লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
দেশে বৈধপথে আনা যাবে ড্রোন: তৈরি হচ্ছে আমদানি নীতিমালা
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা মেনে বাংলাদেশে বৈধপথে ড্রোন আমদানির সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এতদিন খেলনা হিসেবে বাংলাদেশে ড্রোন আমদানি হতে দেখা গেছে কোনো বৈধ উপায় ছাড়াই। বিদ্যমান এ প্রেক্ষাপটে সরকার ড্রোন আমদানিকে বৈধতা দিয়ে এ সম্পর্কিত একটি আমদানি নীতিমালা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রণীতব্য এই নীতিমালা অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসেবে বৈধপথে ড্রোন আমদানি করা যাবে। খবরে প্রকাশ, এই আমদানি নীতিমালা ২০১৫-১৮ মেয়াদের আমদানি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ড্রোন আমদানির কোনো অনুমোদন না থাকলেও ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়। তবে বাংলাদেশের আকাশে ড্রোন চালাতে হলে মেনে চলতে হবে বিদ্যমান ড্রোন আইন-কানুন। যেমন- বাংলাদেশের আকাশে ড্রোন ওড়াতে চাইলে এ জন্য আগে থেকেই এ ব্যাপারে অনুমতি নিতে হবে। বাংলাদেশে জনবসতি বা জনসমাগম স্থলের ওপর দিয়ে ড্রোন চালানো যাবে না। ড্রোন চালানোর সময় অন্যদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। সামরিক কোনো স্থাপনা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর দিয়ে কিংবা এমন স্থান দিয়ে ড্রোন চালানো যাবে না, যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষক্ষর উদ্বেগের কারণ হতে পারে। দিনের আলো থাকা অবস্থায় ও ভালো আবহাওয়ার পরিবেশে ড্রোন চালাতে হবে। বিমানবন্দরের ওপর দিয়ে কিংবা কাছাকাছি যে এলাকা দিয়ে সাধারণত বিমান চলাচল করে, সেসব এলাকার ওপর দিয়ে ড্রোন চালানো যাবে না।
আর এ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় অনুমতি নিতে হবে ‘সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি, বাংলাদেশ’ তথা সিএএবি’র কাছ থেকে। উল্লেখ্য, সিএএবি কাজ করে বাংলাদেশের সব বিমান চলাচল সংক্রান্ত কর্মকা--র নিয়ন্ত্রক হিসেবে। এটি দেশের অ্যারোনটিক্যাল সার্ভিস প্রোভাইডারও। এ ছাড়া বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যকার ‘ফ্লাইট ইনফরমেশন রিজিয়নে’ (এফআইআর) বিমান চলাচল নিরাপদ রাখার দায়িত্বও বহন করে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ড্রোন আমদানি নিষিদ্ধ থাকলেও অবৈধ পথে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোট ছোট চালকবিহীন উড়ন্ত যান (আনম্যানড অ্যায়ারিয়েল ভেহিকল- ইউএভি) বা ড্রোন আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে সরকার এ ব্যাপারে একটি আমদানি নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরদিকে ভূমি জরিপ, ওপর থেকে নিচের ছবি তোলা, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক কাজে দেশে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে। খবরে প্রকাশ, ইতোমধ্যেই ড্রোন আমদানির অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় মন্ত্রণালয় থেকেও আমদানির কোনো অনুমতি এ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তা ছাড়া আমদানি নীতিমালায় ড্রোন আমদানি কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। এদিকে গত বছরের নভেম্বরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, এর পূর্ববর্তী তিন মাসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ৩৮টি চালকবিহীন ছোট উড়ন্ত যান বা ড্রোন আটক করে। আটকের পর কেউ এসব আটক ড্রোন ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য যোগাযোগ করেনি। এরপর গত বছরের ৩ নভেম্বরে আটক করা ১০টি ড্রোন চীনের তৈরি। ডেইজ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান