১১ সাল থেকে বাতাসচালিত মোটরসাইকেল তৈরির কাজ শুরু করেন। টানা দুই বছর সাধনার পর তিনি এটি তৈরিতে সক্ষম হন। গত ১০ মার্চ হবিগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে নুরুজ্জামানের তৈরি বায়ুচালিত মোটরসাইকেলের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তার গবেষণালব্ধ বাতাসচালিত মোটরসাইকেল উৎপাদন করে স্বল্পমূল্যে এ দেশের মানুষের কল্যাণে বাজারজাত করতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন অকালে হারিয়ে যাওয়া এই উদ্ভাবক।
এর বাইরে বিদায়ী বছরজুড়ে অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি আইটি হ্যাকাথন জানিয়ে দিয়েছে শ্রমজীবীর এই দেশে উদ্ভাবক আর উদ্যোক্তারাও কম যান না। মোবাইল অ্যাপস উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, তরুণ প্রযুক্তিবিদদের নিয়মিত নিত্য-নতুন উদ্ভাবন, সরকারি পর্যায়ে তথ্য-সেবাকেন্দ্রের সম্প্রসারণ, জাতীয় তথ্যবাতায়ন প্রকাশ ইত্যাদি নানা কাজ। একই সাথে হ্যাকিং এবং সাইবার অপরাধ নিয়েও বছরটি ছিল বেশ আলোচিত। সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া ইউটিউব খুলে দেয়া হলেও সমালোচনা হয়েছে অনলাইন নীতিমালা প্রণীত আইসিটি আইনের নতুন সংশোধন ও এই আইনের প্রয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার দৃশ্যমানতা এবং অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়া। বছরজুড়ে আলোচিত হয়েছে আইসিটি আইনের ব্যবহার নিয়ে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত তিনটি প্রতিবেদনে প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অর্জনকে মস্নান করেছে। এর মধ্যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইনফরমেশন টেকনোলজি রিপোর্ট-২০১৪’ অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে পাঁচ ধাপ পিছিয়ে ১৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১১৯তম। দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা, আইসিটি, উদ্ভাবন এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক সূচকের তলানিতে ঠাঁই হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মূল্যায়নে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ‘থ্রাস্ট সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নজরে আনার পরও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কর গুনতে হচ্ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন (আইটিআইএফ)। প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে ‘তথ্যপ্রযুক্তি সেবা ও পণ্য বিক্রি’ উভয় ক্ষেত্রেই করারোপে বিশ্বের ১২৫টি দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
এছাড়া দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা, আইসিটি, উদ্ভাবন এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক সূচকে একেবারেই নিচের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান বলে মূল্যায়ন করেছে এডিবি। এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় আইসিটি খাতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩তম। বাংলাদেশের পরে আছে কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার। এ খাতে দক্ষিণ এশিয়ার গড় মান ৪ দশমিক ২৮। আর বাংলাদেশের সূচক মান ১ দশমিক শূন্য ১। একইভাবে উদ্ভাবন ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি- এই দুই খাতেই বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম এবং দুটি খাতেই বাংলাদেশের পেছনে আছে মিয়ানমার। উদ্ভাবন খাতে দক্ষিণ এশিয়ার গড় মান ৪ দশমিক ৫০, আর বাংলাদেশের মান ১ দশমিক ৬৯। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার গড় মান ৪ দশমিক ৩৯, আর বাংলাদেশের মান ১ দশমিক ৪৯।
সর্বশেষ প্রকাশিত ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইটিআইএফ প্রতিবেদন বলছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কর আদায় করা হচ্ছে বাংলাদেশে। তথ্যপ্রযুক্তি সেবা এবং পণ্য বিক্রি- উভয় ক্ষেত্রেই করারোপে বিশ্বে শীর্ষস্থানে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন মতে, ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সবচেয়ে বেশি করারোপ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্তর মিলিয়ে প্রকৃত মূল্যের ওপর গড়ে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ কর আদায় করা হচ্ছে। এই করহার তথ্যপ্রযুক্তি খাতে করারোপে দ্বিতীয় স্থানে থাকা তুরস্কের করহারের চেয়ে ৫৯ শতাংশ বেশি এবং প্রতিবেশী ভারতের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি। তুরস্কে এই খাতে করহার ৩৮ শতাংশ ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশ ভারতে করহার ১২ শতাংশ।
