লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
হিটলার এ. হালিম
মোট লেখা:২২
লেখা সম্পর্কিত
বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের বিতর্ক নিয়ে ‘রহস্য’
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে (আঙুলের ছাপ) সিম নিবন্ধন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সন্দেহ দানা বেঁধেছে গ্রাহকের মনে। অথচ শুরুতে এসব কিছুই ছিল না। গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে কাজটি শুরু হওয়ার পর থেকে কিছুদিন বেশ স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই চারদিক থেকে শোরগোল উঠতে শুরু করল, বিদেশি বেনিয়া গোষ্ঠীর হাতে আঙুলের ছাপ তুলে দিতেই সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। এই এক কথাতেই নড়েচড়ে বসে অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সরব হয়ে ওঠে। সবই বিপক্ষে। যেসব বিষয় গুজব তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে, সেগুলো হলো- ০১. মোবাইল অপারেটরগুলোর সংগঠন অ্যামটবের নামে বিজ্ঞাপন প্রচার- সাবধান সিম নিবন্ধন করবেন না (পরে প্রমাণ হয় ওই বিজ্ঞাপনটা অ্যামটবের নয়)। ০২. ফেসবুকে এর বিপক্ষে প্রচারণা চালানো (স্পন্সরড বিজ্ঞাপন) হয়। ফলে একটা ফলোয়ার গ্রম্নপও তৈরি হয়ে যায়। তারাই ক্যাম্পেইন চালিয়ে যায়।
অবশ্য এর সব তথ্যই সরকারের হাতে চলে আসে। তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, যে পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা হবে তার নির্দেশনার একটি পয়েন্টকে ঘিরে তৈরি হয় বিতর্ক। ওই নির্দেশনার কপিটি বেহাত হয়ে যাওয়ার কারণে গুজব ছড়ানো গ্রম্নপটি ওই পয়েন্টটিকে হাইলাইট করে বিতর্ক ছড়াতে শুরু করে।
এদিকে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির তৈরি বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন সিস্টেম সম্পর্কিত নির্দেশনা অনুসরণ করেই সিম নিবন্ধন হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই নির্দেশনাই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্দেশনার মধ্যে এমন কিছু তথ্য রয়েছে, যার ব্যাখ্যা অন্যভাবে করছেন গুজব রটনাকারীরা।
সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সবাই বলছেন, আঙুলের ছাপ কোথাও সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। কিন্তু নির্দেশনার ৬ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। প্রক্রিয়াগুলো হলো- মোবাইল অপারেটর তার অপারেটরস বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন প্লাটফর্মের মাধ্যমে সিম/রিম বিক্রেতা (রিটেইলার, ডিস্ট্রিবিউটর, কাস্টমার কেয়ার সেন্টার ইত্যাদি) নিম্নলিখিত তথ্য সংগ্রহ করবে-বিক্রেতার পরিচিতি কোড, গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, গ্রাহকের জন্ম তারিখ, গ্রাহকের আঙুলের ছাপ (জাতীয় তথ্যভা-ারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফরম্যাটে) ও যাচাইযোগ্য মোবাইল নম্বর।
এরপর অপারেটর উক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং যাচাইযোগ্য মোবাইল নম্বরের বিপরীতে ভেরিফিকেশনের জন্য সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্লাটফর্ম থেকে অনলাইন ক্লিয়ারেন্স গ্রহণ করবে। উক্ত অনলাইন ক্লিয়ারেন্স প্রাপ্তি সাপেক্ষে অপারেটর প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভা-ারের সাথে যাচাইয়ের জন্য পাঠাবে। অপারেটর যাচাইয়ের ফলাফলসহ কিছু তথ্য সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্লাটফর্মে পাঠাবে। যেসব তথ্য পাঠাতে হবে- বিক্রেতার পরিচিতি কোড, গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, গ্রাহকের জন্ম তারিখ, গ্রাহকের আঙুলের ছাপ (জাতীয় তথ্যভা-ারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফরম্যাটে), যাচাইযোগ্য মোবাইল নম্বর, ট্রান্সজেকশন আইডি, ভেরিফিকেশন তারিখ ও সময় এবং ভেরিফিকেশনের ফলাফল। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভা-ার থেকে ফলাফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্লাটফর্মে তথ্য পাঠানোর পরই উক্ত সিম/রিম ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত তথ্য জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্যভা-ার ছাড়া অন্য কোনো তথ্যভা-ারের সাথে ভেরিফিকেশন করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এই একটি অংশই বিতর্ক তৈরি করেছে। গুজব রটনাকারীরা এই পয়েন্ট নিয়েই অগ্রসর হয়।
বিষয়টি নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধনকে বিতর্কিত করতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের কারণে যাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তারাই এটা নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। এটা নিয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। সিম নিবন্ধনে আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ডাটাবেজে রক্ষিত আঙুলের ছাপের সাথে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনোভাবেই তা আলাদা কোথাও সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আমি জানি কারা এই প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। যারা হুমকিদাতা, যারা চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসায়ীরা এসব গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। কারণ, সিম নিবন্ধনের এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারলে তারাই সবচেয়ে লাভবান হবে। আমি জানি তারা সব রাঘব বোয়াল। কিন্তু রাঘব বোয়াল, কুমির, বাঘে তারানা হালিম ভয় পায় না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন শেষ করব। এর মধ্যে যেসব সিম অনিবন্ধিত থাকবে সেগুলোকে কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হবে। বন্ধ রাখার সময়ও সিম নিবন্ধন করা না হলে পর্যায়ক্রমে সেসব সিম বন্ধ করে দেয়া হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আঙুলের ছাপ কোথাও সংরক্ষণ করা হচ্ছে না, শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্যভা-ারের সাথে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মোবাইল অপারেটর তার অপারেটরস বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন প্লাটফর্ম এবং সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্লাটফর্মের কথা। যারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে তারা এই দুটি পয়েন্ট নিয়েই বিতর্ক তৈরি করছে। সরকার বলছে, কোথাও সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। এদিকে আবার দুটি প্লাটফর্মের কথা বলা হচ্ছে।
যদিও এ বিষয়টির ব্যাখ্যাও তারানা হালিম বরাবরই দিয়ে আসছেন। তিনি বলেছেন, এ পদ্ধতিতে ব্যক্তির তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই তথ্য মানে আইডি নম্বর, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর ইত্যাদি। ব্যক্তির তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে, আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, এটা অনলাইন ভেরিফিকেশন, অফলাইন নয়। ফলে আঙুলের ছাপ অন্য কারও হাতে তুলে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি জানান, যে ডিভাইস দিয়ে আঙুলের ছাপ নেয়া হচ্ছে তাতে সংরক্ষণের কোনো সফটওয়্যার নেই।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এসব সমস্যার কারণে নির্দেশনায় এক লাইনের একটি সংশোধনী আনা হয়েছে। ওই সংশোধনীর ফলে সব ধরনের গুজব, বিভ্রামিত্ম ও বিতর্কের অবসান হবে।
সিম নিবন্ধন নিয়ে রিট : আঙুলের ছাপ বা বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধন কেন অবৈধ হবে না- এই মর্মে উচ্চ আদালতে একটি রিট হয়। গত ৩০ মার্চ ছিল রিটের শুনানি। শুনানিতে সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। ওইদিন শুনানি শেষ হয়নি। ২ এপ্রিল আবার শুনানি হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের ধারণা, যারা অবৈধ ভিওআইপি করছে তারাই কাউকে দিয়ে রিট করিয়েছে। কারণ, এই পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করা হলে ভবিষ্যতে কেউ আর অবৈধ ভিওআইপি করতে পারবে না। তখন কে কোন সিমের সঙ্গে জড়িত তা সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। অনেকে আবার খোদ মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন। হয়তো অপারেটরগুলোই কাউকে দিয়ে কাজটি করিয়ে থাকতে পারে।
জরুরি বৈঠক : তবে গত ২৮ মার্চ সচিবালয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে তারানা হালিম দেশের সব মোবাইল ফোন অপারেটরের লিগ্যাল বিভাগের কর্মকর্তা এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে সিম নিবন্ধন এবং রিটের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, রিট শুনানিতে অপারেটরগুলোর প্রতিনিধিরা যেন থাকেন এবং কেউ যেন কোনোভাবে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে না পারেন, সেজন্য সরকার এই কৌশল গ্রহণ করে। অপারেটরগুলো এই কাজে অংশ নিতে পারে সন্দেহ থেকেই এই উদ্যোগ। আর তারানা হালিম বরাবরই বলে আসছেন, সিম নিবন্ধনের উদ্যোগ ভেসেত্ম গেলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো।
জানা যায়, এর আগে সিম নিবন্ধন কাজ শুরুর আগে ও পরে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে তারানা হালিম একাধিকবার বৈঠক করেন। ওইসব বৈঠক থেকে জানা যায়, অপারেটরগুলো সিম নিবন্ধনের জন্য সারাদেশে এক লাখের বেশি বায়োমেট্রিক ডিভাইস সরবরাহ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক : অন্যদিকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন কাজের কী অগ্রগতি তা নিয়ে গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। ওই প্রেজেন্টেশন শুরুর পরে এখন পর্যন্ত তিন ভাগের এক ভাগ সিম নিবন্ধন হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে দেশে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন শুরু হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ছয় অপারেটরের মোট ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৫৭ হাজার ৫৫১টি সিমের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। যদিও সিম ভেরিফিকেশনের জন্য পাঠানো হয়েছিল ৫ কোটি ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩৭টি। এর মধ্যে ম্যাচ করেনি ৮০ লাখ ৪১ হাজার ১৪৭টি।
ভেরিফায়েড হওয়া সিমের মধ্যে রয়েছে এয়ারটেলের ১৮ লাখ ১৭ হাজার ২২৪, বাংলালিংকের ১ কোটি ৩৮ লাখ ৯১ হাজার ৬১৮, সিটিসেলের ২৯ হাজার ৫৫৯, গ্রামীণফোনের ২ কোটি ৫৪ লাখ ৫৯ হাজার ৩৬, রবির ৪৫ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৫ ও টেলিটকের ১৮ লাখ ২৭ হাজার ৪৯টি।
কিরূপে হয়েছে, সমস্যা কোথায় তা চিহ্নিত করে সেসবের বিস্তারিত দেখানো হয়। এছাড়া বিশ্বের আর কোথায় কোথায় সিম নিবন্ধনে আঙুলের ছাপ নেয়া হচ্ছে, কোন মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে, তাদের সাফল্যের হার ইত্যাদি বিষয় দেখানো হয়।