এগুলো আমদানি করে খেলনা হিসেবে। আটক ড্রোনের ৯টি এসেছে চীনের একটি প্রযুক্তি কোম্পানি থেকে। এর ৭টি সিঙ্গাপুর এয়ালাইন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশে আমদানি করেন জনৈক মাশকুর রহমান। এসব ড্রোন বিমানবন্দরের কার্গো গুদামে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু আমদানি নীতিমালায় ড্রোন আমদানির সুযোগ না থাকায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্কনীতি বিভাগের এ সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনা নেই।
বিদ্যমান এই অচলাবস্থায় খুব শিগগিরই আমত্মঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি) মুন্সি শফিউল হক একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন- ড্রোন আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার একটি ড্রোন আমদানি নীতিমালা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নীতিমালা না থাকায় প্রয়োজন হলেও ড্রোন আমদানি করা যাচ্ছে না। এটি শুধু খেলনা হিসেবে নয়, এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের কাজে লাগছে। তিনি আরও জানান, ড্রোন আমদানির ব্যাপারে স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনদের সাথে বৈঠক করা হয়েছে। বৈঠক আরও হবে।
বাংলাদেশ ও ড্রোন
শুরুতে বাংলাদেশে কোনো যথার্থ ইউএএস ছিল না। এর সম্ভাব্য কারণ, এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক প্রাযুক্তিক সক্ষমতা ও গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থ, যা অর্জন থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ড্রোন নিয়ে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এর আকার ছিল অনেক বড়। এটি ছিল ফিক্সড উইংড আরসি বিমান। তাদের পোর্টেবল গাইডেড মিসাইলের টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্য এটি ব্যবহার হতো টার্গেটিং ড্রোন হিসেবে। এসব ড্রোনের বেশিরভাগই চীন ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা। সাধারণত এসব ড্রোনে কোনো সেন্সর ও ভিডিও ফিড কিংবা ছবি তোলার যন্ত্র ছিল না। সেনাবাহিনীর কিছু প্রকৌশলী এর সাথে ক্যামেরা জুড়ে দিতে সক্ষম হন। কিন্তু এর ছিল না কোনো গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন। এ ছাড়া এর কোনো অটোনোমাস ফিচারও ছিল না। কোনো উপায়ে এটিকে ড্রোন বলা যায় না।
কোয়াড-রটর অ্যায়ারিয়েল ভেহিকল বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। ২০১২ সালে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এআইইউবি) গ্র্যাজুয়েট কাওসার জাহান ও নাজিয়া আহসান ‘ডিজিটাল এক্সপো-২০১২’-এ প্রদর্শন করেন তাদের তৈরি কোয়াড-রটর ড্রোন। এটি প্রধানত তৈরি করা হয় তাদের ইউনিভার্সিটি প্রজেক্ট হিসেবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের দেশীয় ড্রোন তৈরির নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ৫০ হাজার টাকারও বেশি খরচ করে তৈরি এই ড্রোনের অপারেটিং রেঞ্জ দেড় কিলোমিটার। আর এটি উড়তে পারত ৬৫০ ফুট ওপর পর্যন্ত। এটিকে বেসামরিক কাজে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা সম্ভব।
এর অল্প কিছুদিন পর খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মামুন খান দীপ এককভাবে তৈরি করেন একটি কোয়াড-কপ্টার। তার কপ্টারটি ছিল রিমোট কন্ট্রোলড। এটি ৩০০ ফুট পর্যন্ত উড়তে সক্ষম ছিল। তার এই প্রকল্প বুয়েটের অনেক গবেষকের নজর কাড়ে। এরা সবাই মিলে ‘এয়ারো রিসার্চ সেন্টর (এআরসি) বাংলাদেশ’ নামে একটি টিম তৈরি করেন। এরা এরই মধ্যে তাদের ড্রোনের উন্নয়ন ও আরও দুই ধরনের ড্রোন তৈরি করেন- বাংলা-ড্রোন এবং ঘুরি১। এগুলো বাংলাদেশের প্রথম অটোনোমাস ড্রোন। এগুলো ঘুরে আসতে পারে তালিকাভুক্ত ওয়েপয়েন্ট। অধিকন্তু এর রয়েছে একটি গ্রাউন্ড সেন্টার, যা ড্রোনের উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য ব্যবহার করা যায়। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আনা যেকোনো প্রচলিত কোয়াড-কপ্টারের তুলনায় এগুলো তৈরি করা হয় অনেক কম খরচে। এআরসি কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের টেস্ট ফ্লাইট সম্পন্ন করেছেন। তারা এই ড্রোন তাদের গোয়েন্দা নজরদারির কাজে ব্যবহার করতে পারে। এগুলো এন্ট্রি লেভেলের বেসামরিক কাজে ব্যবহার উপযোগী ড্রোন।
এরপর বাংলাদেশের ড্রোন ডেভেলপারের এলাইট লিস্টে এসে যোগ দেয় শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। এরা এনেছে একটি ফিক্সড উইংড আরসি বিমান। এটি এখনও ফাঙ্কশনিং ড্রোন নয়। এই গবেষক দলের ড্রোন প্রজেক্টের টিম লিডার সৈয়দ রেজাউল হক আশা করছেন, কয়েক মাসের মধ্যেই এরা তাদের ড্রোনকে একটি আরসি প্লেনকে একটি সিভিলিয়ান গেডের ড্রোনে উন্নীত করতে পারবেন। এই ড্রোন সিস্টেমে থাকবে বেশ কিছু আপগ্রেড, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকছে গ্রাউন্ড স্টেশন, অনবোর্ড কন্ট্রোল সিস্টেম এবং এতে লাগানো হবে কিছু সেন্সর। একটি পরিপূর্ণ ড্রোন করে তুলতে এর অনেক কাজ এখনও সম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষায়।
আমরা কি সবকিছু পেয়ে গেছি?
না, অবশ্যই নয়। বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েটদের তৈরি প্ল্যাটফরমভিত্তিক ড্রোন নতুন হতে পারে, কিন্তু ড্রোনভিত্তিক ফটোগ্রাফি নিশ্চিয় নতুন নয়। ‘সিগনাস অ্যায়ারিয়েল ফটোগ্রাফি’ হচ্ছে নাঈমুল ইসলাম অপু নামে জনৈক নতুন পাইলটের একটি উদ্যোগ। তিনি অ্যায়ারিয়েল ফটোগ্রাফির ক্ষক্ষত্রে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা সার্ক অঞ্চলের জন্য একজন অগ্রদূত। বর্তমানে তার গ্রম্নপের রয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা বেশ কয়েকটি ড্রোন, যেগুলোতে রয়েছে বিশেষায়িত ফটোগ্রাফি যন্ত্রপাতি- GoPro3 Black Edition, CANON power shot ইতাদি। এরা কিছু কাজও করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে কানাডিয়ার ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইনভেস্টিগেটিভ ডকুমেন্টারিতে। এই প্রামাণ্যচিত্রে অপু ও তার দল রানা পস্নাজার কিছু অদৃশ্যপূর্ব অ্যায়ারিয়েল ফুটেজ উপস্থাপন করে। ৪০ হাজার টাকা খরচ করে যেকেউ প্রয়োজনে অপু ও তার টিমের অ্যায়ারিয়েল ফটোগাফি সার্ভিস পেতে পারেন।
আরসি খেলনা বনাম ড্রোন
স্বাভাবিকভাবেই কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বাজারের একটি আরসি খেলনা ও একটি ড্রোনের মধ্যে পার্থক্যটা কী? আইনগত দিক থেকে বলা যায়, হবি ক্র্যাফটস বা শখের খেলনাকে ভূমি থেকে ৪০০ ফুটের বেশি ওপরে উড়তে দেয়া হয় না। অতএব আপনি যদি দেখেন এরচেয়ে বেশি উচ্চতায় কোনোটি উড়ছে, তবে ধরে নেবেন এটি সম্ভবত একটি ড্রোন। একটি আরসি বিমানকে অবশ্যই এর অপারেটরের দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকতে হয়। অপরদিকে একটি ড্রোন চলে যেতে পারে তার কাছ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। যেটিকে সরকারি সম্পদ ধ্বংস করার কারণে আটক বা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়, নিশ্চিতভাবে জানতে হবে এটি একটি ড্রোন, আরসি খেলনা নয়।
শেষকথা
ড্রোনবিষয়ক ও অন্যান্য ক্ষক্ষত্রে এবং বহুমুখী কাজে ব্যবহারের জন্য ড্রোন আমদানির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তাই ড্রোন আমদানির ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এই আমদানি নীতি প্রণয়নের সরকারি সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকই বিবেচনা করতে হবে। তবে কাজটি অতি দ্রুত সম্পন্ন হওয়া দরকার