লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোহাম্মদ জাবেদ মোর্শেদ চৌধুরী
মোট লেখা:৫১
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৫ - সেপ্টেম্বর
ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং ও আমাদের ছাত্রসমাজ: একজন ফ্রিল্যান্সারের অভিজ্ঞতা
ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং সম্পর্কে বর্তমানে সবাই কমবেশি জানে এবং আউটসোর্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তা অতিমাত্রায় প্রচার দোষে দুষ্ট হয়েছে। ফলে অনেকে না বুঝেই এই ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই অতিমাত্রায় প্রচারকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ কিছু কামিয়ে নিচ্ছে। আর প্রতিদিনই অসংখ্য ছেলেমেয়ে সবকিছু ফেলে এই খাতে ঢুকছে আর হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে।
এখানে আবেগের বশে এসে কোনো লাভ নেই। আর আসলাম, বসলাম, টাকা গুনলাম- এমন প্রত্যাশা বেশিরভাগ নতুনদের রয়েছে। এই খাতটা খারাপ বা নতুনদের আসা যাবে না, তা বলা যাবে না। তবে এ কথা সত্য, এই খাত সবার জন্য নয়।
আমার কাছে এই পর্যন্ত প্রায় ১০-১২ জন এসেছে ফ্রিল্যান্সিং শিখতে বা কাজ শিখতে। তারা এসেছে আমার ইনকামের অঙ্ক শুনে। যেহেতু ঘরে বসে কাজ করি এবং আমার কোনো বড় ডিগ্রি নেই, তাই মনে করেছে এটা খুব সহজ কাজ। আমি তাদের সবাইকে ভালো করে বুঝিয়েছি, সবার জন্য এ কাজ নয়।
অনেকে আবার নাছোড়বান্দা কাজ শেখার জন্য। তাদেরকে যতই বুঝানো হোক না কেনো এটা পারবে না, সে ততই আঠার মতো লেগে থাকে। মাঝে মাঝে এমন ছেলেমেয়ে অনেক সময় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারে, কারণ, কোনো কিছুতে আঠার মতো লেগে থাকতে পারাটাও একটা ভালো গুণ এই সেক্টরে। কিন্তু বেশিরভাগই সঠিক বিষয়ের ওপর লেগে থাকতে পারে না।
একটি উদাহরণ
আমি এরকম একজনকে বেসিক এইচটিএমএল/সিএসএস শেখানোর পর আর সময়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বললাম- ভাই আর সময় হচ্ছে না। তাও আমার পেছনে আঠার মতো লেগে আছে এখনও তাকে শেখানোর জন্য। কিন্তু এই একাগ্রতা যদি প্র্যাকটিসের পেছনে ব্যয় করত, তাহলে এতদিনে নিজেই আয় করা শুরু করতে পারত। আমরা যেখানে কোনো হাতে-কলমে গাইড ছাড়া এতদূর এসেছি, সেখানে সে বেসিক শেখার পরও প্র্যাকটিস করতে পারছে না বা করার ইচ্ছে করছে না। তাহলে বলুন, তাদেরকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে কী লাভ।
যাদের প্রবল আগ্রহ এবং ইচ্ছে আছে, তারাই এই খাতে উন্নতি করতে পারবে- এটাই চিরন্তন সত্য। আবেগের বশে বা টাকার অঙ্ক শুনে এই খাতে না আসাই ভালো। কারও আয়ের তথ্য শুনে উৎসাহিত হওয়ার আগে দয়া করে তার সাফল্যের আগের ঘটনাগুলো জানুন। তার কাছে শুনুন, তার প্রচ- পরিশ্রমের গল্প।
ছাত্রদের ফ্রিল্যান্সিং
আমি সবসময়েই বলি, যেসব ছাত্রদের পরিবারের সামর্থ্য আছে তোমাদের লেখাপড়া ও সব খরচ জোগানোর; তোমরা দয়া করে এসব বাদ দিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর। তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তোমরাই একদিন এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর যাদের পড়াশোনা ভালো লাগে না, তাদের কথা আলাদা। ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে লাখ টাকা কামাবে, তাহলে আর পড়াশোনা করে লাভ কী, তাই না? এই লাখ টাকাটা তোমার কাছে এখন অনেক বড় লাগলেও আসলে কিন্তু খুব বড় অঙ্ক নয় এটা। এরচেয়েও অনেক ভালো অঙ্কের বেতন পাবে তুমি ভালো করে পড়াশোনা করলে।
এখন আমাকে প্রশ্ন করতে পার, আপনি কেন ফ্রিল্যান্সিং করেন?
