লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
জাবেদ মোর্শেদ
মোট লেখা:১৩
লেখা সম্পর্কিত
সাইবার বুলিং ও আমাদের করণীয়
সাইবার বুলিং ও আমাদের করণীয়
মোহাম্মদ জাবেদ মোর্শেদ চৌধুরী
মার্কিন ফার্স্টলেডিরা সাধারণত তাদের কর্মকালে একটু বড় কস বা মিশনকে সামনে এগিয়ে নেন। বর্তমান ফার্স্টলেডি মেলেনিয়া ট্রাম্প তার সিগনেচার কস হিসেবে ‘সাইবার বুলিং ও তার প্রতিরোধ’কে বেছে নিয়েছেন। এবার দেখা যাক, সাইবার বুলিং আসলে কী এবং এর থেকে নিজেরা ও পরিবারের সবাইকে বিশেষ করে পরিবারের কিশোর ও কিশোরীদের কীভাবে রক্ষা করব।
ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি যোগাযোগমাধ্যম বেশ জনপ্রিয় এখন। যোগাযোগের এ মাধ্যমগুলোতে হরহামেশাই নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। ইন্টারনেট জগতে সংঘটিত এই অপরাধগুলোকে সাইবার অপরাধ বলা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাইবার বুলিং। আর নারীরাই হচ্ছেন এর প্রধান শিকার।
অনলাইনে কাউকে অন্যায় কিছুতে প্রলুব্ধ করা বা কারো ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন করা ‘সাইবার বুলিং’য়ের আওতায় পড়ে। শুরুতে টিনএজাররাই শুধু এ ধরনের হয়রানির শিকার হলেও পরে দেখা যায় মধ্যবয়সীরাও প্রায় সাইবার বুলিংয়ের ভিকটিম হচ্ছেন। নারীরা, বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের নিয়মিত শিকার। এ ছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ অনলাইনে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ করে অভিযোগ দায়ের করেন এবং বাকিরা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে চুপ থাকেন। বেশিরভাগ সাইবার বুলিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটে। তবে এর বাইরেও মোবাইল ফোনে বা ই-মেইলেও এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সাইবার বুলিংয়ের প্রভাব এত মারাত্মক যে, এর ক্রমবর্ধমান চাপে নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশন, পড়াশোনায় অনীহা, ইন্সমনিয়া থেকে শুরু করে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
সাইবার বুলিং থেকে সতর্ক হোন
অনেক সময় আবেগে কিংবা অনলাইনে কারো সাথে ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে কেউ যখন পিছপা হতে চান, তখন ভয় দেখিয়ে বা মানসিক নির্যাতন করে কোনো কিছুতে বাধ্য করার চেষ্টাই হচ্ছে সাইবার বুলিং। সম্মানের ভয়ে বা পরিবারের কথা ভেবে অনেকেই একসময় ‘চুপ’ থাকে বলে অপরাধীরা তখন আরো বেশি সুযোগ নেয়। সাধারণত অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা আদায়ের পাশাপাশি সাইবার বুলারেরা এ সময় অন্যদের দিয়েও একই ভিকটিমকে নির্যাতন করে থাকে।
যেহেতু শিশু-কিশোর ও তরুণীরা সাইবার বুলিংয়ের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়ে থাকে, তাই বাবা-মাকে সবার আগে সন্তানের বন্ধু হতে হবে। সাইবার বুলিং কী, অপরিচিত বা অনলাইন বন্ধুরা কেন অনিরাপদ এবং তাদের সাথে কেন ব্যক্তিগত কিছু শেয়ার করা যাবে না- এসব সন্তানদের বুঝিয়ে বলতে হবে। সম্ভব হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত থাকতে হবে সন্তানদের সাথে এবং সর্বোপরি নজর রাখতে হবে সন্তানের অনলাইন পদচিহ্নে। সন্তান আপনার আড়ালে ইন্টারনেটে কী করছে, কোন কোন সাইট বেশি ব্রাউজ করে কিংবা সেসব সাইটে ভয়ঙ্কর কোনো ফাঁদ পাতা নেই- একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে তাতে সার্বক্ষণিক লক্ষ রাখা আবশ্যক।
