লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মাহফুজ আরা তানিয়া
মোট লেখা:৪
লেখকের নাম:
নিজস্ব প্রতিবেদক
মোট লেখা:১৪৪
লেখা সম্পর্কিত
আমার ইন্টারনেট আমার আয় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন
আমার ইন্টারনেট আমার আয় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন
আচ্ছা শেষ কবে প্রযুক্তিবিহীন একটি দিন কাটিয়েছেন! যদি কাটিয়ে থাকেন, নিশ্চয়ই সেই দিনটি আপনার জীবনে ‘স্মরণীয় দিন’ হয়ে আছে!
না একদম ঠাট্টা নয়! প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তির অভাবনীয় সৃষ্টি ‘ইন্টারনেট’ রাজত্ব করছে সারা বিশ্বে। সেই দিনবদলের ছোঁয়া লেগেছে আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশেও। আজ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসায়-বাণিজ্য, কৃষি খাতে লেগেছে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সাধারণ জনগণ সেই ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা উপভোগ করছে।
ইন্টারনেট শুধু জীবনযাত্রাকেই সহজ করেনি, বরং অনেক মানুষের আয়ের পথও করে দিয়েছে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ফ্রিল্যান্সিং একটি বহুল আলোচিত শব্দ। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাহায্যে খুব সহজেই ঘরে বসে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে আয় করা যায়। বাংলাদেশের তরুণেরা অনেক আগেই এই ফ্রিল্যান্সিং ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য, নতুন দিনের এই পেশাতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ একদমই উল্লেখযোগ্য নয়।
ভিশন ২০২১-এর রূপকল্প অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তাই নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।
নারীদেরকে ডিজিটালি সক্ষম করে তুলে এবং কার্যকর জনশক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমেই এই ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা সম্ভব। আর তার ফলেই আমরা দ্রুত অর্জন করতে পারব আমাদের প্রত্যাশিত ডিজিটাল বাংলাদেশ।
সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিপুলসংখ্যক নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির সাথে আরো বেশি মানানসই এবং স্বাবলম্বী করে তুলতে দেশব্যাপী নারীদের ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং দেয়ার কর্মসূচি হাতে নেয় জাতীয় মহিলা সংস্থা। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম এনডিসি এবং মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক মমতাজ বেগম অ্যাডভোকেটের উদ্যোগে মহিলা সংস্থার জেলাভিত্তিক কমপিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া মেয়েদের নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং কর্মসূচি হাতে নেয় জাতীয় মহিলা সংস্থা। আর এই প্রশিক্ষণের নামই ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’।
এক ঝলকে জাতীয় মহিলা সংস্থার অন্যান্য প্রকল্প
কোনো সন্দেহ নেই, নারীদেরকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যকে দূর করে এবং তাদের মধ্যে সমতা সৃষ্টি করতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বদ্ধপরিকর।
‘শেখ হাসিনার বারতা
নারী-পুরুষ সমতা’
এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দেশব্যাপী নারীদের বিভিন্ন কর্মমুখী বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত জাতীয় মহিলা সংস্থা। জাতীয় মহিলা সংস্থার কর্মসূচিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ৬৪ জেলায় মহিলাদের কমপিউটার প্রশিক্ষণ দেয়া। এই কার্যক্রম জাতীয় মহিলা সংস্থা শুরু করে ২০০২ সাল থেকে। বেসিক কমপিউটার প্রশিক্ষণের আওতায় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই উন্নতমানের ল্যাব এবং ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করে ছয় মাস মেয়াদী ট্রেনিং কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে সংস্থাটি। যেখানে মূলত মাইক্রোসফট অফিস প্রোগ্রাম নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে।
একটু পেছনে তাকালে আমরা দেখব, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকার নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কেউ পড়ালেখা শেষ করে বেকার হয়ে আছেন, কেউ পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে কাজের কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না, আবার কেউ সংসার ও সন্তান দেখভাল করতে গিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার বা আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন না। ঠিক এ রকম যখন বাংলাদেশের হাজারো নারীর অবস্থা, তখন বাংলাদেশের নারীদের জন্য প্রয়োজন এমন এক প্রশিক্ষণ, যার মাধ্যমে তারা ঘরে বসেই কাজ শিখে আয় করতে পারবেন!
আর এমনই একটি পেশা ফ্রিল্যান্সিং। সারা বিশ্বে ফ্রিল্যান্সিং এখন অনেক জনপ্রিয় একটি পেশা। আউটসোর্সিং করে হাজারো তরুণ-তরুণী নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলছে। কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা এই পেশায় এখনও অনেক পিছিয়ে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে নারীরা যখন বড় বড় চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন তখন এত বড় একটি জনগোষ্ঠী কেন ফ্রিল্যান্সিং থেকে দূরে থাকবে? গেøাবাল এই পেশা থেকে নারীদের দূরত্ব কমাতেই বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় জাতীয় মহিলা সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’-এর মতো কর্মসূচি বাস্তবায়নের। এই উদ্যোগের ফলে নারীরা নতুন দিনের ডিজিটাল পেশাসমূহ সম্পর্কে জানবেন। নিজেরাই ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে গোলবাল মার্কেটপ্লেসে প্রতিযোগিতা করতে এবং আয় করতে পারবেন।
এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে জাতীয় মহিলা সংস্থার সাথে সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে কমজগৎ টেকনোলজিস। এই কর্মসূচিকে সফল করতে কমজগৎ টেকনোলিজস টিমের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন জাতীয় মহিলা সংস্থার ডেপুটি ডিরেক্টর শারমিন আক্তার, যিনি ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচির প্রজেক্ট ডিরেক্টরও।
কী প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এই কর্মসূচিতে?
‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচির আওতায় সারা দেশের ৬৪ জেলায় পর্যায়ক্রমে ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। মোট দুই বছরে এই ৬৪ জেলাতে এই ট্রেনিং দেয়া হবে।
এই কর্মসূচিতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ যেমন ডাটা এন্ট্রি, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ই-কমার্স বিজনেসের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের ৫ তারিখে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। এর ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ৬ নভেম্বর থেকে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়। প্রথম ধাপেই একসাথে ৮টি জেলায় ট্রেনিং কার্য শুরু করা হয়েছিল। এখন অবধি মোট ৩০টি জেলায় এই ট্রেনিং সম্পন্ন করা হয়েছে।
প্রতিটি জেলায় তিন ধাপে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে প্রশিক্ষণার্থীরা ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইনে ২২টি লাইভ ক্লাসে অংশগ্রহণ করেন। অনলাইন ক্লাস শেষে ট্রেইনারেরা প্রতিটি জেলায় গিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের ৬টি মুখোমুখি ক্লাস নেন। মুখোমুখি ক্লাসে মূলত অনলাইন ক্লাসের সমস্যাসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। এর পরের চার মাস প্রশিক্ষণার্থীদেরকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী প্রজেক্ট দেয়া হয়। এই চার মাসের মধ্যে প্রশিক্ষণার্থীরা তাদের প্রজেক্ট সাবমিট করবেন। প্রজেক্ট সম্পন্ন করার সময়ে তারা যেকোনো সমস্যায় প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে অনলাইন সাপোর্ট পাবেন। ধারণা করা যায়, এই চার মাস প্রজেক্ট সাপোর্টের পরেই মনোযোগী এবং আগ্রহী শিক্ষার্থীরা ফাইবার, আপ ওয়ার্কিং বা ফ্রিল্যান্সার ডটকমের মতো আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসগুলো থেকে কাজ করে অর্থ উপার্জন করার মতো দক্ষতা অর্জন করবেন।
এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি জেলা থেকে ৩৬ জন করে সারা দেশে মোট ২৩০৪ জন প্রশিক্ষণার্থী এই ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং গ্রহণ করবেন। শুধু মহিলা সংস্থার জেলাভিত্তিক কমপিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ব্যাচ থেকে পূর্বে প্রশিক্ষণ নেয়া মেয়েরাই এই প্রশিক্ষণের জন্য বিবেচিত হবেন।