আইটিআইএফে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড তথ্যপ্রযুক্তি সেবা ও পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। এর বাইরে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত করারোপ হয়েছে একাধিক স্তরে। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা গ্রহণ ও পণ্য ক্রয়- উভয় ক্ষেত্রেই প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিগত পাঁচ বছরের হিসাবে বাংলাদেশে মধ্যআয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার গড়ে ৮১ শতাংশ হারে বেড়েছে। উচ্চবিত্তের মধ্যে এই হার ছিল ১৬৭ শতাংশ ও নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই হার নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে ৫.৭ শতাংশ ও উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিদায়ী বছরেই ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় একীভূত করে একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়া হয়। আর বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাজনীতিক হিসেবে এই বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান জুনাইদ আহমেদ পলক। অবশ্য স্বল্পসময়ের মধ্যে মন্ত্রী পদের ঘন ঘন রদবদল এবং সর্বশেষ মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর কারাবাস মন্ত্রণালয়কে খবরের শিরোনামে নিয়ে আসে। একই সাথে এই মন্ত্রণালয়ের গুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সংসদে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর দেয়ার ভার দেয়া হয় সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ওপর।
তবে এই রদবদলে প্রভাব পড়েনি প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া। বাংলা ওসিআর নিয়ে উন্মোচিত হয়েছে ডিজিটাল পুঁথি। অনলাইনে প্রকাশ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি পিসি গেম ‘লিবারেশন-৭১’। বছরজুড়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মোবাইল অ্যাপস তৈরির নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বিদায় বছরে যুক্ত হয়েছে হ্যাকাথন ও মেক অ্যা থন। এসব উদ্ভাবনী আয়োজনে প্রতিভাত হয়েছে প্রযুক্তিতে আমাদের তরুণদের নিষ্ঠা ও সক্ষমতা। প্রযুক্তি খাতে যুক্ত হতে শুরু করেছে নবীন উদ্যোক্তা। তাদেরকে নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছে স্টার্টআপ কাপ। আর এই কাপের আয়োজক বেটার স্টোরিজের প্রধান ও প্রযুক্তি-কৌশলী মিনহাজ আনোয়ার বিদায়ী বছর নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বললেন, প্রযুক্তির নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এ বছরের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। এটা বছরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আগামী বছরে উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে আগে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। অ্যাডহক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রযুক্তি তার নিজস্ব পথ ধরেই এগিয়ে যাবে। সক্ষমতা ও দুর্বলতার আরও গভীরে যেতে হবে। সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরির জন্য ২০১৫ সালকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবেই আমরা টেকনোলজির সুপারপাওয়ার হতে পারব।
বছরজুড়ে প্রযুক্তিবিষয়ক ম্যাগাজিন মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর আয়োজনে ১৫-১৭ মে বরিশাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবং ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার, শাহবাগ, ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ই-বাণিজ্য মেলা। ঢাকা ই-বাণিজ্য মেলায় কমপিউটার জগৎ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রথম ই-কমার্স ডিরেক্টরি। একই সাথে ওয়েবে যুক্ত হয়েছে দেশী বেশ কিছু ই-কমার্স ওয়েবসাইট। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ নভেম্বর ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) আত্মপ্রকাশ করে।
