লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোহাম্মদ জাবেদ মোর্শেদ চৌধুরী
মোট লেখা:৫১
লেখা সম্পর্কিত
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন
সরকার গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে বায়োমেট্রিক (আঙ্গুলের ছাপ) পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের কাজ শুরু করে। নিবন্ধনের প্রক্রিয়া বেশ জোরেশোরেই চলছিল। এরপর কিছুদিন পর প্রাইভেট কোম্পানির কাছে বায়োমেট্রিক তথ্য চলে যাচ্ছে- এই আশঙ্কার ভিত্তিতে এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের সুপ্রিমকোর্টে আপিলের পরিপেক্ষিতে কোর্ট এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে সরকারকে নোটিস দেয়। এ নিয়ে পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়ায় ব্যাপক লেখালেখি ও প্রচারণা হয়েছে। ফলে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির পক্ষে ও বিপক্ষে দুদিকেই ব্যাপক জনমতের সৃষ্টি হয়েছে। আর আদালত থেকেও কোনো স্থগিতাদেশ না দেয়ায় সরকারও সিম নিবন্ধনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
কেন দরকার বায়োমেট্রিক পদ্ধতি?
দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি হলেও মোবাইল সংযোগ আছে প্রায় ১৩ কোটি। তবে এর মধ্যে বেশিরভাগ মোবাইল সংযোগের সঠিক নিবন্ধনের তথ্য হালনাগাদ নেই। মূলত ভুয়া তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করা এমন মোবাইল সংযোগ ব্যবহার করে দেশে বিভিন্ন সময় নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম সংঘটিত হচ্ছে। তাই ব্যবহারকারীর সঠিক নিবন্ধন নিশ্চিত করতে গত বছর বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মূলত এ পদ্ধতিতে নিবন্ধনের সময় ব্যবহারকারীর আঙ্গুলের ছাপ নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেজে থাকা আঙ্গুলের ছাপের সাথে মিলিয়ে দেখা হবে বলে জানায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে এই পাইলট প্রকল্পটি শুরু হয়। আর ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ থেকে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের কাজ শুরু হয়।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতি আসলে কী?
ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে কটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো বায়োমেট্রিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ব্যবহারকারীর আঙ্গুলের ছাপ, রেটিনা কিংবা কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। তবে এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে বহুল ব্যবহার হওয়া পদ্ধতি হলো আঙ্গুলের ছাপ। তাই মোবাইল সংযোগ নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে প্রথম দেশ হিসেবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন কার্যক্রম হাতে নেয় পাকিস্তান। পরবর্তী সময়ে একই কার্যক্রম শুরু হয় বাংলাদেশে। চলতি বছরের শুরুর দিকে সৌদি আরবে শুরু হয় বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধন কার্যক্রম।
কীভাবে হয় বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন?