পাশাপাশি নিজের সচেতনতায় অনলাইনে আরো যেসব আচরণবিধি মেনে চলা উচিত। সাইবার বুলিং সমস্যাটি মোকাবেলা এক-দুটি উদ্যোগের বিষয় নয়। এখানে হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ দরকার। প্রথম সমস্যা আমাদের চিন্তায়-ধারণায়। আমাদের চিন্তার একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সাইবার জগৎটিকে আমরা এখনও আমাদের আশপাশের সাধারণ জগতের মতোই পূর্ণ জগৎ হিসেবে ভাবতে পারি না। আসলে বাস্তবতা হচ্ছে ইন্টারনেটের জগৎটি আমাদের আশপাশের জগতের মতো প্রায় পূর্ণ একটি জগৎ। কিছু ক্ষেত্রে সাইবার জগতে আমাদেরকে দেখার চোখ বাস্তব জগতের চেয়ে অনেক বেশি। আবার সাইবার জগতের কোনো কিছু লিখলে বা বললে চিরতরে মুছেও ফেলা যায় না, কোনো না কোনো তথ্য-প্রমাণ থেকেই যায়। এই ধারণাটা পরিষ্কার না থাকায় আমরা সাইবার জগতে এমন সব আচরণ করে ফেলি, যেটা আমরা বাস্তব জগতে করতে লজ্জা বা ভয় পাই। আমরা জানি না, সাইবার জগতে আমাদের সবাই দেখছে, আরও বেশি বেশি দেখছে এবং সব কিছুর লিখিত রেকর্ড থাকছে। এই গণসচেতনতা তৈরিই সাইবার বুলিং মোকাবেলায় আমাদের প্রথম কাজ। এসব সমস্যায় পড়লে সবচেয়ে আগে জানাতে হবে পরিবারকে। পরিবারে না জানিয়ে আগ বাড়িয়ে কোনো কিছু করতে হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, নিজের পরিবারের চেয়ে সঠিক পরামর্শ বা সদুপদেশ আর কেউই দেবে না। এক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের ভ‚মিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবার আগে হতে হবে সন্তনের বন্ধু। সাইবার বুলিং কী, অপরিচিত বা অনলাইন বন্ধুরা কেন অনিরাপদ এবং তাদের সাথে কেন ব্যক্তিগত কিছু শেয়ার করা যাবে না- এসব সন্তানদের বুঝিয়ে বলতে হবে। সম্ভব হলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে সন্তানদের সাথে যুক্ত থাকতে হবে। সর্বোপরি সন্তানরা অনলাইনে কী করছে তার ওপর নজর রাখতে হবে। সন্তানকে আত্মবিশ্বাস দিতে হবে- সন্তানেরা খুব খারাপ কোনো ভুল করলেও আপনিই তাকে সবচেয়ে আন্তরিকতা দিয়ে রক্ষা করবেন। বাইরের কেউ নয়। অনেকের পরিবারে জানাতে ভয় করলে বা সমস্যা হলে খুব কাছের কোনো বন্ধুকে জানানো উচিত, যে তার পাশে থেকে এই লড়াইটা লড়তে পারবে।
আইনি সহায়তা নেবেন যেভাবে
বিষয়টি কখনও পারিবারিক আওতা পেরিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায়। অনেকেই ভাবে এই লড়াইটা করাই সবচেয়ে কঠিন। পুলিশ, গোয়েন্দা, আদালতে ছোটাছুটি! কিন্তু কিছু ধাপ অনুসরণ করলে এই কঠিন কাজই খুব সহজ হয়ে যায়। প্রথম কাজ হচ্ছে জিডি করা। নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম, ঠিকানা সব তথ্য সঠিকভাবে দিয়ে একটি আবেদনপত্র লিখে স্থানীয় থানায় যেতে হবে, সাথে নিতে হবে সাইবার হ্যারাজের প্রমাণ। মানে যে মেসেজ, কমেন্ট, যে পেজ আপনাকে হয়রান করেছে তার স্ক্রিনশটের প্রিন্টেড কপি। সেখানে ভিকটিমের বক্তব্যও থাকতে পারে , কিন্তু সেটাও স্ক্রিনশটে দেয়া উচিত, যাতে করে পুলিশ বক্তব্য ও ঘটনার স্বচ্ছতা বুঝতে পারে। জিডির কপিটি রিসিভ করিয়ে ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন ওমেন সাপোর্ট ডিভিশন’-এ যোগাযোগ করা যায়।
হয়রানির শিকার যেকেউ সরাসরি বিটিআরসিতে যোগাযোগ করতে পারেন। বিটিআরসি ফোনে ও ই-মেইলে দু’ভাবেই অভিযোগ করা যায়। বিটিআরসির কমপিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্স রেসপন্স টিম এ ধরনের সমস্যায় সহায়তা করে থাকে। বিটিআরসিতে হয়রানির অভিযোগ জানাতে কল করতে পারেন (০২)৭১৬২২৭৭ নম্বরে বা ই-মেইল পাঠাতে পারেন পড়হঃধপঃ@পংরৎঃ.মড়া.নফ ঠিকানায়। এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন ১০৯২১ নম্বরে গোপনীয়তার সাথে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা হয়