• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > স্মার্ট বাংলাদেশ ও প্রযুক্তিগত নতুন উদ্ভাবন
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: নিজস্ব প্রতিবেদক
মোট লেখা:১৪৪
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০২৪ - মে
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
স্মার্ট বাংলাদেশ ও প্রযুক্তিগত নতুন উদ্ভাবন
বাংলাদেশে প্রায় ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আবার ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদনও রয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তারে সহায়ক হবে। বাংলাদেশে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ—সুবিধা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক বেশি। আবার অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব মানের ল্যাবরেটরি থাকা সত্ত্বেও গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির জন্য থিসিস বাধ্যতামূলক সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ অতীব জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ বরাদ্দ কম হওয়ায় গবেষণার মানও নিম্নমুখী। সেক্ষেত্রে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের গুণমানসম্পন্ন থিসিস করতে অনেকটা হিমশিম খেতে হয়। আর এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বরাদ্দকৃত গবেষণা অনুদান গবেষণাভিত্তিক ডিগ্রি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ও রাখবে।

ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সরবরাহ যন্ত্রপাতির জীবনীশক্তি বা লাইফটাইম সর্বোচ্চ ৫—৬ বছর। এরপর চিপসসেট পরিবর্তন হয়। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে আসে আরও উন্নত যন্ত্রাংশ। এ বিষয় মাথায় রেখেই প্রযুক্তিগত অবকাঠামো আপডেট করার সিদ্ধান্ত নেন দায়িত্বশীলরা। বর্তমানে সরকারি—বেসরকারি অপারেটর মিলিয়ে যে পরিমাণ ব্যান্ডউইথ বহন করছে তাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৬ টেরাবাইট সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনা যেতে পারে—এমন অভিমত দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ দল। কিন্তু ফাইভজি প্রকল্পের আওতায় ২৬—এর পরিবর্তে ১২৬ টেরাবাইট ধারণ ক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনাকেটার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। সর্বোচ্চ ১৫ মিলিয়ন ডলার খরচে যে কাজ করা সম্ভব, সেটা করতে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার—অর্থাৎ ৩২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে যন্ত্রপাতি কেনার চিন্তা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ মার্চ ২০২৪ তার কার্যালয়ের শাপলা মিলনায়তনে ২০২৩—২৪ অর্থবছরের জন্য নির্বাচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১০ জনকে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ, ১৯ জনকে বিশেষ গবেষণা অনুদান ও ২৫ জনকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ নিজ হাতে তুলে দিয়েছেন।

এই সব ফেলোশিপের আওতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ রয়েছেন। এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির জন্য নির্বাচিত ফেলোগণ ও গবেষকবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্বাচিত ফেলোবৃন্দ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হচ্ছেন। গবেষণার মাধ্যমে তাদের অর্জিত ফলাফল দেশে ও বিদেশে সুনাম অর্জন করছে, যা ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বড় ভূমিকা রাখবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত অনেক ছাত্রছাত্রী বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হচ্ছেন। ফলে একদিকে যেমন গবেষণার দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তিও অলংকৃত হচ্ছে। তাছাড়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান বাংলাদেশে প্রয়োগের সুযোগ তো থাকছেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা ও শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছাড়াও গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের প্রভাষক থেকে গ্রেড—১ অধ্যাপকে পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হয় অনেক ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে প্রতি বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের গবেষণার জন্য যে বিশেষ গবেষণা অনুদান দিয়ে যাচ্ছে, তাতে করে গবেষণালব্ধ ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের পাশাপাশি তাদের পদোন্নতির জন্য দক্ষতা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে বলেছেন, বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও গবেষকদের গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানোর উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষিবিজ্ঞানের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, কৃষিক্ষেত্রে গবেষণার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে খরা, লবণাক্ত ও জলমগ্ন সহিষ্ণু ধানের চাষাবাদ হচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদেরই গবেষণার ফলাফল।

গবেষণার মাধ্যমে মানসম্মত ওষুধ আবিষ্কারের পাশাপাশি মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে উল্লেখ করে জানান, বিদেশিদের পাশাপাশি বাংলাদেশি বহু বিজ্ঞানী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অবদান রেখেছেন। আশা করা যাচ্ছে যে, বাঙালি জাতি তাদের গবেষণার মাধ্যমেই বিশ্বের মানচিত্রে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পাবনাতেই স্থাপিত হবে। এর ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হবে।