প্রথমে প্রত্যেক মোবাইল অপারেটর এনআইডি ডাটাবেজের সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত করছে, যাতে তারা সরাসরি সেখানে ডাটা পাঠাতে পারে। বিটিআরসিতে একটি সেন্ট্রাল ভেরিফিকেশন সিস্টেম থাকবে, যেখানে সমন্বিত ডাটা থাকবে। একজন গ্রাহক রিটেইলারের কাছে গিয়ে এনআইডি, জন্মতারিখ এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেবেন। রিটেইলার অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে প্রথমে সেন্ট্রাল সিস্টেমে ডাটা পাঠাবে, সেন্ট্রাল সিস্টেম থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে এনআইডিতে যাবে। এরপর এনআইডি থেকে ভেরিফায়েড হয়ে জানা যাবে সঠিক কি না? যখন ভেরিফায়েড হয়ে আসবে তখন সেই ডাটা সেন্ট্রাল সিস্টেমে জমা হবে। তারপরই ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরা হবে। এই ভেরিফিকেশন সিস্টেম নতুন সিম নিবন্ধন, পুনঃনিবন্ধন, অ্যাক্টিভেশন, ডিঅ্যাক্টিভেশন এবং রি-অ্যাক্টিভেশনে ব্যবহার হবে।
আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ নিয়ে বিভ্রান্তি
তবে বাংলাদেশে এই কার্যক্রম শুরুর কিছুদিন পরই শুরু হয় বিতর্ক। এ পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এটি বন্ধের দাবিতে ফেসবুকে খোলা হয়েছে বেশ কিছু ইভেন্টও। সেখানে অনেকেই বলছেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করা হলে আঙ্গুলের ছাপ তৃতীয় পক্ষের হাতে চলে যেতে পারে। অনেকেই আবার বলছেন এসব আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে নিরীহ মানুষকেও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-- জড়ানো হতে পারে। কেউ কেউ আবার বলছেন, এসব আঙ্গুলের ছাপ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার হাতে চলে যেতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের পক্ষে-বিপক্ষে অনেককেই কথা বলতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘুরে আরও একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, তা হলো অনেকেই এখনও বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। অনেকেই ভাবছেন, নিবন্ধনের সময় দেয়া তার বায়োমেট্রিক তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে, এতে পরবর্তী সময়ে তিনি হয়তো বিপদে পড়তে পারেন।
এসব বিভ্রান্তি এড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিম নিবন্ধনের সময় একজন ব্যবহারকারীর আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণের কোনো উপায় নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর আঙ্গুলের ছাপ নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকা ডাটাবেজের সাথে শুধু মিলিয়ে দেখা হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজে থাকা আঙ্গুলের ছাপের সাথে মিলিয়ে ভেরিফাই করার জন্যই আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হচ্ছে।জিজ্ঞেস
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন নিয়ে বিভ্রান্তির প্রেক্ষিতে বাংলালিংকের পক্ষ থেকে সম্প্রতি জানানো হয়, বাংলালিংক কারও আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করছে না। বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশনে গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহে ব্যবহৃত কোনো যন্ত্র বা এই কাজে সংশ্লিষ্ট কোনো খুচরা বিক্রেতা কোনো গ্রাহকের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে না। গ্রাহকের তথ্য খুচরা বিক্রেতাদের ডিভাইসে দেয়ার পর তা অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভারে চলে যায়।
এদিকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন কর্মসূচি চালুর পর এখন পর্যন্ত ১ কোটির বেশি সিম নিবন্ধন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলালিংক। গ্রামীণফোন জানিয়েছে, তাদের মোট গ্রাহকের প্রায় ৪২ শতাংশ অর্থাৎ ২ কোটি ৩২ লাখ গ্রাহক ইতোমধ্যেই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রশন অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বায়োমেট্রিক তথ্য নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য এবং যেকোনো ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সময় খুবই ক্রুশিয়াল এভিডেন্স হিসেবে কাজ করে। তাই এর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ খুবই সংবেদনশীল। উন্নত বিশ্বে এই ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য শুধু সরকারের কাছেই থাকে। কারণ কোনো ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে থাকলে এর অপব্যবহার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে অনেক কোম্পানিই তার এমপ্লয়ীদের বায়োমেট্রিক তথ্য রাখে অ্যাটেন্ডেন্স বা অ্যাক্সেস কন্ট্রোলের জন্য। সুতরাং সাধারণভাবে মনে হতে পারে এতে ভয়ের কোনো কারণ নেই। কিন্তু কোনো কোম্পানির সীমিত এমপ্লয়ীর তথ্য আর সারাদেশের সবার বায়োমেট্রিক তথ্য রাখা ঠিক এক বিষয় নয়। এতে বিপদের সম্ভাবনা বা অপব্যবহারের সম্ভাবনা আসলে অনেক। তাই ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বায়োমেট্রিক তথ্য নেয়া ভালো উদ্যোগ, তবে তা গ্রহণ ও সংরক্ষণের পুরো দায়িত্ব সরকারের অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত