লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ
নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ
মোস্তাফা জব্বার
গত ১ মে শুক্রবার ২০২০ রাত ৮টায় বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি ‘নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ’ শিরোনামেই জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একটি ডিজিটাল স্মরণসভার আয়োজন করে। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত তো বটেই, পুরো দেশের প্রযুক্তি খাতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। অন্য যারা যাই ভাবুন না কেন, আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানুষেরা এই মহান মানুষটিকে স্মরণ না করে পারিই না। সেই সূত্র ধরেই বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মরণে প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করে। মহান মে দিবস ও শুক্রবারে করোনাময় দুনিয়াতে ডিজিটাল পদ্ধতিতেই আমাদেরকে অংশ নিতে হয়। বিসিএসকে ধন্যবাদ যে তারা স্মরণসভায় এমন কিছু মানুষকে যুক্ত করেছিল যারা জেআরসি স্যারের সাথে দারুণভাবে সম্পর্কিত। যদি খুব নির্দিষ্ট করে বলতে হয় তবে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি স্যারের সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত ছিল ১৯৯৬-৯৭ সালে। বিসিএস আমাদেরকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। আমরা যারা ১৯৯৬-৯৭ সালে এই সমিতির নেতৃত্বে ছিলাম তাদের মাঝে সভাপতি আমি, সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ এইচ কাফি, মহাসচিব মুনিম হোসেন রানা ও নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ আব্দুল আজিজ। এছাড়া বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি সবুর খান, বর্তমান সভাপতি সাইদ মুনীর ও জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. এ কে আব্দুল মুবিন ডিজিটালি এই স্মরণসভায় অংশগ্রহণ করি।
যদিও সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি আমি তার মৃত্যুর পরপরই আনুষ্ঠানিক শোকবার্তা প্রদান করি তথাপি এই শোকসভাটির তাৎপর্য অনেক। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটিকে ঘিরে পুরো জাতির যে আগ্রহ আমাদের সমৃদ্ধির সোপান গড়তে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামোসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা বা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় তার যে অবদান সেটি বহু মানুষ, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে স্মরণ করতে হবে। সারা বিশ্বের বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য আমরা শারীরিকভাবে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে না পারলেও বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল খাতের পক্ষ থেকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটা অপরিহার্য একটি বিষয়।
বিসিএসের স্মরণসভার পরের দিন ২ মে ২০২০ শনিবার দুপুরে বেসিস তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে। বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বেসিসের এই স্মরণসভায় সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে বেসিসের উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ এইচ কাফি ও শেখ আব্দুল আজিজ, বেসিসের সাবেক সভাপতি এ তৌহিদ ও এইচ এন করিম, বাংলাদেশ কমপিউটার সোসাইটির সাবেক সভাপতি আব্দুল মতিন পাটোয়ারী, সাবেক সচিব ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ অংশ নেন।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি থেকে সেতু বা সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুতেই তার অবদানের বিষয়টি এত বেশি যে তার জীবনের যেকোনো একটি অধ্যায় বা বিষয় নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায় বা দিনের পর দিন কথা বলা যায়। ড. জাফর ইকবাল তার এক লেখায় এই মানুষটিকে ‘নিখুঁততম মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেজন্যই রাজনীতি বা পেশাজীবন থেকে শুরু করে তার ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত কোথাও কোনো বিতর্ক নেই। সবার কাছে বিনা প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য একজন মানুষ তিনি। কিন্তু আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তির মানুষ তাদের কাছে সত্যিকারের একটি নক্ষত্র তিনি। এই দেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে তার যে নেতৃত্ব সেটি অন্যরা যাই চিন্তা করুক আমরা এই খাতের মানুষেরা এক সেকেন্ডের জন্যও সেটি ভুলে থাকতে পারব না। আমার সাথে অথবা বৃহত্তর অর্থে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাথে জামিলুর রেজা চৌধুরীর গভীর বা আত্মিক সম্পর্কের সূচনাটি ’৯৬ সালের আগেই। তবে সেটি আরও গাঢ় হয় একসাথে দুটি ঘটনা ঘটার জন্য। আমি ’৯৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিই। ৭ সদস্যের সেই কমিটিতে কাফি সহ-সভাপতি, রানা মহাসচিব, সাব্বির কোষাধ্যক্ষ, আজিজ ভাই সদস্য হিসেবে টিমে ছিলেন। বিসিএসের সেই সময়ের টিমে আরও ছিলেন মইন খান, সৈয়দ বোরহান আহমদ। ’৯৬ সালের ৩ এপ্রিল প্রফেসর জামিলুর রেজা স্যার তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২৩ জুন পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন। সেই সরকারের দায়িত্ব ছিল একটি অবাধ-নিরপেক্ষ ও সার্বজনীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। ’৯৬ সালের নির্বাচন এই দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। জেআরসি উপদেষ্টা হওয়াতে আমরা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম। একইভাবে ’৯৬ সালের নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করাতেও আমরা খুশি হয়েছিলাম। আমরা জেআরসি স্যারের মতো এমন একজন নীতিনির্ধারককে খুঁজছিলাম যার কাছে তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্বটা সহজবোধ্য। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে জামিলুর রেজা স্যার শুধু একটি স্তম্ভ নন বস্তুত তিনিই ইতিহাস। এদেশে ১৯৬৪ সালে আসা মেইনফ্রেম কমপিউটারের যুগ থেকে পার্সোনাল কমপিউটারের অগ্রযাত্রা পর্যন্ত কমপিউটার প্রযুক্তির বিকাশে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ’৭৭ সালে জন্ম নেয়া টেন্ডি রেডিওস্যাক টিআরএস-৮০ নিজে ব্যবহার করেছেন। আমার জানা মতে স্যার সেই যন্ত্রটিকে অতি যতœ সহকারে রক্ষা করে গেছেন। স্যারের মুখে সেই কমপিউটার ব্যবহারের গল্প শুনেছি। তার লেখাপড়ার জীবনে ও শিক্ষকতার জীবনে কমপিউটার ব্যবহারের গল্প শুনেছি আমি। ’৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সাথে যুক্ত থাকার ফলে কমপিউটারবিষয়ক সভা, সেমিনার, বৈঠক, আলোচনা ইত্যাদিতে যেতাম ও জামিলুর রেজা স্যারের সাথে হরদম দেখা-সাক্ষাৎ হতো। কবে যে প্রথম দেখা হয় সেটি স্মরণ করতে না পারলেও আমার একটু বাড়তি সম্পর্ক ছিল কমপিউটার বাংলা প্রচলন করার সুবাদে। ’৮৭ সালে এই কাজটি করার পর স্যার আমাকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেন। তখন থেকেই কমপিউটারকে জনপ্রিয় করার জন্য মাগমিট নামক একটি সংগঠন নিয়ে কাজ করতাম। মাগমিট মানে ছিল মাইক্রো কমপিউটার্স ইউজার গ্রæপ মিট। সংগঠনের কোনো গঠনতন্ত্র ছিল না। সদস্যপদও ছিল না। বব টরিনের বাসায় যারা উপস্থিত থাকতাম তারাই সদস্য। কোনো পদ-পদবিও ছিল না। বব টরিন নামক এক বিদেশি আমাদের সাথে ছিলেন। সে মেকিন্টোস ব্যবহারকারী ছিলেন। ফলে আমার সাথে একটু বেশি খাতির ছিল। বকুল এবং রানাও ছিল মাগমিটে। বব টরিনের বাসায় আমরা কমপিউটার নিয়ে আলোচনা করতাম। আমরাই প্রথম ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম কমপিউটার শো করি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভলিবল কোর্টে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাথে বব টরিন ও আমার সখ্য ছিল। কারণ ওরা মেকিন্টোস কমপিউটার ব্যবহার করত। সেজন্য আমেরিকান স্কুল তাদের ভলিবল কোর্টটা আমাদের মেলার জন্য দিয়েছিল। আমরা প্রধানত মেকিন্টোস কমপিউটারই দেখিয়েছিলাম। ’৯২ সাল থেকে আমরা বিসিএসের প্লাটফরমকে ব্যবহার করে কমপিউটারের পক্ষে একটি গণজাগরণ তৈরি করার চেষ্টা করছিলাম। ততদিনে মরহুম আব্দুল কাদের সাহেব কমপিউটার জগৎ পত্রিকা বের করা শুরু করেছেন। সরকারি চাকরি করেও তিনি নৌকায় করে কমপিউটার নিয়ে স্কুলে স্কুলে দেখাতেন। কমপিউটারকে জনপ্রিয় করার আন্দোলনে কাদের ভাই অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। বাংলা ভাষায় কমপিউটারবিষয়ক পত্রিকায় লেখালেখিটাও আমি কাদের ভাইয়ের হাত ধরে শুরু করি। মানুষের হাতে হাতে কমপিউটার পৌঁছানোর আন্দোলনে আমরা স্যারের সহযোগিতা পাই। তখন কমপিউটার একটি বিলাস সামগ্রী এবং কেবলমাত্র ডাটাবেজ, স্প্রেডশিট বা ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ের জন্য কমপিউটারের ব্যবহারের কথা ভাবা হতো। সেই সময়ে অবশ্য ডেস্কটপ পাবলিশিং ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পত্রিকাগুলো কমপিউটার ব্যবহার করতে শুরু করে এবং বিজয় কিবোর্ড বাংলা লেখার ক্ষেত্রে অসাধারণ ভ‚মিকা পালন করে। স্যার বরাবরই আমার এসব কাজকে উৎসাহিত করতেন। ওই সময়ে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতিও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে ’৯৩ সাল থেকে বিসিএস কমপিউটার শোর আয়োজন করাটা কমপিউটারের সাথে জনগণের সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়ক হয়। এসব মেলায় আমরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদেরকে সম্পৃক্ত করতাম। আমরা মেলা করার পাশাপাশি সেমিনার করতাম এবং সেইসব সেমিনারে স্যার ও অন্য বিশেষজ্ঞরা অংশ নিতেন। ওই সময়ে আমাদের একটি বড় প্রচেষ্টা ছিল কমপিউটারের দাম কমানো, কমপিউটার শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং অনলাইন ইন্টারনেটের সূচনা করা। ’৯৬ সালের দিকে অনলাইন ইন্টারনেট চালুর একমাত্র উপায় ছিল ভি-স্যাট চালু করা। কারণ ’৯২ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার সি-মি-উই ৩-এর সাথে বিনামূল্যে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে ও সারা বিশ্বের সাথে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপনের পথ রুদ্ধ করে দেয়। ভি-স্যাটের অনুমোদন তখন পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, এর ব্যয় ছিল অনেক বেশি। আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম যে স্যার সরকারে থাকায় ভি-স্যাটের ক্ষেত্রে আমরা সহায়তা পাব। আমাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে স্যার বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেন। আমাদের মহাসচিব রানা তখনো অ্যামেচার রেডিও নিয়ে আগ্রহী। স্যারের সাথে তার একটু বাড়তি যোগাযোগ ছিল তার ছোট ভাই রানার ব্যবসায়ী অংশীদার ছিল বলে। সম্প্রতি রানা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই বিষয়ক একটি স্মৃতিচারণ করেছে।
‘কমপিউটার সমিতিতে যুক্ত ছিলাম বলে উনার সাথে নিয়মিত সেমিনারে, মিটিংয়ে, বিভিন্ন কমিটিতে প্রায়ই দেখা হতো। ১৯৯৬-এ কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা থাকাকালীন সময়ে উনি বিসিএসের কাছে ভি-স্যাট ও ইন্টারনেট সংক্রান্ত কিছু তথ্য চান। কাফি ভাই ও মোস্তাফা জব্বার ভাইয়ের সাথে বসে আমরা সমিতির অফিসে ওগুলো প্রিপেয়ার করি। জব্বার ভাই আবার খুব গুছিয়ে লিখতে পারতেন। রাত হলেও সেদিন ওনার বাসায় ওগুলো পৌঁছাতে পেরেছিলাম।’ (মুনিম হোসেন রানার ফেসবুক টাইমলাইন থেকে ২৯ এপ্রিল ২০)। স্মরণ করা যেতে পারে যে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলেই ’৯৬ সালের ৪ জুন বাংলাদেশ ভি-স্যাটের মাধ্যমে অনলাইন ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশ করে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ঐতিহাসিক কাজটি জেআরসি স্যারের বদৌলতেই হতে পেরেছে।
ব্যক্তিগত জীবন : সিলেটে (এটি কাছাড় এখন) জন্ম নেয়া জামিলুর রেজা চৌধুরী অত্যন্ত সাদামাটা ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতেন। তার স্ত্রী সংসারের দেখাশোনার পুরোটাই করতেন বলে সংসারের দিকে তার নজর দেয়ার প্রয়োজন হতো না। সকালে হাঁটা, পত্রিকা পড়া এবং রাত ১২টা পর্যন্ত জেগে থেকে কাজ করা তার নিয়মিত বিষয় ছিল। তিনি নিজের দেশ ছাড়া সুইজারল্যান্ডকে পছন্দ করতেন।
আইপ্যাড, কিন্ডেল থাকলেও সব সময়ের সঙ্গী ছিল ল্যাপটপ ও মুঠোফোন। আমার সৌভাগ্য ছিল যে আমি স্যারের পরিবারকে দু’বছর একান্তভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্যার তার ৬৮, এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ির নিচতলায় থাকতেন আর আমি দোতলায় থাকতাম। আমার ছেলে বিজয়ের শৈশবটা কয়েক বছর সেই বাড়িতেই কেটেছে। অন্যদিকে তার বাড়িতেই আক্তারুজ্জামান এমপির সাথে যৌথভাবে সুবর্ণ বিজয় নামে একটি গ্রাফিক্স-মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করি।
জেআরসি কমিটির রিপোর্ট : ২৮ এপ্রিল ২০২০ ভোররাতে জাতীয় অধ্যাপক, প্রখ্যাত প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদেরকে ছেড়ে গেছেন। সেই মানুষটিকে দেশ ও জাতি নানা কারণে স্মরণ করবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা সম্পর্কে ইতিবাচক সুপারিশ প্রদান থেকে শুরু করে শিক্ষা বিস্তারে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদকও অর্জন করেছেন। তবে কোনো পদক বা উপাধিতে এই মানুষটিকে সম্মানিত করা বা শ্রদ্ধা জানানোতে সীমিত রাখা যাবে না। আমরা তার বিশাল কর্মময় জীবনের ছোট একটি অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করব, যার নাম জেআরসি কমিটি। যদিও জামিলুর রেজা চৌধুরীর জীবনের জন্য এই অধ্যায়টি হয়তো অনেকটা ছোট কিন্তু বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা ও একটি ডিজিটাল সাম্য সমাজ গড়ে তোলায় সেই অধ্যায়টির ভ‚মিকা অসাধারণ। আমাদের দেশের এই খাতের মানুষেরা জেআরসি স্যারের জীবদ্দশায় বা এমনকি তার মৃত্যুর পরেও তেমনভাবে তার নেতৃত্বাধীন জেআরসি কমিটির বিষয়বস্তু নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা করছে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই আমরা একটি ডিজিটাল যুগের সন্ধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে পেরেছিলাম। আমার নিজের জন্য এটি গর্ব করার মতো যে, সেই অধ্যায়টির শুধু প্রত্যক্ষ সাক্ষী নই আমি একজন অংশীদারও। ’৮৭ সাল থেকে ৩৩ বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তি-ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে যত কাজ করেছি তার মাঝে অন্যতম সেরাটি জেআরসি কমিটিতে কাজ করা। এর আগেও তথ্যপ্রযুক্তি-ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে অনেক সম্পর্কযুক্ত কাজ আছে যার সাথেও যুক্ত ছিলাম। স্মরণ করতে পারি দেওয়াং মেহতার বাংলাদেশে আগমনের কথা, গাজীপুরে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল গড়ে তোলা, কমপিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের আন্দোলন করা, জেআরসি কমিটির রিপোর্টের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা ইত্যাদি তো আছেই বস্তুত প্রায় তিন যুগের জীবনটাই এই খাতে নিবেদিত।
জেআরসি কমিটি : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রফতানিবিষয়ক একটি টাস্কফোর্স তার ১৮তম সভায় বাংলাদেশ থেকে কেমন করে সফটওয়্যার রফতানি করা যায় সেই সম্পর্কে সুপারিশ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাকে আহ্ববায়ক করে এই কমিটি গঠনের তথ্য কমিটিকে জানানো হয় ১৪ জুন ১৯৯৭। তবে কমিটি গঠন করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২৮ মে পত্রসূত্র বিআর/আর-২/পণ্য-২(১১)/৯৭(এল-১-৯) বরাত দিয়ে। কমিটিকে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য দুই মাসের সময় দিলেও পরে আরও ছয় সপ্তাহ সময় বাড়ানো হয়।
প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে সরকারি সংস্থা ও সেক্টরের প্রতিনিধিসহ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরের প্রতিভাবান প্রযুক্তি ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে ১৪ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, যা জেআরসি কমিটি নামে সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিষয়ে ধারণা, এই খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা এবং করণীয় সম্পর্কে এই কমিটির সুপারিশমালায় বিস্তারিত পরিসরে প্রতিফলিত হয়। যদিও বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে এর আগে ও পরে অনেক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে এবং কোনো কোনোটা বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করেছে তথাপি জেআরসি কমিটির মতো এমন বাস্তব-প্রয়োগ সফল কোনো প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। কমিটি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ’৯১ সালে সফটওয়্যারবিষয়ক দুটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ক) পণ্য উন্নয়ন, খ) বাজার চিহ্নিতকরণ। এই প্রকল্পের আওতায় ’৯৩ সালে কানাডার সফটওয়ার্ল্ডে ও ’৯৫ সালে জার্মানির হ্যানোভারে বেসরকারি খাতের কিছু লোককে পাঠানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব মেলা থেকে বাংলাদেশ কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ইউনিডোর ডিজি/বিজিডি/৯২/০০৪/১১-৫২ প্রকল্পের আওতায় মি. জন মরিসন নামের একজন পরামর্শককে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই পরামর্শকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় কর্মশালার আয়োজন করে ১৯৯৫ সালে। তবে সেই কর্মশালার প্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার আর কোনো কর্মকাÐ করেনি। জেআরসি কমিটি সেই সময়কার তিনটি সফটওয়্যার কোম্পানির উল্লেখ করেছে। কোম্পানি তিনটি হলোÑ আইবিসিএস প্রাইমেক্স, নর্থ আমেরিকান কমপিউটিং ডাইনামিকস এবং বাংলাদেশ ইনফরমেশন টেকনোলজি গ্রুপ লিমিটেড। শেষ কোম্পানিটি ছিল রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দেশের ২৩টি কমপিউটার কোম্পানির একটি যৌথ উদ্যোগ। কমিটি রিপোর্টে কয়েকটি রফতানিমুখী কোম্পানির উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো কমপিউটার সলিউশন্স লিমিটেড, অনির্বাণ, আইবিসিএস প্রাইমেক্স, ব্র্যাক, এনএসিডি ও মেশিন ডায়লগ। ওরা কোনো না কোনো রফতানি কাজ করেছে বলে দাবি করলেও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো কমিটির সামনে রফতানির কোনো প্রামাণ্য দলিল পেশ করতে পারেনি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এর আগেও সরকার বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করে আরও কিছু প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছিল যার কোনোটারই কোনো হদিস তখনো পাওয়া যায়নি, এখনো পাওয়া যায় না।
জেআরসি কমিটির সদস্যগণ : জেআরসি কমিটির কাজের বিস্ময়কর সফলতার ধারাবাহিকতায় দেশের মানুষের হাতের নাগালে আসে কমপিউটারসহ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। রচিত হয় ডিজিটাল প্রযুক্তি বিপ্লব এগিয়ে নেয়ার সোপান। প্রযুক্তিতে বাঙালির শত শত বছরের পশ্চাৎপদতা অতিক্রম করে তথ্যপ্রযুক্তিকে এ দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অপরিহার্য উপাদানে পরিণত করার যুদ্ধ জয়ের মহানায়ক ছিলেন এই কমিটির প্রতিজন সদস্য।
জেআরসি কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তদানীন্তন ডাক ও টেলিগ্রাফ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ডের (বিটিটিবি) মহাব্যবস্থাপক-পরিকল্পনা শাহ মোহাম্মদ, একেএম নুরুল আমিন খান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নাজমুল আলম, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান ফয়সল আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর এমএ সোবহান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট এএসএম কাশেম, বিসিএস সভাপতি মোস্তাফা জব্বার, বেক্সিমকোর পরিচালক (মানবসম্পদ) এসএম কামাল, লিডস কর্পোরেশন লিমিটেডের এমডি শেখ আবদুল আজিজ, অনির্বাণের জামিল আজহার, বাংলাদেশ কমপিউটার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ড. আবদুল মতিন পাটোয়ারি, কমপিউটার সলিউশন লিমিটেডের মঈন খান, কমপিউটার সার্ভিসেস লিমিটেডের মমলুক সাবির আহমেদ। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে ছিলেন রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক বিএমএম মজহারুল হক।
কর্মপন্থা নির্ধারণে কমিটির বৈঠকের পর বৈঠক হয়। কমিটির সদস্যরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের লব্ধ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবং প্রযুক্তি দুনিয়ার সফল দেশগুলোর খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। তারা প্রযুক্তির ইতিবৃত্ত নিয়ে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত এবং নানা পরিসংখ্যান বৈঠকে বিশ্লেষণ করেন। কমিটির বৈজ্ঞানিক নানা পর্যবেক্ষণের পর কর্মপন্থা নির্ধারণে উঠে আসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমাধান। পর্যবেক্ষণে জেআরসি কমিটি দেখতে পায় পৃথিবীর প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের পথ ধরেই পশ্চিমা দুনিয়া বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে শুরু হওয়া ইন্টারনেট বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্পবিপ্লব আরম্ভ হওয়ার গত প্রায় তিন দশক সময়ের মধ্যে একক আধিপত্য নিয়ে বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রযুক্তির বৈশ্বিক বাজারের প্রায় অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে এশিয়ার দেশ ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ফিলিপাইন কিছুটা পথ হাঁটতে শুরু করেছে মাত্র। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগই গৃহীত হয়নি।
উল্লেখ্য, এই অঞ্চলের প্রথম কমপিউটার প্রোগ্রামার হানিফ উদ্দিন মিয়ার হাত ধরে ১৯৬৪ সালে দেশে প্রথম কমপিউটারের যাত্রা শুরু না হলে ১৯৮৭ সালে আমার পক্ষে কমপিউটারে বাংলা ভাষার সূচনা সম্ভব হতো না। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় কমপিউটার সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে থাকায় ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কমপিউটার ছিল দুর্লভ একটি যন্ত্র। কমপিউটারের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহারসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল প্রযুক্তিবান্ধব নীতি সাধারণের হাতে কমপিউটার পৌঁছুতে শুরু করে সূচিত হয় ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় বিপ্লব।
তারও আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের বীজ বপন করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আইটিও এবং ইউপিইউর সদস্যপদ অর্জন করে। জ্ঞানভিত্তিক একটি সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবের অংশ হিসেবে যুদ্ধের ধ্বংসস্ত‚পের ওপর দাঁড়িয়েও দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি তিনি ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় ভ‚-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করার মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রার ভিত্তিপ্রস্তরটি স্থাপন করেছিলেন।
’৬৪ সালে আসা কমপিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার বিশেষজ্ঞ পর্যায়েই ছিল। অবশ্য সেই কমপিউটারের সুবাদে দেশের প্রথম কমপিউটারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমোর জন্ম হয়। এরপর এনসিআরসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান কমপিউটার বাজারজাত করতে থাকে। এরপর আশির দশকে পার্সোনাল কমপিউটার আসার পরে দেশে ধীরে ধীরে সীমিত পর্যায়ে কমপিউটার ব্যবহারের সূচনা হয়। কিছু কমপিউটার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানেরও জন্ম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে কমপিউটারে বাংলা ভাষার প্রবর্তন এবং ১৯৮৮ সালে বিজয় বাংলা সফটওয়্যার উদ্ভাবন আমার হাতেই হয়েছে। বলা যেতে পারে, সাধারণ মানুষের সাথে কমপিউটারের সম্পৃক্ততা বা মানুষের দৈনন্দিন কাজের সাথে এই প্রযুক্তিকে যুক্ত করার বিপ্লবটা তার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। একই সময়ে ১৯৮৭ সালে জন্ম নেয় দেশের প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি। সেই সমিতি ’৯২ সালে সরকারের কাছে নিবন্ধিত হয় এবং ’৯৮ সালে বেসিসের জন্মের আগ পর্যন্ত একক সংগঠন হিসেবে এই খাতকে সামনে নিয়ে যায়। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত সরকারি আনুক‚ল্য তো দূরের কথা, প্রযুক্তিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে ১৯৯২-৯৩ সালে বিনামূল্যে সি-মি-উই-৩ সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ থেকেও বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ছিল জেআরসি কমিটি গঠন, সুপারিশমালা গ্রহণ ও সেইসব সুপারিশের ২৮টি বাস্তবায়ন করে রেখে আসেন।
জেআরসি কমিটির পর্যবেক্ষণ : কমিটি সফটওয়্যারের বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণে দেখতে পায় ১৯৯৬ সালে অর্থাৎ বিগত এক বছরে সফটওয়্যার সম্পৃক্ত প্রযুক্তিখাতে বিশ্ব বাজার ছিল ২৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ খাত থেকে আয় করেছে ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ’৯৬ সালে প্রযুক্তি খাতে মার্কিন বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা সাড়ে ১২ ভাগ। একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সারা বিশ্বে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ মার্কিন নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়। পরবর্তী চার বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লাখ প্রোগ্রামার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ভারতীয় বাণিজ্য সংগঠন নাসকমের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভারত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আন্তর্জাতিক রফতানি থেকে শূন্য দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ মোট ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছে।
জেআরসি কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, এই অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রæত বিকাশমান দেশ বিশেষ করে ভারত, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনের কর্মকৌশল ও সরকারি নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করতে সেইসব দেশে প্রতিনিধিদল পাঠাবে।
পরবর্তী সময়ের স্বল্পতা বিবেচনায় শুধু ভারতে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত হয়। সরকার জেআরসি কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দিয়েছিল দুই মাস। অবশ্য কমিটির কাজের পরিধি বিবেচনায় অতিরিক্ত আরও ছয় সপ্তাহ মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেআরসি কমিটির একটি প্রতিনিধিদল ভারতে শিক্ষা সফর করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল মুম্বাই, বেঙ্গালুরু এবং কলকাতায় ভারতের শীর্ষ সফটওয়্যার শিল্প বিশেষ করে সফটওয়্যার এক্সপোর্ট হাউজ, ডাটা এন্ট্রি এক্সপোর্ট হাউজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক পরিদর্শন করে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল সফটওয়্যার শিল্প বিকাশে তাদের কার্যক্রমসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়া জেআরসি প্রতিনিধিদল ভারতে নয় থেকে দশ হাজার জনবল সমৃদ্ধ কোম্পানি যারা বিস্তৃত স্পেকট্রামে কাজের সাথে জড়িত সেই ধরনের বেশ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে।
কমিটির অপর একটি প্রতিনিধিদল ঢাকার মিরপুরে বিএসআইসি ইলেকট্রনিকস কমপ্লেক্স পরিদর্শন করে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করে। প্রতিনিধিদলটি ঢাকার অদূরে নবনির্মিত টঙ্গী- আশুলিয়া সড়কের পাশে ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা নিরীক্ষার জন্য সাইট পরিদর্শন করে।
কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে আসে যে, ভারত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক সফটওয়্যার মার্কেটে প্রবেশ করেছে। কমপিউটার খাতে বিদেশে কর্মরত ভারতীয় নাগরিকদের বিক্ষিপ্ত উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত এটি সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে। এ খাতে বিদেশে অনাবাসিক ভারতীয় নাগরিকরা বিদেশে তাদের লিয়াজোঁ কাজে লাগিয়েছে। অনাবাসিক ভারতীয় নাগরিকেরা কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে নিজেরাই সফটওয়্যার শিল্প স্থাপন করেছে। এক্ষেত্রে প্রবাসী ভারতীয় নাগরিকেরা ভারতে ডাটা ও সফটওয়্যার শিল্পকে এগিয়ে নিতে বড় ভ‚মিকা পালন করে। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রযুক্তি খাতে বড় আকারের সুফল আসতে থাকায় ভারত সরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সময়ক্ষেপণ না করে এই শিল্পের দ্রুত বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সরকার ১৯৮৬ সালে কমপিউটার সফটওয়্যার নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা প্রদানে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তি উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট দ্রুত বিস্তার লাভ করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহও পিছিয়ে থাকেনি, বাজার চাহিদা পূরণে বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। এর ফলে পেশাদার কর্মীরাও নিজেদেরকে বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলার বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করেনি এবং পণ্যের বিদেশি ক্রেতারাও আশ্বস্ত হতে পেরেছে যে, ভারতের পারফরম্যান্স উপযুক্ত মানের। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
জেআরসি কমিটির কর্মকান্ড ও সুপারিশ : কমপিউটার সফটওয়্যার সার্ভিসে ভারতের বিশাল সফলতার পেছনে যে বিষয়গুলো কাজে লাগিয়েছেন জেআরসি কমিটির সদস্যরা সেগুলো দক্ষতার সাথে চিহ্নিত করেন। সেই আলোকে তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে কমিটি চারটি খাতে মোট ৪৫টি সুপারিশ তৈরি করে।
জেআরসি কমিটি আর্থিক, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং বাজারজাতবিষয়ক চারটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। চিহ্নিত প্রতিটি ক্ষেত্রে কমিটি পৃথক পৃথকভাবে সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সরকারের আশুকরণীয় নির্ধারণ করে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে এই সুপারিশমালা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা প্রযুক্তি বিকাশের বিস্ময়কর সূচনা এগিয়ে যাওয়ার কান্ডারি। জেআরসি কমিটির নিরলস প্রয়াস পৃথিবীতে চলমান তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে ভারতের দুই দশক পরে হলেও বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। এর আগে কোনো শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশ শরিক হতে পারেনি।
প্রায় সাড়ে তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল কমিটির এই রিপোর্টটি সরকারের কাছে পেশ করা হয়। আর্থিক, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো ও ডিজিটাল পণ্যবাজারবিষয়ক কমিটি চিহ্নিত এই চারটি ক্ষেত্রে সমস্যা এবং সম্ভাবনা বিষয়ে সরকারের কাছে পেশ করা সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন কীভাবে করা হবে রিপোর্টে সেই বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা হয়।
সুপারিশসমূহের গুরুত্বের বিচারে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি এই দুইভাগে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি সুপারিশ করে। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, সেই বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনার সুপারিশ কমিটি করেনি। কমিটি আর্থিক খাতে ১০টি, মানবসম্পদ খাতে ৯টি, অবকাঠামো খাতে ১৪টি এবং বাজারজাতকরণ খাতে ১২টি মিলিয়ে মোট ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে। সুপারিশসমূহ হলো
আর্থিক খাত : আর্থিক বিষয়ে কমিটির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে উচ্চ আমদানি কর ও ভ্যাটের কারণে কমপিউটার সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এর ফলে দেশে গ্রাহকপর্যায়ে কমপিউটারের ব্যবহার হার খুবই সামান্য। দ্বিতীয়ত, কোনো প্রকার প্রণোদনা না থাকায় আমদানিকারকেরাও কমপিউটারের বাজার সম্প্রসারণে খুব বেশি একটা আগ্রহী নয়। তৃতীয়ত, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের অতিরিক্ত সুদের হার (তৎকালীন সময়ে শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ) উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। চতুর্থত, ব্যাংকঋণে বিদ্যমান দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়া আমদানিকারকদের জন্য অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কমিটি চিহ্নিত করে।
এই ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ হচ্ছেÑ কমপিউটারের ওপর থেকে সব ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার, দশ বছরের জন্য কর রেয়াত, স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সফটওয়্যারের জন্য শতকরা ১৫ ভাগ অভ্যন্তরীণ মূল্য সুবিধা প্রদান, সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিং সার্ভিস রফতানির ক্ষেত্রে এলসির পরিবর্তে সেলস কন্ট্রাক্ট অনুমোদন প্রদান, রফতানি খাতে ব্যাংক সুদের হার হ্রাস করা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কমপিউটার সুবিধা নিশ্চিত করতে সুদবিহীন ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্য তহবিল গঠন এবং আইটি গবেষণার জন্য তহবিল গঠন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মানবসম্পদ উন্নয়নে সুপারিশমালা : বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলকে বিভাগ স্তরে উন্নীত করে সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা, ১৯৯৯ সালের মধ্যে কমপক্ষে এক হাজার প্রশিক্ষক তৈরি করতে বিসিসিকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান, স্নাতক স্তরে সব শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বেসিক কমপিউটার দক্ষতা বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে কমিটি। কমিটি সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিআইটিএস এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপিউটারবিষয়ক ডিগ্রি বা ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে আসন সংখ্যা বাড়ানো, প্রতি দুই বছর অন্তর প্রয়োজনবোধে কোর্স কারিক্যুলাম পর্যালোচনা ও উন্নত করা, জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা ও সনদ ব্যবস্থা উন্নয়নে বিসিসিকে শক্তিশালী করা, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কমপিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইটি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী আইটি পেশাদারদের জন্য চাহিদাভিত্তিক উচ্চপর্যায়ের প্রশিক্ষণ দানের জন্য বিসিসিকে শক্তিশালী করে দায়িত্ব প্রদান এবং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে কমিটি সুপারিশ পেশ করে।
অবকাঠামো খাত : সফটওয়্যারের জন্য কোনো কপিরাইট প্রোটেকশন না থাকায় কমিটি ডব্লিউটিও চার্টার অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কপি রাইট আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাথে ব্যয় সাশ্রয়ী উচ্চগতির ডাটা এবং ভয়েজ কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপন, দেশে ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠা, সাশ্রয়ী দামে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা, ভি-সেটের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা সহজলভ্য করার সুপারিশ করে। বিটিটিবির স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক ধীরগতি এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় বেসরকারি খাতকে নিজস্ব স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপনের সুযোগ দেয়, বন্দরসমূহে ডিজিটাল পণ্যের কাস্টম ছাড়পত্র সময় সাপেক্ষ হওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এইসব পণ্য খালাসের প্রয়োজনে মনোনীত নির্ধারিত বন্দরে পৃথক সেল তৈরি, বিসিসিতে কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সফটওয়্যার উন্নয়ন এবং ডাটা প্রসেসিং সার্ভিসে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এর আলোকে অ্যাসোসিয়েশন গঠনে উৎসাহিত করা, ডিজিটাল খাতের জন্য সার্বক্ষণিকভিত্তিক ইপিবি থেকে একজন সহকারী পরিচালককে নিয়োজিত করার সুপারিশ করা হয়। জামিলুর রেজা কমিটি ঢাকার অদূরে টঙ্গী-আশুলিয়া রোডের সুবিধামতো স্থানে প্রয়োজনীয় সব সুবিধাসহ ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ বা আইটিভি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। এছাড়া একটি শক্তিশালী টেলিকম অবকাঠামো তৈরির জন্য দেশব্যাপী আইএসডিএন বা এইচডিএসএল অথবা এডিএসএল লাইন এবং একটি ফাইভার অপটিক ব্যাকবোন প্রতিষ্ঠায় বিটিটিবিকে নির্দেশনা প্রদান, বাংলাদেশে একটি কমিউনিকেশন্স হাব প্রতিষ্ঠা এবং সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিং সার্ভিসের উন্নয়নে নীতিমালা, কৌশল এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠনের জন্য সুপারিশমালা পেশ করা হয়।
পণ্য বাজারজাত খাত : বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল খাতে প্রণোদনা বিষয়টি অবহিত করার মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনে উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলে কমিটি মনে করে। এই পরিস্থিতিতে সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরার জন্য সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভ‚ত আইটি পেশাদারদের সাথে পরামর্শক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের বাছাই করা স্থানে সেমিনার ও বৈঠকের ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের সাহায্যে তাদের সমর্থন লাভের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ, সরকারি অথবা বেসরকারি সেক্টরের সব প্রতিষ্ঠানে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে ম্যানুয়েল সিস্টেমের ডকুমেন্ট ও রেকর্ডসমূহ কমপিউটার সিস্টেমে প্রতিস্থাপনে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহিত করা, নিয়মিত ভিত্তিতে আইটি সংগঠন এবং ইপিবি সদস্যদের সমন্বিত প্রতিনিধিদলকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং উত্তর আমেরিকায় মার্কটিং মিশনে প্রেরণ, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইন্টারনেটে হোম পেজ ব্যবস্থা করা, অন্য দেশ থেকে সাব কন্টাক্ট ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগানো, ডিজিটাল পণ্য ও সার্ভিসবিষয়ক আন্তর্জাতিক সব গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য ইপিবির সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট ট্রেডবডিকে নির্দেশনা প্রদান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে স্থায়ী লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনে ইপিবিকে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা, বাংলাদেশি আইটি পেশাদারদের নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করার জন্য বিসিসিকে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান, পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে আইটি ইন্ডাস্ট্রি সদস্যগণকে আইএসও ৯০০ এবং এসইআই সনদের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করা এবং আইটি মানবসম্পদের বৈশ্বিক চাহিদা কাজে লাগাতে অধিক পরিমাণে দক্ষ আইটি পেশাদার তৈরির সুপারিশ পেশ করা হয়।
কমিটির রিপোর্টটি ছিল প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাবান চিন্তারই প্রতিফলন। কমিটির সুপারিশ প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন ডিজিটাল পথযাত্রার ইতিহাসে আরও একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এই কমিটির একজন সদস্য এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বাণিজ্য সংগঠন বিসিএসের চারবার ও বেসিসের একবার সভাপতি ও এসব সংগঠনের নির্বাহী কমিটিতে বহু বছর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কমিটির সুপারিশসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পেরে আমি ধন্য। পরবর্তীকালে এরই ধারাবাহিকতায় সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত বাড়তে শুরু করে। আমার নেতৃত্বে জন্মলাভ করে সফটওয়্যার উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসিস, যা দেশের ট্রেডবডিসমূহের মধ্যে একটি বিরাট মহীরুহ হিসেবে আজ আবিভর্‚ত হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ বা ডিজিটাল যোগাযোগ প্রযুক্তি হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতির পাওয়ার হাউজ। এটি জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি ও উন্নয়ন সুসংহত করার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। ১৯৯৬ সালের পর সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রযুক্তির মহাসড়কে সংযুক্ত করার পথ সুগম হয়। বিএনপি সরকারের সময় দেশে একটি মাত্র মোবাইল কোম্পানিকে ব্যবসায় পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সংযোগ ফি ছিল প্রায় লাখ টাকা কল রেট ছিল আকাশচুম্বী। সংগত কারণেই মোবাইল ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মোবাইল ফোনের মনোপলি ব্যবসায় ভেঙে দিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। একচেটিয়া ব্যবসায়ের অবসান হয় মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ পায় এদেশের সাধারণ মানুষ দেশের টেলিযোগাযোগ খাত পরিণত হয় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের একটি থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার প্রস্তুতিও তখন শুরু করেছিল। কিন্তু ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশের অগ্রযাত্রা আবারো থমকে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর নির্বাচনী ইশতেহার ডিজিটাল কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে এবং খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তিবিদ প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়ের দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের টেলিকম খাতের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন বাংলাদেশের এই খাতটিকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগের একটি থ্রাস্ট সেক্টরে পরিণত করেছে।
২০০৯ থেকে ২০২০ এই ১১ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির সক্ষমতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকেই শুধু পাল্টে দেয়নি, পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। কভিড-১৯ সারা দেশের স্থলপথ, জলপথ, আকাশপথ স্থবির করে দিয়েছে। ডিজিটাল টেলিকম ব্যবস্থা বৈশ্বিক কঠিন দুর্যোগের সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দিয়েছে। ঘরে বসে মানুষ ব্যাংকিং ও ডিজিটাল কমার্স থেকে শুরু করে টেলিকনফারেন্সসহ অফিসের যাবতীয় কার্যক্রম সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে আর এটাই হলো শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষও এই সুবিধা থেকে বাদ যায়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর স্বপ্ন নয় বাস্তব।
মেহতার আগমন : বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহায়তায় ’৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫ জন মন্ত্রীকে যুক্ত করে একটি সেমিনারের আয়োজন করে, যাতে সভাপতিত্ব করি আমি। ভারতের সফটওয়্যার সমিতির নির্বাহী পরিচালক দেওয়াং মেহতা তাতে উপস্থিত ছিলেন। মেহতাকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাকে উপস্থিত করার ক্ষেত্রে স্যারের অবদান আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না। মেহতাকে বাংলাদেশে আসার জন্য নিউইয়র্কে গিয়ে আমন্ত্রণ জানান আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও তৎকালে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ আবদুল আজিজ। মেহতা আজিজ ভাইকে শর্ত দেন যে, তিনি শুধু সরকারের আমন্ত্রণেই বাংলাদেশে যেতে পারেন। আমি তখন সমিতির সভাপতি। আজিজ ভাই নিউইয়র্ক থেকে ল্যান্ডফোনে আমার বাসায় যোগাযোগ করেন। আমি মেহতাকে আনার জন্য সম্মতি প্রদান করি। আজিজ ভাই ঢাকায় আসার পর সরকারের পক্ষ থেকে কেমন করে আমন্ত্রণ জানানো যায় তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন। আমরা জামিলুর রেজা স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে স্যার ইপিবির সাথে যোগাযোগ করে সরকারিভাবে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা করে দেন। ডিসেম্বর মাসে মেহতা ঢাকা আসেন। আমরা ইপিবির সাথে বিসিএস মিলে যুগান্তকারী কর্মশালার আয়োজন করি। অনুষ্ঠানসূচিতে ছিল মন্ত্রীরা আগে বক্তৃতা দেবেন ও তারা চলে যাওয়ার পর মেহতা বক্তব্য রাখবেন। মেহতাই জানালেন যে মন্ত্রীরা চলে যাওয়ার পর তিনি বক্তৃতা দিলে এর তেমন কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে না। জেআরসি স্যার বিষয়টি ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যানের দৃষ্টিতে আনেন এবং মেহতাকে ১০ মিনিট কথা বলার সময় প্রদান করা হয়। মেহতা ৪০ মিনিটে ব্যাখ্যা করেন তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব, এর রফতানির সম্ভাবনা ও ভারতের অভিজ্ঞতা। আমি স্মরণ করতে পারি যে, ওই কর্মশালা আয়োজনের মাত্র তিন সপ্তাহের মাঝে সরকার প্রথমেই কমপিউটারের সফটওয়্যারের শুল্ক প্রত্যাহার করে ও ’৯৮-৯৯ সালের বাজেটে কমপিউটারের ওপর থেকে সব শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করে। পুরো প্রক্রিয়ায় জেআরসি স্যার আমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।
এলিফ্যান্ট রোডের বাসা, তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল শিক্ষার যাত্রা : স্যারের ঢাকা শহরের পৈতৃক বাড়িটি হচ্ছে ৬৮, এলিফ্যান্ট রোড। ’৮৭ সালে কমপিউটারে বাংলা ও ’৮৮ সালে বিজয় কিবোর্ড প্রবর্তন করার পাশাপাশি আমি তখন দেশজুড়ে কমপিউটার প্রশিক্ষণ দিই। ঢাকার নানা জায়গায় ভাড়া থাকতে থাকতে ’৯৭-৯৮ সালের দিকে এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় থাকা শুরু করি। আমার প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল গ্রাফিক্স ও মাল্টিমিডিয়া। তখন আমাদের পারিবারিক বন্ধু ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বর্তমানে সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামানের সাথে একটি কমপিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করার পরিকল্পনা করি। আমরা তখন জানতে পারি যে স্যারের বাসার দোতালাটা খালি। স্যারের কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিলাম যে স্যার আপনার দোতালাটায় এক পাশে আমরা থাকব এবং আরেক পাশে কমপিউটার প্রশিক্ষণ দেব। স্যার ছাত্রছাত্রীদের অত্যাচারের বিষয়টি মাথায় রেখেই সম্মতি দিলেন। সেই মোতাবেক আমরা ‘সুবর্ণ বিজয়’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলাম। সুবর্ণ ছিল আক্তারের ছেলের নাম আর বিজয় আমার ছেলের নাম। সেই সময়ে ’৯৯ সালে স্যারের বাসার দোতালায় বসে গাজীপুরের আজিমু্িদ্দন কলেজের অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের সাথে কথা হয়। মুজিবুর রহমান একটি কমপিউটার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তাব করেন। আমি তখন তাকে এর সাথে শিশুদের একটি স্কুলও চালু করার প্রস্তাব করলাম। মুজিবুর রহমান রাজি হলেন। আমি স্যারকে জানালাম যে, আমি গাজীপুরে একটি আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল চালু করব। ঢাকার কাছে গাজীপুরের ছায়াবীথিতে ’৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সেই স্কুলটি চালু করার প্রস্তাব করে স্যারকেই উদ্বোধন করতে বলায় তিনি সস্ত্রীক সেটির উদ্বোধন করেন।
বস্তুত বাংলাদেশের ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার সূচনাটি আমি তার হাত দিয়েই করতে পারি। এসবের বাইরেও তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়ন থেকে সব বিষয়ে আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ও ব্যবসায়ী বিধায় বিশেষ মহলের কাছে অপাঙ্ক্তেয় বিবেচিত হলেও তিনি ছিলেন আমার আশ্রয়দাতা ও অভিভাবক।
আজ যখন তিনি নেই তখন তার কথা ভাবতেই মনটা ভারী হয়ে যায় আর চোখটা পানিতে ভরে আসে।