গবেষণার মাধ্যমে একটি দেশকে উন্নত রাষ্টে্র পরিণত করার কাজটি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবিত হচ্ছে। এসব উৎপাদিত পণ্য ও প্রযুক্তি প্যাটেন্টের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা তহবিল আরো বাড়ানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও উন্নত দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন পণ্য আবিষ্কারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে বলে আশা করা যায়। এর ফলে ভিশন ২০৪১—কে সামনে রেখে গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্টে্র পরিণত করা সহজতর হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানীরা স্মার্ট বাংলাদেশ তথা স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট অর্থনীতি গঠনে ভূমিকা রাখবেন।

একটি দেশ উন্নত আর সমৃদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে এবং সেটা একেবারে তৃণমূল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ব্যাপার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। অন্যভাবে বলা যায়, দেশের একেবারে হতদরিদ্র মানুষটি থেকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবনকে সেটি স্পর্শ করবে। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলি তখন আমরা সেটাই কল্পনা করি। সবাইকেই নানা ধরনের দাপ্তরিক কাজ করতে হয়, সব কাজ হবে সহজ। এই মুহূর্তে ছোট—বড় সবাইকে তার জন্মনিবন্ধন করতে হচ্ছে, অনেকের কাছে সেটা বিভীষিকার মতো, অথচ এটা হওয়া উচিত ছিল কোনো একটা ওয়েবসাইটে দুই—তিনটি তথ্য দেওয়ার মতো সহজ। এই দেশে আরও একটা বিভীষিকা হচ্ছে এনআইডি কার্ডের ভুল সংশোধন, অনেকেই চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হয়ে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেন। এটা এরকম হওয়ার কথা ছিল না।

এর পেছনের কারণগুলো কি সেটাও সবাই জানি, সেটা হচ্ছে দুর্নীতি। একসময় দুর্নীতি ছিল গোপন একটি ব্যাপার, আজকাল দুর্নীতি অনেকটা গ্রহণযোগ্য অধিকার বলে বিবেচনার বিষয় হয়ে গেছে প্রায়। যখন স্মার্ট বাংলাদেশ কল্পনা করা হয়, তখন প্রথম কল্পনা সবকিছু প্রযুক্তির আওতায় চলে আসার পর পুরো রাষ্ট্র স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হবে। দুর্নীতির কারণে যে সম্পদ দেশে ব্যবহৃত হয় না সেটাও আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যবহার হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ মানেই হলো ব্যক্তিগত জীবন কিংবা দেশ পরিচালনায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে জীবনকে সহজতর করা। প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে তাই সেই প্রযুক্তির ব্যবহার হতে হবে সহজ, তা না হলে সেটি সবাই ব্যবহার করতে পারবে না। কমবয়সি শিক্ষিত বিত্তশালী মানুষ যদি স্মার্ট বাংলাদেশের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে; কিন্তু পিছিয়ে পড়া মানুষ যদি সেটি গ্রহণ করতে না পারে তা হলে দেশে এক ধরনের বিভাজন সৃষ্টি হবে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন তার একটি উদাহরণ। চমৎকার একটি প্রযুক্তি; কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষের সেটি নিয়ে এক ধরনের ভীতি। আবার মেট্রোরেলের কার্ড আরেকটি প্রযুক্তি, এর ব্যবহার এত সহজ সেটি নিয়ে কারও ভীতি নেই। তাই আমাদের দৃষ্টিতে স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হবে সবার জন্য এটি যেন শুধু ব্যক্তি বিশেষের জন্য না হয়।

