লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মইন উদ্দীন মাহমুদ
মোট লেখা:২৭
লেখা সম্পর্কিত
দেশে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসায় পথপ্রদর্শক এমএন ইসলাম
বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ বেকারদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করার মহান লক্ষ্য নিয়ে এ দেশে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসায় শুরু করে প্রযুক্তিপ্রেমীদের কাছে পথিকৃৎ ও পথপ্রদর্শক হিসেবে সবার হৃদয়ে স্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন ফ্লোরা লিমিটেডের চেয়ারম্যান মরহুম মো: নুরুল ইসলাম, যিনি সমধিক পরিচিত এমএন ইসলাম নামে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ের অগ্রনায়ক এই মহান কর্মবীর ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি অসংখ্য গুণগ্রাহী, শুভাকাঙক্ষী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ে সহযোদ্ধাদের রেখে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে কমপিউটার জগৎ পরিবারের পক্ষ থেকে তার বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রইল।
এমএন ইসলামের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার পূর্ব গাটিয়াডাঙ্গা গ্রামে। ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশনের পর ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে মাস্টার্স শেষ করেন। তিনি প্রথম জীবনে তৎকালীন হাবিব ব্যাংকে ১৫ বছর কাজ করেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের সাথে মিল না হওয়ায় সেই চাকরি ছেড়ে দেন।
তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী, মৃদুভাষী এবং অত্যন্ত প্রচারবিমুখ এক মানুষ, যা তাকে করেছে অন্যদের থেকে ভিন্ন। ‘প্রচারই প্রসার’- এ কথায় বিশ্বাসী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু আত্মপ্রচারে কখনই নিজেকে বন্দা করেননি। ফলে তিনি হয়ে উঠতে পেরেছেন এক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
এমএন ইসলাম ব্যাংকিং জীবন ছেড়ে দিয়ে ১৯৭২ সালে মতিঝিলে ১৫০ বর্গফুট জায়গায় মাত্র ৯০ টাকা মাসিক ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ফ্লোরা লিমিটেড। ৪৩ বছরে ফ্লোরা লিমিটেড এখন দেড় লাখ বর্গফুটের ৩৪টি শাখার মাধ্যমে প্রায় ৭৪৬ কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে এমএন ইসলাম উদ্যোগের ফলে।
ব্যবসায়ের শুরুতে তিনি কিছু টাইপরাইটার সরবরাহ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এ দেশে নিয়ে আসেন ডুপ্লিকেটিং মেশিন। যেহেতু তিনি চিন্তা-চেতনায় ছিলেন প্রযুক্তিপ্রেমী, তাই ১৯৭৩ সালে এ দেশে প্রথম ক্যানন ক্যালকুলেটর মেশিন বাজারজাত শুরু করেন। বলা হয়, এ সময় থেকে দেশে অফিস অটোমেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আশির দশকে এমএন ইসলাম এ দেশে টেকনোলজি ট্রান্সফারের দিকে নজর দেন। ১৯৮২ সালে বাণিজ্যিকভাবে কিছু কমপিউটার নিয়ে আসেন, যার তখনকার বাজারমূল্য ছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। এমএন ইসলামের দূরদর্শিতার কারণে ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশের বাজারে এইচপি, এপসন, ক্যানন, মাইক্রোসফট, সিসকো, থ্রিএম, ভারবাটিম, ডেল, ইন্টেল প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। সময়ের বিবর্তনের সাথে তিনি এ দেশে বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য বাজারজাত করে শুধু দূরদর্শিতার পরিচয়ই দেননি, বরং এ দেশের জনগণকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।
এমএন ইসলাম কত দূরদর্শী ও প্রযুক্তিপ্রেমী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার আগেই বিজ্ঞাপন দেয়ার আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে। সে সময় তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কোনো বাংলা পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ হবে এমন কথা ভাবতেও পারতেন না কেউ। শুধু তাই নয়, তিনি কমপিউটার জগৎ-এ নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়ার পাশাপাশি পত্রিকাটি প্রতি মাসে ১৫০০ কপি নগদ টাকায় কিনতেন, যা তিনি ফ্লোরা লিমিটেডের ক্লায়েন্টদেরকে ফ্রি দিতেন তথ্যপ্রযুক্তিতে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে।
তিনি মনে করতেন, এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে চাইলে প্রথমে প্রযুক্তি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সেই সাথে প্রযুক্তি সম্পর্কে মানুষের মনের ভীতি দূর করতে হবে। তিনি যে শুধু কমপিউটার জগৎ ম্যাগাজিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন তা নয়, এ দেশে যেসব আইটিবিষয়ক পত্রিকা বের হতো সেসব পত্রিকায়ও নিয়মিতভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন, যাতে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটে দ্রুতগতিতে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, এমএন ইসলাম তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বাংলা পত্রিকাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়ে এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখেন সেই সময়ে, যে সময়ে এ দেশের দৈনিকগুলো তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলত।
নিজ কর্মস্থলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল জীবন্ত। এক মুহূর্তের জন্যও তিনি নিজের কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতেন না। অফিসের খুঁটিনাটি সব বিষয়ই ছিল তার জানা। অফিসের সবচেয়ে নিচের কর্মচারী থেকে শুরু করে যেকেউ কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই তার কাছে যেতে পারতেন। একই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন বিচক্ষণতার সাথে। ভালোবাসতেন নানা বিষয়ে বই পড়তে। তার জীবনে অন্যতম আনন্দের বিষয় ছিল নিজ হাতে গড়া নিজ গ্রামের স্কুলের কোনো সুসংবাদ পাওয়া। তিনি অনেক শক্ত মনের মানুষ হলেও একবার স্কুল ভবনে ফাটলের সংবাদে তিনি চোখের পানি আটকাতে পারেননি।
প্রচারবিমুখ ছিলেন এই মানুষটি। অফিসে প্রতিদিনই দেখা যেত অনেক দুস্থ মানুষকে, যারা নিয়মিতভাবে তার সহায়তা পেতেন। অফিসের প্রতিটি কর্মীর ব্যক্তিগত সমস্যায় পাশে দাঁড়াতেন। এই মেধাবী উদ্যোক্তা যেমন দেশের জন্য কাজ করে গেছেন, তেমনি দেশও তার স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির গোল্ড মেডেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, জনপ্রিয় পত্রপত্রিকা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আইটি কোম্পানি থেকে পেয়েছেন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা।
এমএন ইসলাম ছিলেন একজন সফল ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী। তার লেখালেখির হাতও ছিল চমৎকার, যা আমাদের অনেকেরই অজানা। ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে কমপিউটার জগৎ-এ দ্বিতীয় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে তার লেখা প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘কমপিউটার এবং জনশক্তি : বিশ্বে লক্ষ লক্ষ প্রোগ্রামারের চাহিদা।’ নববইয়ের দশক থেকে সারা বিশ্বে দক্ষ প্রোগ্রামারের ব্যাপক ঘাটতি হবে তা উপলব্ধি করে তিনি কমপিউটার জগৎ-এর মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরেন প্রোগ্রামারের বিপুল ঘাটতির কথা। সেই সাথে তাগিদ দেন এই ঘাটতি পূরণের। শুধু তাই নয়, তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনাও দেন। তিনি এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও আধুনিক তথা সংস্কার করার তাগিদ দেন। যার কিছু অংশ এখানে দেয়া হলো- ‘কমপিউটার এবং জনশক্তির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো লাখ লাখ প্রোগ্রামারের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এরা এজন্য তৃতীয় বিশ্বের জনশক্তিকে কাজে লাগাতে চায় শ্রমমূল্যের সুবিধার জন্য। শুধু জাপানেই লাখ লাখ কমপিউটার জানা লোক প্রয়োজন। চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে জনশক্তি উন্নয়ন ও রফতানির চেষ্টা চালাচ্ছে এবং সফলও হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে প্রোগ্রামার তৈরি ও রফতানির ব্যাপারে সরকারি বা বেসরকারি প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি।’
তার ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে কমপিউটার জগৎ হারাল এর সত্যিকারের এক পৃষ্ঠপোষককে, অকৃত্রিম বন্ধুকে। তবু আশার কথা, তার জীবদ্দশায় তিনি তার সুযোগ্য সন্তান মোস্তফা সামসুল ইসলাম, বর্তমানে ফ্লোরা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মোস্তফা রফিকুল ইসলাম, ফ্লোরা টেলিকমের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে যথাযোগ্য করে গড়ে তুলেছেন ফ্লোরা লিমিটেডের হাল ধরার জন্য।