ভার্চ্যুয়াল ক্লাস : এই প্রশিক্ষণের এক অনন্য ধাপ
‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচির অধীনে প্রথম ধাপে প্রশিক্ষণার্থীদের ২২টি অনলাইনভিত্তিক লাইভ ক্লাস নেয়া হয়। এই ক্লাসসমূহকে ‘ভার্চ্যুয়াল ক্লাস’ বলা হয়। ফেসবুকে প্রতিটি জেলার জন্য আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে সেই গ্রুপের এই লাইভ ক্লাসগুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশব্যাপী, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের কথা বিবেচনা করে ফেসবুক গ্রুপে এই ডিজিটাল ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষকের গলার স্বর শুনতে পান এবং প্রশিক্ষকের কমপিউটারের স্ক্রিন দেখতে পান। যেকোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হলে কমেন্ট করলেই প্রশিক্ষকের সাথে সাথেই সেই কমেন্ট দেখে তার উত্তরও দিয়ে দেয়।
ভার্চ্যুয়াল ক্লাস বা অনলাইনে লাইভ ক্লাসের কনসেপ্টটি শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন অঙ্গন। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীরা এখন লাইভ ক্লাসের মাধ্যমেই পড়াশোনা করেন। এছাড়া বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এই ধরনের ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের উচ্চতর ডিগ্রিও দিয়ে আসছে। ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের জন্য খালি একটি ডিভাইস আর সেই ডিভাইসে ইন্টারনেট সংযোগ লাগবে। আপনি যেকোনো স্থানে আপনার ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন নিয়ে বসে যেতে পারেন এই ভার্চ্যুয়াল ক্লাস করতে।
‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের প্রশিক্ষণার্থীরা শিক্ষাক্ষেত্রের এই নতুন ধারার সাথে পরিচিত হতে পেরেছেন। ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া যে শুধুই বিনোদনের মাধ্যম নয়, এই মাধ্যম থেকে নিজেদের দক্ষতাকে আরো শানিত করা যায়, তা তারা এই লাইভ ক্লাস প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন।
তাছাড়া অনেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছে এই প্রতিবেদক কথা বলে জানতে পেরেছেন ভার্চ্যুয়াল লাইভ ক্লাস তাদের জন্য সুবিধাই বয়ে এনেছে। সংসারের কাজের ফাঁকে, অফিসের ব্রেকটাইমকিং বা বাচ্চাকে স্কুলে দেয়ার পর ফ্রি সময়টুকুর মধ্যেই তারা লাইভ ক্লাসে এসে প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছেন। তাদের কষ্ট করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়নি। আবার লাইভ ক্লাস হওয়ার কারণে ভিডিও টিউটোরিয়ালগুলো গ্রুপেই ‘ধাব’ করে রাখা হয়েছে। তাই যখন-তখন ক্লাসের ভিডিওগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিজের শেখাকে আরো ঝালাই করতে পারছেন।
খাগড়াছড়ি জেলার প্রশিক্ষণার্থীরা প্রায় সময়ই ইন্টারনেট প্রতিকূলতার জন্য সঠিক সময়ে লাইভ ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তী সময় যখনই তারা ইন্টারনেট পেয়েছে, ফেসবুক গ্রুপে এসে পুরনো ভিডিও থেকে ক্লাসের বিষয়বস্তু বুঝে নিয়েছেন।
ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এখানে ডিসট্যান্স লার্নিং হয়। অর্থাৎ সব জায়গায় সব ধরনের প্রশিক্ষককে আমরা সামনাসামনি পাই না। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে আমরা ঠিকই তাদের প্রশিক্ষণ নিতে পারি। বাংলাদেশে বসে যেকোনো শিক্ষার্থী ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে আমেরিকার কোনো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ক্লাস করতে পারবেন। ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে এতে কমিউনিকেশন খরচ অনেকাংশে কমে যায়। আপনাকে কোনো জায়গায় গিয়ে এই ক্লাসগুলো করতে হবে না। যেকোনো স্থানে বসেই আপনি ক্লাস করতে পারবেন। এতে অনেক সময়ও বাঁচে। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা চাইলে ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের শিক্ষামূলক-সংক্রান্ত ভিডিওগুলো আজীবনের জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন। তারা যদি কখনো পুরনো পড়া ভুলেও যান, এই ভিডিওগুলো দেখে দেখেই আবার নতুন করে পড়া শুরু করতে পারবেন।
সারা বিশ্বে সময়ের সাথে সাথে অনলাইন ক্লাসগুলো ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দিন যত যাবে, তত শিক্ষার্থীরা নির্ভর হয়ে পড়বে ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের ওপর। তাই এই কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীরাও নতুন দিনের এই কনসেপ্টের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে, যা তাদের ডিজিটাল শিক্ষাকে আরো প্রশস্ত করে তুলবে।
২৪/৭ অনলাইন সাপোর্ট : প্রশিক্ষার্থীদের জন্য নতুন এক প্রাপ্তি
সাধারণত যেকোনো ট্রেনিংয়ে আপনি একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর নিজে পড়ার সময়ে ওই সংক্রান্ত কোনো সমস্যা দেখা দিলে আপনাকে পরবর্তী ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এখানেই ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ প্রশিক্ষণটি একটি অনন্যতা সৃষ্টি করেছে। প্রশিক্ষকরা ২৪/৭ অনলাইন সাপোর্ট নিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের পাশে রয়েছেন। নিজেদের কাজ করার সময়ে যেকোনো সমস্যায় তারা অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রশিক্ষকদের সহায়তা পান। একটি নির্দিষ্ট ফেসবুক চ্যাট গ্রæপে প্রশিক্ষণার্থীরা তাদের প্রজেক্ট এবং কাজ সংক্রান্ত আলোচনা করেন। একে অপরের সমস্যায় সমাধান দিতে এগিয়ে আসেন। এতে করে প্রতিটি জেলায় ফ্রিল্যান্সিং জানা নারীদের একটি কমিউনিটি তৈরি হচ্ছে, যারা পরবর্তী সময়ে অন্য নারীদের ক্ষেত্রে সহায়ক এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
২৪/৭ অনলাইন সাপোর্ট শিক্ষাক্ষেত্রের আরেকটি অনন্য রূপ। আর এই নতুন রূপের সাথে ইতোমধ্যে পরিচিত হয়েছেন এই কর্মসূচির প্রশিক্ষণার্থীরা। এতে নিজেদের ঋদ্ধ করার পাশাপাশি তারা উন্নত বিশ্বের Quality education সম্পর্কেও অবহিত হচ্ছেন।
প্রশিক্ষণার্থীরা যা পাচ্ছেন এই প্রশিক্ষণ থেকে?
অনলাইন-অফলাইন প্রশিক্ষণ এবং প্রজেক্ট সাপোর্টের পাশাপাশি এই কর্মসূচির অধীনে প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থী একটি করে ফ্রিল্যান্সিং গাইড বই এবং সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইনে ক্লাস করার জন্য ভাতা পাচ্ছেন।
এই প্রশিক্ষণ থেকে তারা কতটুকু শিখছেন তা যাচাই করার জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের একটি পরীক্ষা নেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা অনলাইনের মাধ্যমে এই পরীক্ষায় অংশ নেন। অনলাইন পরীক্ষার জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। ওয়েবসাইটের লিঙ্ক হচ্ছে http://aiaa.gov.bd/। শুধু পরীক্ষা নয়, এই ওয়েবসাইটে অনলাইনে পড়াশোনার জন্য প্রতিটি বিষয়ের ওপর যুগোপযোগী ইলাস্ট্রেটেড ট্রেনিং ম্যাটেরিয়াল প্রস্তুত করে দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের সার্বক্ষণিক সাপোর্টের জন্য তৈরি করা হয়েছে ইন্টারেক্টিভ ভিডিও টিউটোরিয়াল।
এছাড়া এই কর্মসূচির আওতায় আরেকটি ওয়েবসাইট রয়েছে (http://womenfreelancer.gov.bd/), যেটিকে আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইটগুলোর মতো করেই তৈরি করা হয়েছে। এই ওয়েবসাইটটি মূলত ফ্রিল্যান্সিং জগতে বাংলাদেশি নারীদের জন্য মার্কেটপ্লেস হিসেবে কাজ করবে। এখানে কাজ দেয়া এবং নেয়া দুটোর ব্যবস্থাই রয়েছে। বর্তমানে এই কর্মসূচি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের প্রোফাইল রয়েছে এই ওয়েবসাইটে।
‘শিক্ষা যেন একঘেয়েমি না হয়ে যায়’ এই ধারণাকে মাথায় রেখে প্রায়ই ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতে কাজ শেখার জন্য উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রতিযোগিতার ফলে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে প্রফেশনাল লেভেলের কাজ পাওয়া যায়, যা তাদের ‘অন্তর্নিহিত গুণ’কে প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়। এই কিছুদিন আগেই আয়োজন করা হয়েছিল ২৬ মার্চ উপলক্ষে ওয়েব ব্যানার তৈরির প্রতিযোগিতা। তারপর পবিত্র মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে ওয়েব ব্যানার তৈরির আহবান জানানো হয়েছে। এছাড়া একটি গ্যারেজ কোম্পানির লোগো কনটেস্ট আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিযোগিতায় প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে।
সফলতার গল্প
প্রশিক্ষণ আসলে তখনই সার্থক হয়, যখন সেই প্রশিক্ষণ প্রশিক্ষণার্থীদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে। সেই জায়গা থেকে দেখতে গেলে ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচির প্রশিক্ষণ-পরবর্তী সফলতার গল্পের পাল্লা দিন দিন ভারী হয়ে উঠছে।
মানিকগঞ্জে বেড়ে ওঠা রিনি চৌধুরীর গল্পটা একটু অন্যরকম। কলেজে পড়ার সময় বাবা মারা যান। মাস্টার্স পড়া চলাকালীন তিনি এসে যোগ দেন ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’-এর প্রশিক্ষণে। ফেস টু ফেস ক্লাসেই তিনি প্রশিক্ষকদের সহায়তায় ফাইভার ডটকমে একটি ফ্রিল্যান্সার অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেন। এরপর ট্রেইনারদের সহায়তায় বিদেশি ক্লায়েন্টের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কাজ করে অর্থ উপার্জন করেছেন। এখন তিনি গ্রাফিক্স ডিজাইনেও বেশ আগ্রহী। নিয়মিত কাজের জন্য বিড করছেন বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে।
সাদিকা সুমি। নরসিংদী জেলার এই প্রশিক্ষণার্থী খুব আগ্রহ সহকারে এই প্রশিক্ষণ থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখেছিলেন। এখন তিনি পেশাদার ডিজাইনারদের মতোই বিজনেস কার্ড, ব্যানার তৈরি করতে শিখে গেছেন। কদিন আগেই তিনি বিজনেস কার্ড তৈরি করে অর্থও উপার্জন করেছেন।
শরীয়তপুরের সোনিয়া আক্তার বিশ্বের জনপ্রিয় সবকটি ফ্রিল্যান্সার ওয়েবসাইটে খুলে ফেলেছেন নিজের ফ্রিল্যান্সার অ্যাকাউন্ট। এখনও বিড করে কাজ পাননি। কিন্তু নিজেদের দোকানের জন্য ব্যানারটি তিনিই ডিজাইন করেছেন। শুধু তাই নয়, বন্ধুদের বিভিন্ন উৎসবের ছবি এখন তিনিই এডিট করছেন।
সাফল্য এসেছে চট্টগ্রামের মেয়ে রাবেয়া আক্তারের জীবনেও। এই প্রশিক্ষণে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিং সম্পর্কে বিশদ আকারে জেনেছেন, যার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিংবিষয়ক একটি চাকরিতে যোগ দেন।
টাঙ্গাইলের ফাতেমা ইসলাম। শুরু করেছেন নিজের ই-কমার্স বিজনেস। অনলাইনে বিক্রি করছেন শাড়ি আর ইলেকট্রনিক্স পণ্য। নিজের বিজনেসের অনলাইন প্রচারণা চালাচ্ছেন পাকা ব্যবসায়ীর মতো। আর এই প্রচারণার জ্ঞানটি তিনি লাভ করেছেন এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই।
‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লক্ষীপুর জেলার তাসলিমা আক্তার সাথী নিজের স্কুলের জন্য নিজেই ক্যালেন্ডার বানাচ্ছেন। গোপালগঞ্জ জেলার নাদিরা খানম নদী ইতোমধ্যে একাধিক ক্লায়েন্টের জন্য করেছেন প্রফেশনাল ডিজাইন ওয়ার্ক।
আগেই বলা হয়েছে ভার্চ্যুয়াল ক্লাস পদ্ধতি এই প্রশিক্ষণের জন্য ছিল অনন্য একটি বিষয়। আর এই বিষয়ের প্রতি মুগ্ধতা থেকে নারায়ণগঞ্জের প্রশিক্ষণার্থী সুমাইয়া আজাদ খুলে বসেছেন একটি ভার্চ্যুয়াল কোচিং সেন্টার। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একটি কলেজে ইংরেজিতে লেকচারার হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। আর পাশাপাশি ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে ইংরেজি শিক্ষাদানে কাজ করছেন।
সফলতার এই গল্পে নরসিংদীর স্মৃতি, চাঁদপুরের মুক্তা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসরাত, গাজীপুরের জান্নাত, নারায়ণগঞ্জের সায়মাসহ আরো বহু নাম উঠে আসেন যাদের প্রত্যেকেই আজ স্বপ্ন দেখছেন নিজের ক্রিয়েটিভিটিকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার।
প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশিক্ষকদের মতামত
‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থাকে সহযোগিতা করছে কমজগৎ টেকনোলজিস। কমজগৎ টেকনোলজিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর সাজ্জাদ বিন আহসান জানান, ‘এই ট্রেনিংয়ের পেছনে আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ডিজিটালাইজেশনের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ। আমাদের প্রশিক্ষণার্থী নারীরাই পারবেন ভিশন-২০২১-এর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং ইন্ডাস্ট্রিতে সুলতানা পারভিন, মারজান আহমেদ, ইমারজিন ইসলাম বিশ্ববাজারে টপ র্যাঙ্ক ফ্রিল্যান্সার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের প্রশিক্ষণার্থীরা এমনই দুর্দান্ত ফ্রিল্যান্সার হয়ে উঠবেন একদিন। বিশ্ববাজারে তারাই বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করবেন। তাদের হাত ধরেই বিশ্ব চিনবে বাংলাদেশকে।’
রাইসুল ইসলাম রাতুল এই প্রশিক্ষণের একজন প্রশিক্ষক। তার মতে, বাংলাদেশের নারীরা ভীষণ পটেনশিয়াল। তাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে জানার এবং কাজ করার প্রবল আগ্রহ। কিন্তু এতদিন তারা সেই অর্থে কোনো প্ল্যাটফর্ম পাননি। ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ তাদেরকে সেই প্ল্যাটফর্ম করে দিয়েছে। পাশাপাশি রাতুল এও জানান, পেশাদার ফ্রিল্যান্সার হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের বড় বাধা তাদের কমিউনিকেশন স্কিল। কমিউনিকেশনে যোগ্যতা অর্জন করতে পারলেই ফ্রিল্যান্সার জগতের দুয়ার তাদের জন্য খুলে যাবে।
শেষ কথা
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচিটি এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। দেশীয় ফ্রিল্যান্সিং ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের অংশগ্রহণ যত বাড়বে, তত দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হবে। পাশাপাশি নারীরাও হয়ে উঠবেন স্বাবলম্বী।
আমাদের দেশের নারীদের জন্য সামাজিক বাধা কম নয়। ঘরের বাইরে তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে রয়েছে হাজারো বিধিনিষেধ। তাছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা যতদিন পুরোপুরি নিশ্চিত না হবে, ততদিন এই সামাজিক বাধাকে ডিঙানো প্রায় অসম্ভব। এই এত বাধাকে জয় করে নারী নিজ ঘরে বসেই রচনা করতে পারবেন তার স্বাবলম্বী জীবনের গল্প। নিজেদের প্রতিভা আর ধৈর্যকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতে তারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারবেন।
‘আমি পারবন নারীকে এই স্বপ্ন দেখাতে শিখাচ্ছে ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচিটি। নীরবেই নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় পালন করছে এক অগ্রগামী ভূমিকা, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
সাধুবাদ রইল জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে ‘আমার ইন্টারনেট আমার আয়’ কর্মসূচিটির প্রতি