লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মতিয়ূর রহমান সিদ্দিকি
মোট লেখা:৩
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
বেতার নেটওয়ার্ক
কমিউনিটি রেডিও মুক্তি পেলো
বর্তমান যুগ তথ্যের যুগ৷ তথ্যই হলো শক্তি৷ তথ্য পাওয়া ও না পাওয়ার সুযোগের ওপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয়েছে তথ্য ধনী বা ইনফো-রিচ এবং তথ্যগরিব বা ইনফো-পুওর শ্রেণী৷ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তথ্যের ওপর উন্নত বিশ্বের দখল এবং নিয়ন্ত্রণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের নতুন রূপ তথ্য সাম্রাজ্যবাদ৷ এ পরিস্থিততে প্রচলিত গণমাধ্যম ব্যবস্থার পাশাপাশি উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চ লোকমিউনিটি রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে৷
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রেডিও খুবই শক্তিশালী এক মাধ্যম৷ গ্রামাঞ্চলে ফোন কিংবা বিদ্যুৎ ছাড়া যে মানুষগুলোর বসবাস, তাদের কাছে খুব সহজেই রেডিও পৌঁছে যেতে পারে৷ আবার যে মানুষগুলো লেখতে কিংবা পড়তে জানে না, তাদের কাছে যেতেও রেডিওর কোনো বাধা নেই৷ তথ্য প্রচারের আঙ্গিনায় রেডিওর স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক আলোচনা আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রেও রেডিওর ভূমিকা অগ্রগণ্য৷ কমিউনিটি রেডিও এমন একটি ধারণা, যা একটি শক্তিশালী মাধ্যম এবং তা তৃণমূলের মানুষকে একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে৷ উপযোগী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে এটা মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তোলে; জনগণ এবং সরকারের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে দৃঢ়তর করে তোলে, সেই সাথে দারিদ্রবিমোচন ব্যবস্থাকেও সহজতর করে তোলে৷ বাংলাদেশ, বিশেষ করে আমাদের গ্রামাঞ্চলে এই মাধ্যম ব্যবহার করে বহু মাত্রিক সুফল নিশ্চিত করা যেতে পারে৷
অনেক সভা, সেমিনার, আলোচনা, প্রতিবেদন রিপোর্ট প্রকাশের পর ১২ মার্চ, ২০০৮ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কমিউনিটিরেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা ২০০৮ প্রকাশ ক৷লো এই নীতিমালার আলোচ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো৷
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য কমিউনিটি রেডিওর মূল নীতিগুালো বাংলাদেশেও অনুসৃত হয়েছে৷ কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি কমিউনিটি রেডিও পরিচালনা করতে চায়, তাহলে সে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে নিম্নেবর্ণিত নীতিমালা মেনে চলতে হবে :
সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানটিকে অবশ্যই অলাভজনক হতে হবে, কমিউনিটি রেডিওর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কমপক্ষে পাঁচ বছর কমিউনিটি পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা অবশ্যই থাকতে হবে, কমিউনিটি রেডিও স্টেশনকে অবশ্যই নিশ্চিত ও সুনির্দিষ্টভাবে কমিউনিটির লোকজনকে সেবা দিতে হবে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ধ্যানধারণার প্রতিফলন সমৃদ্ধ একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকতে হবে, সম্প্রচার অনুষ্ঠানসূচিতে কমিউনিটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ, নারীর অধিকার, গ্রামীণ ও এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন, পরিবেশ, আবহাওয়া ও সাংস্কৃতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে এবং এতে অবশ্যই জনগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানটির অবশ্যই আইনগত বৈধতা থাকতে হবে এবং সম্প্রচারের পরীক্ষামূলক সম্প্রচার পর্বে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ মূল ধারার গণমাধ্যমের সুযোগ এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার লাভ করবে৷
লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া
সিনিয়র সহকারী সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয়, ভবন নং-৪, কক্ষ নং-৮০৫, বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের জন্য নির্ধারিত আবেদন পত্র প্রদান করা হচ্ছে৷ এ আবেদনপত্র পূরণ করে ১৫ এপ্রিল ২০০৮ তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে৷ আবেদনকারী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহ যাদের কমপক্ষে পাঁচ বছরের দারিদ্র বিমোচন/ গণমাধ্যম/তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে৷ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অবশ্যই আইনগত বৈধতা থাকতে হবে কিংবা এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রিভুক্ত হতে হবে৷ পূর্ণাঙ্গ নীতিমালাটি www.moi.gov.bd তে পাওয়া যাবে৷
সম্প্রচার কার্যক্রম আরম্ভ করার জন্য অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে বিটিআরসি থেকে ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গ বরাদ্দ নিতে হবে; পরীক্ষামূলক সম্প্রচার পর্বে একটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা শুধুমাত্র একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনার লাইসেন্স পাবে; প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়ার এক বছরের মধ্য আবেদনকারীকে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপন করতে হবে৷ কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্যে রেডিওর যন্ত্রপাতি আমদানি ও প্রতিস্থাপনের জন্য অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন, বিধিবিধান মেনে চলতে হবে৷ এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে বিটিআরসির শর্তসমূহ প্রতিপালন করতে হবে৷ চূড়ান্ত অনুমোদন/লাইসেন্স পাওয়ার পর সম্প্রচার কার্যক্রম শুরু করবে৷ প্রথমে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার তারিখ থেকে দুই বছরের জন্য পরীক্ষামূলক লাইসেন্স দেয়া হবে৷
লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া জন্য অযোগ্য
ব্যক্তিগত বা যৌথভাবে পরিচালিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল বা তাদের অঙ্গসংগঠন যেমন ছাত্র সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি, দেশী-বিদেশী যেসব কোম্পানি যারা মালিক বা শেয়ার হোল্ডারকে লভ্যাংশ প্রদান করে থাকে, আন্তর্জাতিক/বিদেশী বেসরকারি সংস্থা বা বিদেশী সম্প্রচার সংস্থা/চ্যানেল এবং সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা৷
লাইসেন্স ফি
কমিউনিটি রেডিও একটি উন্নয়নমূলক প্রয়াস এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকার প্রাথমিকভাবে প্রতিটি স্টেশনের জন্য লাইসেন্স ফি বিশ হাজার টাকা এবং বাজেয়াপ্তযোগ্য জামানত এক লাখ টাকা ধার্য করেছে৷ ফ্রিকোয়েন্সি ফি বিটিআরসি নির্ধারণ করবে৷
কারিগরি কাঠামো
প্রত্যেকটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের ব্যাপ্তি হবে এর অবস্থানকে কেন্দ্র করে চারদিকে ১৭ কিলোমিটার৷ এ জন্য সর্বোচ্চ ১০০ ওয়াট সম্প্রচার শক্তির ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা যাবে৷ তথ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কারিগরি উপ-কমিটি ও জাতীয় রেগুলেটরি কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অবস্থান বা অসমতল ভৌগোলিক অবস্থার ক্ষেত্রে ট্রান্সমিটারের ক্ষমতা ১০০ ওয়াট থেকে বাড়িয়ে ২৫০ ওয়াট পর্যন্ত করা যেতে পারে; এন্টিনা টাওয়ারের উচ্চতা হবে ভূমি থেকে সর্বোচ্চ ৩২ মিটার৷ তবে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনবসতিপূর্ণ এলাকা যেমন-চরাঞ্চল, পাহাড়ী এলাকাতে কাঙিক্ষত কাভারেজ পাওয়ার জন্য উল্লিখিত উচ্চতার তারতম্য হতে পারে৷ সব ক্ষেত্রে এন্টিনা গেইন অবশ্যই ৬ ডিবি-র মধ্যে সীমিত রাখতে হবে; এফএম ব্যান্ডে ন্যাশনাল ফ্রিকোয়েন্সি অ্যালোকেশন প্ল্যান অনুযায়ী কমিউনিটি রেডিও স্টেশন পরিচালনার জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে ফ্রিকোয়েন্সি দেয়া হবে৷
অন্যান্য নির্দেশাবলী
শুধু অলাভজনক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নিচে উল্লিখিত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে; লাইসেন্স পাওয়া প্রতিটি স্টেশনের জন্য একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে৷ স্টেশন পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনায় উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে৷ প্রতিটি স্টেশনে স্থানীয় প্রশাসন, যেমন-উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (যেখানেস্টেশনটিজেলা শহরে অবস্থতি), অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সমমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা, জাতি গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত বিভাগসমূহ যেমন-কৃষি, মত্স্য, পশুসম্পদ, বন ও পরিবেশ, আবহাওয়া অধিদফতর, স্বাস্থ্য, বাংলাদেশ বেতারের স্থানীয় স্টেশনের প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি করে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে হবে; অনুমতি বা লাইসেন্স পাওয়া স্টেশন ব্যবস্থাপনা ও অনুষ্ঠানে সমতা ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখতে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা ও লিঙ্গ বিবেচনাসাপেক্ষে জনগোষ্ঠীকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিবে; অনুমতি বা লাইসেন্স পাওয়া স্টেশন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কমিউনিটির লোকদের দক্ষতা বাড়ানো নিশ্চিত করবে; অনুমোদনের বিধি ও শর্ত মেনে চললে এবং কোনো বিধি ভঙ্গ না করলে, সব সম্পাদন শেষে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্বোল্লিখিত সময়সীমার মতো অনুমোদনের সময়সীমা গ্রহীতা সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে নবায়ন করা যাবে; লাইসেন্স স্বত্ব হস্তান্তর করা যাবে না৷ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কোনো সাংগঠনিক পরিবর্তন হলে, তা তাত্ক্ষণিক লিখিতভাবে সরকারকে জানাতে হবে৷ কমিউনিটি রেডিও স্থাপন বিষয়ে পরামর্শ কেন্দ্র চালু করেছে বিএনএনআরসি
দেশের গ্রামীণ ও উপকূলীয় অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে কমিউনিটি রেডিও স্থাপনে আগ্রহী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে পরামর্শ ও সহায়তা দিতে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি) রাজধানীতে একটি পরামর্শ কেন্দ্র চালু করেছে৷ এর মাধ্যমে কমিউনিটি রেডিও সংক্রান্ত নীতিমালা, কর্মসূচী ও কারিগরি সহায়তা দেয়া হবে৷
বিএনএনআরসি পরামর্শ কেন্দ্র থেকে নীতিমালার বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণ, আবেদনপত্র সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি, প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা, গবেষণা, তথ্য উপাত্ত, সাময়িকী ও প্রকাশনা, রেডিও স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনায় অর্থনৈতিক ও কারিগরি পরিকল্পনা, রেডিও প্যাকেজ তৈরি ও সম্পাদনা এবং সম্প্রচার প্রযুক্তি সংক্রান্ত নির্দেশিকা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে৷ যোগাযোগ : ০১৭১১৮৮১৬৪৭
ফিডব্যাক : mharnad@yahoo.com