এটা সত্যি কথা এবং আমি অকপটে স্বীকার করব যে, আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছি টাকার জন্য। আমার পরিবারের এমন সামর্থ্য ছিল না যে আমাকে আরও পাঁচ বছর পড়াশোনার খরচ দিয়ে যাবে। হয়তো দিতে পারত, কিন্তু তারপর? আমি পড়াশোনায় এমন ভালো ছিলাম না বা এমন ভালো কোনো বিষয়ে পড়তাম না যে, পড়াশোনা শেষ করলেই চাকরি জুটে যাবে। সরকারি চাকরি হয়তো পাওয়া যেত, কিন্তু ঘুষটা কে দেবে? যাই হোক, যদি কোনো ছাত্রের আমার মতো বা এরকম কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে তাদের ফ্রিল্যান্সিং করাটার মধ্যে আমি দোষের কিছু দেখি না।
আর এও ভাবতে পার, পড়াশোনা আর ফ্রিল্যান্স পাশাপাশি করব। ভুলে যাও, এটা সম্ভব নয়। আমার এই কথা শুনে অনেকেই ক্ষেপে উঠতে পারে, আপনি পারেননি বলেই কী সবাই পারবে না? আমি তাদের প্রশ্ন করব, একজন মেডিক্যালের ছাত্র বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র দিনে কত ঘণ্টা সময় পায় অবসর কাটানোর জন্য? বাংলাদেশের টাইম জোন অনুসারে ফ্রিল্যান্সিংকে রাতের পেশাই বলা চলে। হাতেগোনা গুটিকয়েক ফ্রিল্যান্সারই দিনের বেলা কাজ করতে পারে। আর ছাত্রদের জন্য তো দিনের বেলা কাজ করা সম্ভবই নয়। তাহলে রাতে কাজ করল। রাতের পড়াশোনার কথা যদি বাদও দেই ঘুমটাকে তো আর বাদ দেয়া যাবে না। আর দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে কাটালে তার সাইড ইফেক্টও আছে।
আরেকটা যুক্তি দেখাতে পারেন, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।
ভালো বলেছেন। কিন্তু, সব সময় প্রবাদ-প্রবচন কাজে আসে না। আপনার হাজার ইচ্ছে থাকলেও একদিনকে আপনি ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় বসিয়ে রাখতে পারবেন না। আর সময় বাড়ানো না গেলে কী হবে তা ওপরের পয়েন্টেই বলেছি। একজন একসাথে দুই চলন্ত নৌকায় পা রাখতে পারে না। যারা পারে তারা অনেক ব্রিলিয়ান্ট। তাই দুই নৌকায় পা রাখার আগে ভেবে দেখুন, আপনি টাল সামলাতে পারবেন কি না।
তবে ফ্রিল্যান্সিং করে কোনো ছাত্রই সফল হচ্ছে না তা বলছি না। তবে দেখা যাবে যে, বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সিং করা ছেলেমেয়েই ক্লাসে ভালো ফলাফল করতে পারছে না। ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য কিন্তু সারাজীবন পড়ে আছে। ডিগ্রিটা কিন্তু তোমাকে যথাযথ সময়েই শেষ করতে হবে। তাই, এই সময়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো অর্জনের ওপর জোর দিতে পার। এই সময় থেকেই এটা তোমাকে কর্মজীবনে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে। একটা উদাহরণ- যারা কমপিউটার সায়েন্সে পড়, তাদের কাছে মনে হতে পারে, ডাটা স্ট্রাকচার শিখে কী হবে, ওয়ার্ডপ্রেসের প্লাগইন বানানো শিখলেই তো হয়। কথা সত্য, ওয়ার্ডপ্রেসের প্লাগইন ডেভেলপমেন্ট করাটা তোমাকে তাৎক্ষণিকভাবে আয়ের সংস্থান করবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তুমি যদি ডাটা স্ট্রাকচার না জানো, তাহলে বেশিদূর যেতে পারবে না। এটা তোমাকে অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে রাখবে।
তাই বলব, ছাত্র অবস্থায় ক্লাসে যা শেখানো হচ্ছে তা ভালো মতো শিখ এবং কোনো অবস্থাতেই ছাত্র অবস্থায় ফুলটাইম ফ্রিল্যান্স ক্যারিয়ার শুরু কর না। ভালো মতো শিখে এলে কাজ করার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে
ফিডব্যাক : jabedmorshed@yahoo.com