লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৭ - ফেব্রুয়ারী
উত্তর প্রজন্মের সেরা ৪ উদ্ভাবন
ওদের বিচরণ এখনও স্কুল-কলেজের আঙিনায়। চুলে খেলা করে দুরন্ত কৈশোর। চোখের অতলামেত্ম সাঁতরে বেড়ায় মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন। স্বপ্নগুলো অনেক বড়। তারচেয়ে আরও বড় জীবনের স্বপ্নপূরণে প্রচেষ্টার মাত্রা। সেই তীব্রতায় প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের বাহাদুরি নিয়ে ওরা চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে! গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এই বাস্তবতার দেখা মিলল রাজধানীর ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত ৩৬ ঘণ্টার স্পেস অ্যাপস নেক্সট জেন চ্যালেঞ্জ হ্যাকাথনে। লাল-কমলা-হলুদ টি-শার্টের ঔজ্জ্বল্য ছাপিয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আলোয় জীবন রাঙাতে ভবিষ্যৎ স্বপ্নপূরণের মঞ্চ হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। এই মঞ্চে পুরস্কৃত হয় চৌকস ক্ষুদে উদ্ভাবকদের সেরা চার উদ্ভাবন। এদের মধ্যে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ক্ষুদে উদ্ভাবকেরা ‘সার্চ বোট’ নিয়ে বেস্ট ইউজ অব ডাটা বিভাগে, উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা মোস্ট ইন্সপাইরেশনাল বিভাগে ফ্লোটিং সিটি উপস্থাপন করে, ‘অক্সোমাস্ক’ নিয়ে বেস্ট মিশন কনসেপ্ট বিভাগে রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের উদ্ভাবকেরা এবং ইকো ফ্রেন্ডলি সোর্স অব ইলেক্ট্রিসিটি এনার্জি নিয়ে গ্যালাটিক ইমপ্যাক্ট বিভাগে সেরা হয়েছে ফেনী সেন্ট্রাল হাই স্কুলের দল।
স্পেস অ্যাপস নেক্সট জেন : মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ওপেন ডাটানির্ভর ৩৬ ঘণ্টার একটি হ্যাকাথন স্পেস অ্যাপস নেক্সট জেন। এই প্রতিযোগিতা পরিচালনায় সহায়তা করে নাসার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘সেকেন্ড মিউজ’ (Second Muse)। তিনটি ভিন্ন বিভাগে (প্রথম-চতুর্থ শ্রেণী, পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণী, নবম-দ্বাদশ শ্রেণী) শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এই আয়োজন করা হয়। জয়ী প্রতিটি দল পরবর্তী সময় ৫টি দেশে আয়োজিত এই হ্যাকাথনের বিজয়ীদের সাথে তাদের দক্ষতার প্রমাণ দেয়ার সুযোগ পাবে। সর্বশেষ চূড়ান্ত বিজয়ীদের স্পেস অ্যাপস নেক্সট জেন সেকেন্ড মিউজের ওয়াশিংটন ডিসির প্রধান কার্যালয় থেকে সার্টিফিকেট এবং পুরস্কার দেয়া হবে।
বাংলাদেশের স্পেস অ্যাপস নেক্সট জেন : রাজধানীর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে গত ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ৩৬ ঘণ্টার নাসা অ্যাপস নেক্সট জেন হ্যাকাথন। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হলেও এর আগে বিশ্বের ৫টি দেশ আন্তর্জাতিক এই হ্যাকাথনের আয়োজন করেছে। সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় সারাদেশ থেকে ৮৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে আসা প্রায় ৪শ’র বেশি প্রজেক্ট থেকে ১শ’ প্রজেক্ট নিয়ে বুট ক্যাম্প সম্পন্ন হয়। পরবর্তী সময় শীর্ষ ৩৫টি প্রজেক্ট নিয়ে ফাইনাল হ্যাকাথন অনুষ্ঠিত হয়। এই আয়োজনে সহযোগিতা করে মাইক্রোসফট পিবাজার ডটকম, রিটস অ্যাডস, বাগডুম, ডাটা সফট, স্পেস অ্যাপস বাংলাদেশ, রাইজ অ্যাপ ল্যাবস ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। প্রতিযোগিতা বিষয়ে বিচারক প্যানেলের প্রধান রফিকুল ইসলাম রাওলি বলেন, আমাদের বাচ্চারা বিশ্বমানের প্রজেক্ট করে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলতে পারবে, যা এই বিচার করতে গিয়ে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। এমন মেধার মেলা নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক উদ্ভাবনের দেখা পাবে বলে আশা করছি।
সার্চ বট : আমান্তু খান, ফারহান তানভীর, রাহাত রেদোওয়ান ও মুস্তাভি ইবনে মাসুম। মহাকাশে প্রাণীর অস্তিত্ব শনাক্তে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর এই চার সহপাঠী উদ্ভাবন করেছে ‘সার্চ বট’। তাদের এই বটটি চলমান প্রাণী এমনকি ইউএফও-কেও অনুসরণ করতে পারে বলে জানায় দলনেতা আমান্তু। শব্দের ১০ গুণ বেশি বেগে চলতে পারে সার্চ বট। যন্ত্রটিতে ব্যবহার করা হয়েছে একটি মেগা ৩২৮পি মাইক্রোকন্ট্রোলার। আমান্তু জানায়, আপাতত বস্নু-টুথ সংযোগ ব্যবহার করা হলেও নাসার সহায়তা পেলে এই প্রটোটাইপে তারা স্যাটেলাইট বা লং রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করবে। স্কুলে যাতায়াতের টাকা আর টিফিনের পয়সা দিয়ে তারা এই প্রটোটাইপের সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে পাটুয়াটুলি থেকে।
ভাসমান নগর : বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। সেই সাথে সমুদ্রের উচ্চতা। এর ফলে হাতছানি দিচ্ছে পৃথিবীর বিসত্মীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা। তাই আগেভাগেই বসবাসের নিরাপদ আবাস হবে ভাসমান নগর। নদীর ওপর নির্দিষ্ট উচ্চতায় পিলারের মাধ্যমে তৈরি হবে ফ্লোটিং সিটি। আর এই নগরের পরিকল্পনা করেছে আমাদের উত্তর-প্রজন্ম। আর এই স্বপ্নবাজেরা হলো উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুম চৌধুরী, সাইয়্যেদ চৌধুরী জিসান ও হাসিবুল হক। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত স্পেস অ্যাপস নেক্সট জেনে অংশ নিয়ে এই ক্ষুদে উদ্ভাবক অঙ্কের হিসাব কষে দেখিয়ে দিয়েছে এখনই যদি ভাসমান নগরী গড়ে তোলা না যায়, তবে খরচা যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে ঝুঁকিও।
অক্সোমাস্ক : একদিন পানিতে পড়ে যায় সাঁতার না জানা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম। এরপরই তার মাথায় প্রশ্ন আসে পানিতে অক্সিজেন থাকার পরও কেন পানিতে পড়ে গিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। এই সমস্যার সমাধান করতে তার সঙ্গী হয় সহপাঠী নিয়ামুল ইসলাম শিমুল, ইনাম রহমান মিম ও মিনহাজুল ইসলাম। উদ্ভাবন করে বিশেষ ধরনের মাস্ক অক্সোমাস্ক। এটি পরে ডুবুরিদেরকে পানির নিচে ড্রাইভ করার সময় পিঠে ঢাউস আকারের সিলিন্ডার বহন করতে হবে না। ব্যাটারি ও রাসায়নিক সাহায্য ছাড়াই ব্যাপন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন তৈরি করে তা মাস্কের মাধ্যমে সরবরাহ করে। এজন্য তারা মাত্র ২০০ মিলি ট্যাঙ্কে ৪ শতাংশ নাইট্রোজেন ব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল গিলসের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপাদন করেছে, যা দিয়ে পানির নিচে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারবেন ডুবুরিরা।
রস্তায় তৈরি হবে বিদ্যুৎ : রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যখন উত্তপ্ত রাজপথ, তখন স্পেস অ্যাপস নেক্সট জেন হ্যাকাথনে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতের অভিনব উৎসের সন্ধান দিয়েছে ফেনী সেন্ট্রাল হাই স্কুলের দুই সহপাঠী আরাফাত জামিল ও তানভীর হাসান। তারা মহাসড়কের গতি নিরোধক, উঁচু-নিচু স্থান এবং সেতু সংযোগে ‘পায়াজো বাজার’ নামে বিশেষ ডিভাইস বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও তা সরবরাহের দারুণ একটি কৌশল বাতলে দিয়েছে। এই প্রযুক্তিতে গাড়ির চাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা পাশেই সংরক্ষণ করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে চায় এই ক্ষুদে উদ্ভাবকেরা।
বিজয়ীদের প্রকল্প বাস্তবায়নে আয়োজক বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা আরিফুল হাসান অপু জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই আমরা বিজয়ী প্রকল্পগুলোকে নাসার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, ক্ষুদে উদ্ভাবকদের স্বপ্নের কুঁড়িগুলো যেনো আগামীতে ফুল হয়ে প্রস্ফুটিত হতে পাওে, সে জন্য এবার আমরা বিজয়ীদের স্কুলগুলোতে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে উচ্চমানের একটি করে ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। ৩-৬ মাসের অ্যাক্সেলেটর প্রোগ্রামের মাধ্যমে তাদের মেধাকে আরও শানিত করার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যেই আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিজয়ীদের ৫ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এটা এখন কীভাবে তাদের উদ্ভাবনায় কাজে লাগানো যায়, তা ঠিক করা হচ্ছে। তবে এই ক্ষেত্রে ভালো ফল পেতে অভিভাবকদেরকে আরও এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে আরিফুল হাসান জানান, ইতোমধ্যেই প্রতিযোগিতার আয়োজক প্রতিষ্ঠান সেকেন্ড মিউজ ভাসমান নগর ও রাস্তায় বিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা ওদের ভিডিও ইন্টারভিউ চেয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষুদে উদ্ভাবকদের চিম্মার মেলায় নতুন স্বপ্নের বিকাশ তাই এখন সময়ের অপেক্ষা। ভিন্ন ভিন্ন এই প্রজেক্টগুলোর সঠিক বাস্তবায়নে হয়তো উন্মোচন হতে পারে নতুন কোনো ভবিষ্যতের। সে লক্ষে্যই এ বছরের অক্টোবর নাগাদ আবারও এই আন্তর্জাতিক হ্যাকাথনের আয়োজন করা হবে