দুই বছর বিরতির পর প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড’। সম্মেলনে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে সক্ষমতা বাড়াতে আর্থিক সহায়তার চুক্তি করে নেদারল্যান্ডস সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় বছরের শেষভাগে এসে দেশের ইন্টারনেটভিত্তিক নানা প্রকল্পে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে সিলিকন ভ্যালির ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান ফেনক্স। তবে উদ্যোক্তাবান্ধব এই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে ‘১৯৫৮ সালের ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ আইন’ যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য অভিজ্ঞজনদের। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে যত দ্রুত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল আইন করা যাবে, ততই মঙ্গল বলে মন্তব্য করেছেন বিডি ভেঞ্চারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত হোসেন। তার ভাষায়, বাংলাদেশে আইন না থাকায় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড উত্তোলন করা সম্ভব নয়। বিদেশী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) ফান্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আইনের অভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারছে না। বিদেশী ভিসি ফান্ড বাংলাদেশে এলে শুধু অর্থ নয়, সাথে জ্ঞানও আনবে। বাংলাদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটালে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি নেই। বিদেশী ভিসি ফার্ম সে অভাব দূর করতে পারে। ভিসি ফার্মের বিনিয়োগ করা কোম্পানি ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলে বর্তমানে দ্বৈত করের মুখোমুখি হতে হয়। ভিসি আইন না থাকায় কর অব্যাহতি চাওয়ার আইনী ভিত্তিও তৈরি হয়নি। তদুপরি ভিসি ফার্মগুলো চরিত্রগতভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ভিসি আইন প্রণয়ন হলে তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্যে প্রবেশাধিকার) পেতে পারে, যা তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি দ্রুত বর্ধনশীল ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিধায় ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হয়। প্রয়োজনীয় আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ব্যবসায়ের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিলে বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সৃষ্টি হবে অর্থায়নের নতুন এক যুগের।
বিদায়ী বছরে প্রযুক্তির পাঠ নিয়ে রাস্তায় নামে ইন্টারনেট সংযোগনির্ভর গুগল বাস। অবমুক্ত হয় তরুণদের উদ্ভাবিত বেশ কয়েকটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন। এর মধ্যে চ্যাটিং, ভিডিও চ্যাটিংয়ের দেশীয় প্লাটফর্ম ‘লক্ষ্মী’ হাজির হয় গত ৮ জুন। ২৪ জুন যাত্রা শুরু করে জাতীয় তথ্যবাতায়ন। দেশের বাজারে উন্মোচিত হয় ফায়ারফক্স ওএস গোফক্স এফ১৫, থ্রিডি প্রিন্টার। ১২ মার্চ শুরু হয় আইসিটি বিভাগে ই-ফাইলিংয়ের যাত্রা। ২১ মার্চ চালু হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনলাইনভিত্তিক বইপড়া কর্মসূচি। এমন প্রযুক্তির নানা আয়োজনে সমৃদ্ধ ছিল বিদায়ী ২০১৪।
বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে প্রযুক্তিবিদ ও বিজয় বাংলার রূপকার মোস্তাফা জববার মনে করেন, মানুষ তার আপন নিয়মে এগিয়েছে। বছরজুড়েই আমাদের প্রযুক্তি অঙ্গন গতিময় ছিল না। সরকারের অনেক কিছুই করার ছিল, কিন্তু করেনি। যে গতিতে এগোনোর কথা ছিল, তা হয়নি। প্রযুক্তি খাতের যতটা প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা, তা হয়নি। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার কোনো খাতেই প্রত্যাশিত সফলতা আসেনি।
আসছে বছরের প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাতা সংস্থার ৫৭০ কোটি টাকা নিয়ে কমপিউটার কাউন্সিল ও বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণের নামে যেভাবে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কনসালট্যান্সি না করে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে দীর্ঘস্থায়ী মানবসম্পদের দিকে। যে হাইটেক পার্ক নিজেই তৈরি হতে পারছে না, তার পেছনে সময় অপচয়ের চেয়ে এখানে কাজের যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। স্থানীয় মার্কেট চাঙ্গা করার পাশাপাশি দেশীয় আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি ব্র্যান্ড তৈরির দিকে নজর দিতে হবে
ফিডব্যাক : netdut@gmail.com

পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৫ - জানুয়ারী সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস