লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
মানুষের চিন্তা ধরা পড়বে কমপিউটারে
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং রূপকথার গল্পে এমন কিছু যন্ত্র এবং ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যে বা যারা মানুষের গোপন কথা অলৌকিক ক্ষমতাবলে জেনে নিতে পারে৷ এদেরকে কখনো বলা হয় গণক, আবার কখনোবা ডাইনি কিংবা সাধক৷ কল্পনায় নয়, বিজ্ঞানীরা বাস্তবিকই এমন যন্ত্র উদ্ভাবনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, যে যন্ত্রটি মানুষের মনের গভীর থেকে তার চিন্তা, পরিকল্পনা বা ভাবনাকে বের করে আনবে৷ এখনো এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি৷ তবে গবেষকরা বলছেন, মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে সুনির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনা ঠিক কিভাবে কাজ করে, তা পরিপূর্ণভাবে জানার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তারা৷ আর এই জানাটাকেই ব্যবহার করে এমন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো হবে, যার ফলে কমপিউটার পড়ে ফেলতে সক্ষম হবে মানুষের চিন্তা৷ এ ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা ফল প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্স-এ৷ গবেষকরা এখন কাজ করছেন কমপিউটেশনাল মডেলিং নিয়ে৷ তথ্য এবং চিন্তা-ভাবনা মস্তিষ্ক যেভাবে প্রসেস করে কমপিউটারও যাতে সেভাবে কাজ করতে পারে সে জন্য চেষ্টা চলছে৷
কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার বিজ্ঞানী টম মিচেল এবং স্নায়ু বিজ্ঞানী মার্সেল জাস্ট এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন৷ তাদের করা এর আগের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, কোনো ব্যক্তি যখন কোনো সুনির্দিষ্ট একটি শব্দ নিয়ে চিন্তা করে তখন মস্তিষ্কে যে স্পন্দন তৈরি হয় তা ধরতে এবং চিহ্নিত করতে পারে ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এফএমআরআই)সিস্টেম৷ তাদের এই গবেষণায় সহায়তা করেছে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (এনএসএফ) এবং ডবিউ এম কেক ফাউন্ডেশন৷ গবেষকরা সেই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এখন একটি কমপিউটেশনাল মডেল উদ্ভাবন করেছেন, যা একটি কমপিউটারকে সেই শব্দ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে, যে শব্দটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির মস্তিষ্কে চিন্তা করা হয়েছে৷
জাস্ট এবং মিচেল সম্প্রতি এফএমআরআই ডাটা ব্যবহার করে আরো স্পর্শকাতর কমপিউটেশনাল মডেল উদ্ভাবন করেছেন, যা মস্তিষ্কের কার্যক্রম ধরতে সক্ষম৷ কোনো সুনির্দিষ্ট শব্দ এফএমআরআই ডাটায় না থাকলেও মস্তিষ্কের চিন্তা থেকে তা বের করে আনা সম্ভব এই পদ্ধতিতে৷ গবেষকরা প্রথমে যে মডেল তৈরি করেন তাতে ১২টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ৬০টি নাউন বা বিশেষ্য দিয়ে এফএমআরআই অ্যাকটিভেশন প্যাটার্ন করা হয়৷ ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যে রয়েছে পশু-পাখি, দেহের অঙ্গ, ভবন, পোশাক, পতঙ্গ, যানবাহন এবং শাকসবজি৷ এই মডেলের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক রচনা বা এক ট্রিলিয়নেরও বেশি শব্দ রয়েছে এমন রচনাবলী বিশ্লেষণ করা হয়েছে৷ তারপর দেখা গেছে কমপিউটার হাজার হাজার বিশেষ্যর ব্রেন অ্যাকটিভিটি প্যাটার্ন চিহ্নিত করতে পারছে৷
গবেষকরা বলছেন, যেখানে অ্যাকচুয়াল অ্যাকটিভেশন প্যাটার্ন জানা যাচ্ছে সেখানে কমপিউটার মডেলের প্রিডিকশন বা ভবিষ্যদ্বাণীর সঠিকতা তাত্পর্যপূর্ণভাবেই বেশি৷ প্রতিটি লোকের মস্তিষ্কের অ্যাকটিভেশন প্যাটার্ন দেখতে কেমন হবে কমপিউটার তা কার্যকরভাবেই বলে দিতে সক্ষম হবে৷
টম মিচেল বলেছেন, কোনো শব্দ বা বাক্য অর্থবহ করতে মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে আমাদের বিশ্বাস আমরা তার বেশ কিছু বেসিক বিল্ডিং ব্লক চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি৷ আর এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে কমপিউটেশনাল মেথড৷ কোনো রচনায় কোনো শব্দ কিভাবে ব্যবহার হতে পারে এই মেথড তা বলে দিতে পারে৷ এই বিল্ডিং ব্লকগুলো কোনো নাউন বা বিশেষ্যর নিউরাল অ্যাকটিভেশন প্যাটার্ন তৈরি করতে সক্ষম৷ তিনি বলেন, আমরা দেখেছি এফএমআরআই ডাটা থাকলে শব্দ চিহ্নিতকরণ প্রশ্নে কমপিউটারের ভবিষ্যদ্বাণী অনেক বেশি সঠিক হয়ে থাকে৷
মার্সেল জাস্ট বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তাদের কমপিউটেশনাল মডেল মানুষের চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতির ভেতরকার জিনিসটি বের করে আনতে পারবে৷ তিনি বলেন, মানুষ মৌলিকভাবেই অন্তর্মুখী এবং অভিনেতা৷ অনেক সময় সে ভাবে একটা, কিন্তু বলে আরেকটা৷ বিষয়টি এমনিতে বুঝার উপায় নেই৷ কোনো শব্দ বা বাক্য সে প্রকৃত অর্থেই বলেছে, নাকি এটা তার অভিনয় তা চিহ্নিত করে ফেলা যাবে তাদের মডেল ব্যবহার করে৷ অর্থাত্ এ পদ্ধতির চূড়ান্ত সংস্করণ বা সাফল্য যখন এসে যাবে তখন কেউ মিথ্যা বললে ধরা পড়ে যাবে৷ আরো বহুবিধ সুবিধা মিলবে নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে৷ তিনি বলেন, আমাদের কাজটি ছোট, কিন্তু মস্তিষ্কের কোড ভাঙ্গার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
কার্নেগি মেলনের গবেষকরা মস্তিষ্কের সেন্সরি মোটর এলাকা ছাড়াও মস্তিষ্কের সামনের অংশসহ অন্যান্য এলাকার কার্যক্রম সম্পর্কেও তাত্পর্যপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন৷ মস্তিষ্কের সামনের অংশ দিয়েই পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী তথ্য সংরক্ষণের কাজটি করা হয়ে থাকে৷ যখন কেউ একটি আপেল নিয়ে চিন্তা করবেন, তখন তার মস্তিষ্ক প্রথমেই খুঁজে বের করবে যে সর্বশেষ তিনি কবে আপেল খেয়েছেন, কিংবা কিভাবে আপেল যোগাড় করা যায়৷ এ থেকে বুঝা যায় যে মস্তিষ্কের কার্যক্রম একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে কাজ করে৷ ব্যক্তিভেদে প্যাটার্ন কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, তবে মৌলিক কাঠামোতে সম্ভবত কোনো ভিন্নতা নেই৷ গবেষকদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি যখন কাজে ব্যবহারের উপযোগী হবে তখন মানুষের চিন্তাভাবনা চিহ্নিত করতে ব্রেন স্ক্যান এবং অটিজম, স্কিটসোফেনিয়াসহ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য মস্তিষ্কসংশ্লিষ্ট রোগ নিয়ে গবেষণার কাজ করা সহজ ও কার্যকর হবে৷ কেনো এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ তা বুঝতে পারা যাবে এবং মস্তিষ্কের কোন অংশের কি ধরনের কার্যক্রম এমন রোগ থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে তা বেরিয়ে আসবে৷ ফলে চিকিত্সাশাস্ত্রে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন৷
ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, গবেষকদের এই আবিষ্কারে তারা উত্ফুল এবং উদ্দীপ্ত৷ প্রোগ্রাম অফিসার কেনেথ ওয়াং বলেন, এটি একটি তাত্পর্যপূর্ণ প্রকল্প৷ আমরা লক্ষ করছি এ ব্যাপারে আরো কি অগ্রগতির খবর আসে সেদিকে৷ তিনি বলেন, গবেষকদ্বয় কিছু মৌলিক ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন৷ তাদের লক্ষ্য ছিলো এমন উপায় বের করা যাতে মেশিন কোনো বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে৷ এ কাজটি করতে গিয়ে তারা এমন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফেলেছেন যে, উদ্ভাবিত পদ্ধতি মস্তিষ্কে ভাষার কার্যক্রম সম্পর্কে বুঝতে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে৷ মস্তিষ্ক কিভাবে ভাষার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে তা বুঝতে পারা খুবই জটিল বিষয়৷ আর এই জটিল বিষয়টি এখন অনেকটাই বুঝা সম্ভব হচ্ছে গবেষকদের নতুন কমপিউটেশনাল মডেল ব্যবহার করে৷
তার বিশ্বাস মিচেল এবং জাস্টের এই গবেষণা কমপিউটেশনাল নিউরোসায়েন্স গবেষণার ক্ষেত্রে আরো গতি সঞ্চার করবে৷
সোজা কথায়, মানুষ যা ভাবছে তা তার পক্ষ থেকে প্রকাশ করে দেবে কমপিউটার৷ কিংবা মানুষ যা বলতে চাইছে না, কিন্তু তার মস্তিষ্কে বিষয়টি রয়েছে তাও বের করে আনা যাবে৷ বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণা চলছে৷ তাই এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি পেতে আরো কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে বৈকি৷
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com