স্বাভাবিকভাবেই স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে সবার প্রথম এই দেশের সব মানুষের যাবতীয় তথ্য নিয়ে এক বা একাধিক বিশাল ডাটাবেজ তৈরি করা। আমাদের এনআইডির ডাটাবেজ তার একটি চমৎকার উদাহরণ— পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ এরকম অসাধারণ কাজ করতে পারেনি। অর্থনৈতিক অনেক কাজ ডিজিটাল করা হবে, ক্যাশলেস সোসাইটি হবে। আমাদের চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য—সংক্রান্ত সেবাও এর আওতায় চলে আসবে, শিক্ষার বেলায়ও তাই হবে। কাজেই এই ডাটাবেজগুলো হবে প্রধান অবলম্বন। এগুলো বিশ্লেষণ করে যেকোন তথ্য বের করা যাবে, একই সঙ্গে সেটার অপব্যবহার করে সর্বনাশ করে ফেলা সম্ভব। ভবিষ্যতের কাল্পনিক জগতে ডাটাবেজ থেকে একজনের নাম অপসারণ করে একজন জীবিত মানুষকে অদৃশ্য করে দেওয়া নিয়ে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখা হচ্ছে।

স্মার্ট জেনারেশনকে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে, যাকে প্রাইভেসি বলা হয়, সেটিই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ডিভাইসমুখী হয়ে উঠছে, তাতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দক্ষতা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? ডিভাইসমুখী হওয়ার কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবন অনেক দিকে সহজ হয়েছে, নানা ধরনের অ্যাপ চলে আসার কারণে দৈনদিন জীবনে অনেক কাজ করতে পারে, যেটা আগে কখনো করা সম্ভব ছিল না। সে জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এবং সে কারণে একাধিক প্রজন্মের যে মানসিক ক্ষতি হয়েছে সেটি পূরণ করা সম্ভব নয়।

বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হচ্ছে ‘ডাটা’। পৃথিবীর প্রভাবশালী সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো সেই ডাটার মালিক এবং আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তাদের হাতে অকাতরে সেই ডাটা তুলে দিচ্ছে। সেই ডাটা বিশ্লেষণ করে এই দানবীয় সফটওয়্যারগুলো সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। যেহেতু ডিভাইসের ব্যবহার আন্তরিক অর্থে মাদক ব্যবহারের মতো তাই সাধারণ মানুষ সেখান থেকে বের হতে পারছে না। তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে, মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের স্কুলের বাচ্চাদের স্মার্ট ফোন থেকে সরিয়ে রেখেছিলাম, কোভিডের সময় তাদের হাতে স্মার্ট ফোন উঠেছিল এবং সেই স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। একটি অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে।

শিশু এবং কিশোর—কিশোরীদের স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের দেশের মানুষ নতুন বিষয় গ্রহণ করতে আগ্রহী। এই দেশে তরুণ মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করার সময় জটিল কোনো চ্যালেঞ্জ আসার কথা নয়। প্রযুক্তিবান্ধব দেশগুলোতে এমন অমানবিক পরিবেশ আছে, আমরা সম্ভাব্য স্মার্ট বাংলাদেশ কেমন হতে পারে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। স্মার্ট বাংলাদেশ পরিকল্পনা নেওয়ার পর আরও অনেক দ্রুত এগিয়ে যাব— সেটাই হচ্ছে পার্থক্য।

২০৪১ সালে স্বাভাবিক গতিতে বাংলাদেশ প্রযুক্তি আর সব কাঠামোতে অনেক এগিয়ে যাবে, খালি চোখে সেটা দেখতে পাব। কিন্তু তার সঙ্গে চোখে দেখা যাবে না সেরকম একটা উন্নতি হবে এই দেশের মানুষের ভেতর সেটাই সবার স্বপ্ন। দেশের মানুষ গবেষণা করে নতুন পৃথিবীতে জ্ঞান সৃষ্টি করার কাজে এগিয়ে যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি বিষয় হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসব যোগাযোগ মাধ্যমের সব প্রক্রিয়াই সব স্তরের মানুষের মধ্যে এমনভাবে চেপে বসেছে যেন এক দিনও একে বাইরে রেখে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে মানুষের চিন্তা—চেতনার পরিবর্তন হচ্ছে এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এসব সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারের রয়েছে বিভিন্ন অ্যাপস।

এই অ্যাপসগুলোর নাম এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে তা একেবারে আমাদের সঙ্গে মিশে গেছে। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে আমরা সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদন করে আসছি। বিভিন্ন রকমের কার্যসম্পাদনের জন্য এসব যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তবে এর ব্যবহারের ধরন যা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। প্রত্যেকটি জিনিসের ভালো—মন্দ দু’টো দিক থাকতে পারে। মূলত এর ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে এর ভালো—মন্দের দিক। সম্প্রতি এর ব্যবহার যে হারে বাড়ছে তা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেটা ভাবার সময় হয়েছে। ভাবনা যদি সঠিক সময়ে জন্ম না নেয় তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ এ কথা বলা চলে। আমাদের সমাজের মানুষ এতটা হুজুগে কাজ করে যে কাজ করার আগে সামান্যটুকু ভাবনাও থাকে। যুব সমাজ যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু সেই যুব সমাজই যখন হয়ে যাচ্ছে অস্থির প্রবণ সেখানে তাদের কাছে ভালো কিছু চাওয়াটা অস্বাভাবিক হবে বলেই মনে হচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে পরিচিত শব্দ ফেসবুক। একবারে বলা চলে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে নামটি অত্যন্ত পরিচিত। কিছু কিছু মানুষের কাছে কিছুটা বিরক্তিকর হলেও যুব সমাজের কাছে তা অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। এর ব্যবহার দিনদিন এতই বাড়ছে যে এর ব্যবহার ছাড়া যেন সময় কাটানো কল্পনা করা সম্ভব নয়। এক সময় বিদ্যালয়ের মাঠ যখন বিকেলে কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকত খেলোয়াড়দের নিয়ে এখন সে চিত্র আর লক্ষ্য করা যায় না। মাঠ আছে খেলোয়াড় নেই। মাঝেমধ্যে বিকেলে মাঠের ওপর বসে থেকে দলবেঁধে চলে ফেসবুক দেখা। শুধু ফেসবুক দেখার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয় যুব সমাজ। এসব অ্যাপস ব্যবহার করে বিভিন্ন রকমের অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। সরে যাচ্ছে লেখাপড়ার টেবিল থেকে। শ্রমমেধা ব্যবহার না করে হয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর। বই পড়া শব্দটি এখন নির্বাসিত। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে এমনকি দূরে চলে যাওয়া মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে আবার এটি একটি খুব ভালো দিক।

কম খরচে সব সময় আত্মীয়—স্বজনের খোঁজখবর রাখা সহজসাধ্য হয়েছে। মোবাইল ফোনে কথা হলেও সরাসরি ছবি দেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে। যার ফলে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হচ্ছে আরও বেশি। নিঃসন্দেহে এ বিষয়টি যথেষ্ট আনন্দ দেয়। তাই এ কথা বলা চলে যে এসব সামাজিক যোগাযোগের ফলে কম খরচে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হচ্ছে; কিন্তু এসব জায়গা থেকে আমাদের গ্রহণের জায়গায় যদি মন্দ দিকটিই প্রাধান্য পায় তাহলে জটিলতা বাড়ে। সম্প্রতি তাই ঘটছে আমাদের দেশে তা না মেনে উপায় নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনো তথ্য অতি দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে সব জায়গায়।

যার ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা। সম্প্রতি সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে সমাজের ভালো কাজের জন্য অনেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে যা আমাদের আশার বাণী শোনায়। এ থেকে সমাজের অনেক ভালো ভালো কাজের সূত্রপাত হচ্ছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের মধ্যে জেগে উঠছে মানবতা। মানুষ হচ্ছে সামাজিক। একজনের সহায়তায় অন্যজন বাড়াচ্ছে সহায়তার হাত এ থেকে আগামী প্রজন্ম আরও উৎসাহিত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। আবার অন্যদিকে এসব যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ সমাজের মধ্যে প্রতারণা করার নেশা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তরুণ—তরুণীদের মধ্যে অসামাজিক কার্যকলাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার জন্য তৈরি হচ্ছে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা। এ ছাড়া বিশেষ সুবিধাভোগীরা বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে তৈরি করছে অপরাধের রাজত্ব।

এর মূল কারণ হলো অতিমাত্রায় এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। একটা সময় যখন তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন খেলাধুলা কিংবা সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকত তখনকার সময়ে এত অপরাধপ্রবণতা লক্ষ্য করা যেত না। যার ফলে পারিবারিক শক্তি ও সামাজিক শক্তিটা অনেক বেশি থাকত। সরকার এই বিষয়টা নিয়ে সময় না দিলেও যারা সমাজকে নিয়ে চিন্তা করে তাদের ভাবনায় এ বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। এটা যে কেবল নতুন প্রজন্মের সাথী এ হিসেবে শুধু চিন্তার বিষয় তা নয়— এটা সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে বিধায় কপালে ভাঁজ পড়েছে বেশি। কিছু দিন আগেও সামাজিক কারণে মেয়েদের মধ্যে এ প্রবণতা কম থাকলেও বর্তমানে পাল্লা দিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রভাব যে কতটা কেবল সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করতে পারেন শিক্ষকরা। ক্লাস কিংবা পরীক্ষার হলেও মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও তা ব্যবহার রোধ করা যাচ্ছে না।
শিক্ষকের চাকরি যাওয়া কিংবা পাল্টা মার খাওয়া কিংবা অপমানিত হওয়ার ভয়ে শাসন থেকেও বিরত রয়েছেন। তার চেয়ে আরও কঠিন অবস্থানে রয়েছেন পরিবার। ঠিক সময়ে সন্তানের জীবনের কথা চিন্তা এসব মোবাইল ব্যবহার থেকেও বাঁধা দিতে পারছেন না। এ যেন এক কঠিন বাস্তবতায় পরিবার এবং শিক্ষক সমাজ। যে যার মতো তার ইচ্ছে হচ্ছে ব্যবহার করছে। রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়ম নেই এসব ব্যবহারের বেলায়। নেই কোনো বয়সের বাধ্যবাধকতা এবং অ্যাপস ব্যবহারের বিধান। এসব বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজেই এসব ব্যবহারের ফলে কম বয়সের ছেলেরা বিপথে যাচ্ছে ফলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বিপরীত দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে এর লাগাম টানতে না পারলে চরম খেসারত দিতে হবে জাতিকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেহেতু বন্ধ করা সম্ভব নয় তাই সরকারের পক্ষ থেকে এর নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বর্তমান প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে পারলে এসব অপকর্ম থেকে কিছুটা হলেও সরে আসবে তরুণ সমাজ।

স্মার্ট দেশ গড়তে সরকারের চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ঘোষণা— বাংলাদেশকে তারা স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চান। স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হলে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি এবং স্মার্ট সমাজ গড়তে হবে। এ কাজটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষভাবে স্মার্ট অর্থনীতি এবং স্মার্ট সমাজ নিশ্চিত করা। সব মিলিয়ে নতুন সরকারের সামনে বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জই অপেক্ষা করছে। স্মার্ট বাংলাদেশের মূল সারমর্ম হবে— দেশের প্রতিটি নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, সেই সঙ্গে অর্থনীতির সমস্ত কার্যক্রম আমরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে করব। আমাদের সমস্ত সমাজটাই হবে স্মার্ট সমাজ। সেই বিবেচনায় ২০২১ থেকে ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রণয়ন শুরু হয়ে গেছে অর্থাৎ এসময়ে কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নটা হবে, তার একটা কাঠামো পরিকল্পনা বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি শত শত বছরের পশ্চাৎপদতা অতিক্রম করে সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার দারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি পাল্টে দিয়েছে চিরচেনা বাংলাদেশ, অভাবনীয় রূপান্তর ঘটেছে মানুষের জীবনযাত্রার। বর্তমানে শতভাগ মানুষের হাতের নাগালে মোবাইল ফোন এবং শতভাগ এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায়। ২০০৮ সালে মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ছিল চার কোটি ৬০ লাখ, বর্তমানে এ সংখ্যা এসে তা ১৮ কোটি ৬১ লাখ অতিক্রম করেছে। সে সময় ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল মাত্র ৪০ লাখ, বর্তমানে যার সংখ্যা ১৩ কোটি ৬০ লাখ। টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত লাইসেন্স ছিল যেখানে ৬০৮টি, বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে যার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৯৬টি।

স্মার্টফোন ব্যবহার করছে প্রায় ৫.৯২ গ্রাহক। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হাজার হাজার তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ফাইবার অপটিক ক্যাবল সম্প্রসারণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, হাওড়, বিল, চর, পাহাড়, উপকূলীয় ও দ্বীপ এলাকায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হয়েছে। সারাদেশ ফোরজি মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। আমরা ফাইভজি যুগে প্রবেশ করেছি। ২০১৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট—২ উৎক্ষেপণ, তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ স্থাপন এবং ফাইভজি চালুর বিষয়ে যে প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, তা বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু করেছে। মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক এখন মানুষের জীবনের শ্বাস—প্রশ্বাসের মতো।

