লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মো: আব্দুল কাদের
মোট লেখা:৬০
লেখা সম্পর্কিত
ই-সিগারেট: আশীর্বাদ না অশনিসঙ্কেত?
ই-সিগারেট একটি যন্ত্রবিশেষ, যা সাধারণ সিগারেটের মতো ব্যবহার করা যায়। ই-সিগারেটের প্রথম নাম ছিল ‘cigalikes’। এটি তামাকনির্ভর সাধারণ সিগারেটের মতো হলেও অতিরিক্ত গুণাবলির জন্য এর জনপ্রিয়তাও বেশি।
‘cigalikes’ পরবর্তী প্রজন্মে ‘e-cigarette’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এটা দেখতে অনেকটা রঙিন কলমের মতো, যা বেশি মূল্যসাশ্রয়ী এবং ধূমপায়ীদের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ ও ভিন্ন শক্তিমাত্রার নিকোটিনের ব্যবহারের সুযোগ দেয়। সর্বশেষ উদ্ভাবিত মডেলে বিভিন্ন সাইজ, আকৃতি ও নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা হয়েছে।
প্রতিটি ই-সিগারেটের তিনটি অংশ রয়েছে : ব্যাটারি, অ্যাটোমাইজার ও ই-লিকুইড কার্ট্রিজ। লিকুইড কার্ট্রিজে গিস্নসারিন, প্রপিলিন গস্নাইকল, বিভিন্ন ধরনের স্বাদ ও অনেক ক্ষেত্রে নিকোটিন যোগ করা হয়। নিকোটিন সিগারেটের মতো আসক্তির কাজ করে।
প্রতিটি ই-সিগারেটের মাথায় একটি এলইডি লাইট থাকে। কিছু ই-সিগারেট একবার ব্যবহারযোগ্য ও কিছু বারবার রিফিল করা যায়। যখন ই-সিগারেটে টান দেয়া হয়, তখন অ্যাটোমাইজার কার্ট্রিজের লিকুইডকে উত্তপ্ত করে ধোঁয়া নির্গত করে, যেটা সিগারেটের মতো গলায় অনুভব হয়।
ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের বিপরীতে আসক্তিহীন, কিন্তু সিগারেট লাইফস্টাইল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। উন্নত বিশ্বে ই-সিগারেট সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ইন্টারনেট এটিকে আরও একধাপ এগিয়ে একটি ফোরাম তৈরি করেছে, যাতে এর ব্যবহারকারীরা উন্নতমানের যন্ত্রপাতির ব্যবহার, এগুলোর সহজলভ্যতা, সেই সাথে ফার্মেসি থেকে প্রপিলিন গস্নাইকল দিয়ে কীভাবে নতুন স্বাদের ই-সিগারেট তৈরি করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়।
ই-সিগারেটের ক্ষতির মাত্রার ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে সবাই একমত, ধূমপায়ীদের শতাধিক ভিন্ন স্বাদের পাশাপাশি যারা সিগারেট ছাড়তে চান তাদের জন্যও এটা আশীর্বাদ হতে পারে। ব্যবহারকারীদের মতে, শক্তিশালী ফ্লেভারসমৃদ্ধ লিকুইড ব্যবহার করে সব ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ছাড়াও ই-সিগারেট আপনাকে দিতে পারে একই ধরনের ধূমপানের অনুভূতি। তবে এ ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টসহ মুখ ও গলার সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিকোটিন বিষণ্ণতা ও রক্তচাপ বাড়ানোতে ভূমিকা রাখে। এটা রক্তকণিকা ধ্বংস করে, হার্টকে অকেজো করে এবং সেই সাথে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফিলিপ গার্ডিনারের মতে, ই-সিগারেটের ধোঁয়া জলীয় বাষ্প নয়। এটি নিকোটিন ও ভারি জৈব যৌগের উদ্বায়ী বস্ত্ত। ই-সিগারেটের ব্যবহার নতুন হওয়াতে এর স্বাস্থ্যগত সমস্যা নির্ধারণে আরও সময় প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ই-সিগারেটের বিপণন কার্যক্রম জোরালোভাবে চলছে মূলত যুবসমাজকে কেন্দ্র করে, যেখানে বলা হচ্ছে এটা স্বাস্থ্যসম্মত, আকর্ষণীয় কিন্তু ক্ষতিকরহীন- যেরকম সিগারেটের ক্ষেত্রেও প্রথমে বলা হতো এটা বিজ্ঞানসম্মত, ফ্যাশনেবল। সিগারেটের ব্যাপারে তখন ধারণাটাই এরকম দাঁড়িয়েছিল, পুরুষ বোঝাতে সিগারেট অপরিহার্য। বর্তমানে ঠিক তেমনি হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা জনি ডেপ, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এবং গায়িকা কেটি পেরিও ই-সিগারেটে টান দিয়ে যুবসমাজকে তা গ্রহণেরই আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
ই-সিগারেটের আকর্ষণীয় ফ্লেভারের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের নিকোটিন আসক্ত এক নতুন প্রজন্ম তৈরি করছে। যদিও তরুণ-তরুণীরা এতে আকৃষ্ট হচ্ছে তবুও ওয়েলসের এলিজাবেথ বাকের এটিকে ধূমপান বর্জন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন যখন দেখলেন তার ১১ ও ১৪ বছরের দুটি সমত্মানের ই-সিগারেটের প্রতি আগ্রহ জন্মাচ্ছে, যদিও তারা ধূমপায়ী ছিল না। এলিজাবেথ বাকেরের মতে, আমি জানি ধূমপান ত্যাগ করা কতটুকু কষ্টসাধ্য, কিন্তু তাকে তার সমত্মানদের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে, নিকোটিনবিহীন ই-সিগারেট তো ক্ষতিকর নয়। তবে এটা দেখতে ফ্যাশনেবল ও আকর্ষণীয় হওয়ায় তার সমত্মানদের কাছে ধীরে ধীরে আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এভাবেই যুবসমাজ প্রতিনিয়ত ই-সিগারেটের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, যা পরে তাদের মধ্যে তামাকজনিত আসক্তির ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে।
প্রফেসর জেরার্ড হাসটিংসের মতে, ১৯৬০ সালে যখন তামাকজনিত বিজ্ঞাপন ছিল সহজলভ্য, একই ধরনের ট্রেন্ড, প্রচলন, পৃষ্ঠপোষকতা এবং সেলিব্রেটি প্রচারণা, যা টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিকে ই-সিগারেটের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মে উন্নীত করেছে।
ই-সিগারেট তাদের জন্যই উপকারী, যারা সিগারেট ছাড়তে চান। ধূমপায়ীরা সিগারেটের পরিবর্তে ই-সিগারেট ব্যবহার করতে পারে শুধু এই ভেবে, তারা সিগারেটই খাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা নিকোটিন ব্যবহার বন্ধ করে বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত তরল জিনিস ব্যবহার করবে। এতে সচরাচর সিগারেটের মতো ধোঁয়াও নির্গত হবে। তবে পার্থক্য হবে, নিকোটিন তাদের যে নেশা তৈরি করত তা থেকে তাদেরকে ধীরে ধীরে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু তাদের জন্য অপকারী যারা অধূমপায়ী। কারণ এটি তাদের নতুনভাবে সিগারেটে আসক্ত করতে পারে।
ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে, পোল্যান্ডে প্রতি পাঁচজনে একজন, ফ্রান্সে প্রতি তিনজনে দুইজন ই-সিগারেট ব্যবহার করেছে। সুইডেনে প্রতি পাঁচজনে দুইজন ই-সিগারেট ব্যবহার করছে, যাদের মধ্যে ৫ শতাংশ সবসময় নিকোটিনযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে। এর মূল কারণ তারা এর স্বাদ পছন্দ করত এবং এটা এমন জায়গায় ব্যবহার করতে পারত যেখানে সাধারণত ধূমপান নিষিদ্ধ। কোনো কোনো ছেলেমেয়ে তাদের মা-বাবার সামনেই ই-সিগারেট ব্যবহার করলেও তারা জানতেনই না যে ছেলেমেয়ে ধূমপান করছে। সুতরাং ই-সিগারেট ধূমপায়ীদের সিগারেট ত্যাগ করতে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু অধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এটা শেষ হয় সিগারেটের চেয়েও আরও বেশি ও ভিন্নমাত্রার ব্যবহার হিসেবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ই-সিগারেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে সিগারেটের প্যাকেটের ওপর স্বাস্থ্য সতর্কতা লিপিবদ্ধ করতে নির্দেশনা জারি করেছে। ই-সিগারেট যেন আসক্তির পর্যায়ে না যায় এবং এর ব্যবহার যেন ধূমপানের প্রতি আকৃষ্ট না করে, এজন্য তারা নিকোটিনের ব্যবহারের ওপর কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। যেমন একটি কার্ট্রিজে সর্বোচ্চ ২ মিলি নিকোটিন ব্যবহার করা যাবে। তবে কোনো কোনো দেশ যেমন অস্ট্রিয়া এটিকে ওষুধ হিসেবে প্রচার করছে। নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু শহরে ই-সিগারেট বৈধ কিন্তু নিকোটিনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও আমাদের দেশে এর ব্যাপকভাবে প্রচলন এখনও শুরু হয়নি। তবে ই-সিগারেটের উপকারী দিকটি কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের ধূমপায়ীরা সহজেই ধূমপান থেকে মুক্ত হওয়ার একটা প্রয়াস গ্রহণ করতেই পারেন
ফিডব্যাক : balaith@gmail.com