বর্তমানে মোবাইল ফোনের বাজারের শতকরা ৯৭ ভাগই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। মোবাইল ফোন এবং এর বিভিন্ন অ্যাপসের ব্যবহার, উচ্চ গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ওভার দ্য টপ (ওটিটি) অ্যাপস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্যাটেলাইটসহ আধুনিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি দেশের জনগণের জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। আমাদের মূল লক্ষ্য সবার কাছে মানসম্মত, নিরাপদ ও সুলভমূল্যে টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত করা। এ দেশের মেধাবী, তারুণ্যদীপ্ত ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ প্রতিটি গ্রাম ডিজিটাল গ্রামে রূপান্তর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে চালু হয়েছে, যার মাধ্যমে ঘরে বসেই তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে প্রান্তিক মানুষ, ঘরে বসে পাচ্ছে টেলিমেডিসিন সেবা, সেই সঙ্গে শহরের ন্যায় গ্রামেও ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হয়েছে। দেশে মোবাইল প্রযুক্তিকে আরও সুরক্ষিত করতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ সিম নিবন্ধনের পাশাপাশি মোবাইল হ্যান্ডসেট নিবন্ধনের জন্য চালু হয়েছে ন্যাশনাল ইকুইপেমন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্ট্রার—এনইআইআর।

এতে সিম ও মোবাইল হ্যান্ডসেট নিবন্ধন পূর্ণাঙ্গভাবে ডিজিটালাইজড হয়েছে। ফলে, সাইবার অপরাধ প্রবণতা কমার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পথ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে চালু হয়েছে সারাদেশের জন্য একই মূল্যে ব্রডব্যান্ড এক দেশ এক রেট’ সেবা। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে ৬০০০ জিবিপিএস—এরও বেশি আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পরও হাতে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যান্ডউইথ আছে ও থাকবে।
দেশে নেটওয়ার্কের বর্ধিত চাহিদা মিটিয়ে ফ্রান্স, সৌদি আরব ও ভারতের ত্রিপুরায় ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করা হচ্ছে। ভুটান ও নেপাল এবং ভারতের অসম ও মেঘালয়ে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করার বিষয়ে প্রক্রিয়া চলছে। তৃতীয় সাবমেরিন সংযোগ সম্পন্ন হলে ২০২৫ সালে অতিরিক্ত আরও প্রায় ১৩২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ সংযুক্ত হবে। এছাড়াও প্রথম সাবমেরিন ক্যাবলে আরও ৩৮০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ সংযুক্ত হচ্ছে অর্থাৎ বর্তমানে বিদ্যমান ক্যাপাসিটির চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়ন ও ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়নের সদস্যপদ অর্জন, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় ভূ—উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, টিএন্ডটি বোর্ড গঠন ও কারিগরি শিক্ষা প্রসারে গৃহীত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি বিকাশে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন।

এর ফলে শতশত বছরের পশ্চাৎপদতা অতিক্রম করে ১৯৬৯ সালে বিশ্বে শুরু হওয়া ইন্টারনেট ভিত্তিক শিল্প বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে অংশগ্রহণের যাত্রা শুরু হয়। ডিজিটাল সংযুক্তি সম্প্রসারণের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা একটি উদ্বেগের বিষয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সহায়তায় নির্বাচনকে ডিজিটাল করেন। ২০০৯ সালে তিনি সরকার গঠন করে যখন দেশটিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করলেন তখন ডিজিটাল সংযুক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ডিজিটাল যন্ত্র এসব আলোচনায় আসতে শুরু করল। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডিজিটাল সংযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে ডিজিটাল মহাসড়ক নির্মাণ, ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সহজ লভ্যতা নিশ্চিতকরণ। একই সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগও ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল নিশ্চিত করার পর একে আরো এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও বিশ্বের কাছে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে তুলে ধরার মানসে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হলো, তখন অনেকে বিদ্রƒপ করতে পিছপা হয়নি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এখন সবাই আমরা এর সুফল ভোগ করছি। এখনো যে তারা স্মার্ট বাংলাদেশের কথাকে ব্যঙ্গ করছে না, তা নয়। তবে একসময় তারাও বুঝতে পারবে স্মার্ট বাংলাদেশের মাধ্যমে কিভাবে সুফল পাওয়া যায়।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে সব কিছুই স্মার্ট হতে হবে। যে কাজটি বেশি করা দরকার তা হলো স্মার্ট জনগণ তৈরি করা। আর স্মার্ট জনগোষ্ঠী তৈরি করতে হলে এর সঙ্গে সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় স্মার্ট হতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আমাদের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আরো বেশি করে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। আমাদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, টেকনোলজি সব কিছুই হতে হবে স্মার্ট। আমাদের কাজকর্ম, চিন্তা—চেতনা, মনমানসিকতা, যোগাযোগ, টেকনোলজি সব ক্ষেত্রে আমাদের স্মার্ট হতে হবে।

দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করার জন্য এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং করে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কোনো একটি বিষয়ে পড়ার পর তার নিজের কী কী শিখন এবং দক্ষতা অর্জিত হলো, তা বুঝতে পারবে। আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম এমনভাবে তৈরি করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজ অনলাইনে করতে পারে। আমরা ই—নথিতে পদার্পণ করেছি। আমরা এমনভাবে শিক্ষার্থীদের তৈরি করার চেষ্টা করছি, যেখানে তারা দেশ ও দেশের বাইরে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সক্ষম। আমাদের শুধু দেশীয় কর্মসংস্থানের কথা ভাবলেই চলবে না, বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী জনশক্তি তৈরি করতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছে সরকার। শিক্ষার্থীদের আমরা একটি পরিপূর্ণ শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা চলছে, যাতে সে দক্ষ হয়ে শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারে। দক্ষতার একটি বড় মাধ্যম হলো যোগাযোগ। বর্তমান যুগে যে যত বেশি যোগাযোগে পারদর্শী, তার সফলতা তত বেশি। যোগাযোগকে দক্ষতার পিলার বলা হয়ে থাকে। আবার যোগাযোগ মানুষকে কোনো একটি কাজ করার ক্ষেত্রে সাহস বাড়িয়ে দেয়।

একটি স্মার্ট বাংলাদেশ চাইলে, আমাদের সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেককে কাজ করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করা সম্ভব নয়। স্মার্ট মানুষ মানে স্মার্ট বাংলাদেশ। আমরা যদি সবাই মিলে চেষ্টা করি, তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত স্মার্ট দেশে রূপ দেওয়া অসম্ভব হবে না। স্মার্ট নাগরিকদের নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্মার্ট সমাজ ব্যবস্থা আর স্মার্ট অর্থনীতি সেই স্মার্ট বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবে তাদের স্মার্ট সরকার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এনালগ যেমন হয়েছে ডিজিটাল আর টাইপ রাইটারকে ঠেলে দিয়ে সেই জায়গাটি দখলে নিয়েছে ল্যাপটপ, তেমনি সময়ের বিবর্তনে সোনার বাংলার নাম আর ধরনটি পাল্টে গেলেও তার মূল এসেন্সটি রয়েছে অপরিবর্তিত।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো অগ্রসরমান ডিজিটাল প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে বিভিন্ন কাজে মানুষের প্রয়োজনীতা পাবে না তা নয়, বরং প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য দক্ষ মানুষের প্রয়োজন হবে। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। মানুষের ভিতরে যে সৃজনশীলতা রয়েছে, সেটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। ডিজিটাল বিভাজন কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামের তৃণমূল মানুষের কাছেও প্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে পুরোপুরিভাবে। আর্থিক সংগতি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তি পরিবর্তনশীল হওয়ায় পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিকল্পে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে, সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে হবে। ফ্রি—ল্যান্সারদের ভাষা শেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে এবং একই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশে মানুষ নতুনভাবে চিন্তা করবে এবং উদ্ভাবনী শক্তিগুলোকে বিকশিত করে নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন করবে। লক্ষ্য অর্জনে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারলে, তারা অসাধ্য সাধন করতে পারবে।

হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও রিসার্চ ফেলো
ফিডব্যাক: hiren.bnnrc@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০২৪ - মে সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস