নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল এলাকার আখচাষীরা ই-তথ্যসেবা পেতে শুরু করেছেন। আখচাষীদের জন্য ই-তথ্যসেবা নিশ্চিত করতে সেখানে ইলেকট্রনিক পূর্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বসানো হয়েছে। উল্লেখ্য, কখন কোন আখচাষী চিনিকলে আখ সরবরাহ করবেন, তা ব্যবস্থাপনার নাম পূর্জি ব্যবস্থাপনা। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ থেকে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের উদ্যোগে এ সিস্টেম কাজ শুরু করেছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবস্থিত অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
ইলেকট্রনিক পূর্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে আখচাষীরা একাধিক ই-তথ্যসেবা পাচ্ছেন। ই-পূর্জি ইস্যুর মধ্যে অন্যতম পূর্জি হলো কবে কোন কৃষক কী পরিমাণ আখ মিলে সরবরাহ করবেন, তার একটি বৈধ ডকুমেন্ট। মিল কর্তৃপক্ষ আখচাষীদের এ ডকুমেন্ট সরবরাহ করে মিল মাঠকর্মীদের (সিডিএ) ও ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তায় তৈরি করা গেজেটের ওপর ভিত্তি করে। এ গেজেট চূড়ান্ত হবার পর মিল কর্তৃপক্ষ পূর্জি মাঠকর্মীদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আখচাষীর বরাবরে পাঠায়। সাধারণত তা আখচাষীর হাতে পৌঁছতে এক থেকে তিন দিন সময় লেগে যায়। কখনো কখনো তা হারিয়েও যায়। এমনও হয়, আখচাষী এ ডকুমেন্ট পেয়েছেন তার আখ সরবরাহ করার নির্ধারিত তারিখের পর। তখন চাইলেও ওই আখচাষী তার আখ সরবরাহ করতে পারেন না পরবর্তী সরবরাহের তারিখ না আসা পর্যন্ত। ই-পূর্জি এ সনাতনী পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছে। ইলেকট্রনিক পূর্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এসএমএসের মাধ্যমে মুহূর্তেই আখচাষীকে জানিয়ে দিতে পারছে তার আখ সরবরাহ করার সুনির্দিষ্ট দিনের খবর।
ই-পূর্জির বাইরে আরো তিনটি ই-তথ্যসেবা আখচাষীরা পাচ্ছেন। প্রথমটি হলো অ্যালার্ট মেসেজ। অর্থাৎ, মিল হঠাৎ করে ব্রেকডাউন হলে, তা এসএমএসের মাধ্যমে আখচাষীরা জানতে পারছেন। এর ফলে কৃষক আখ কাটা থেকে বিরত থাকতে পারেন। প্রচলিত পদ্ধতি হলো, ব্রেকডাউন হলে মিল কর্তৃপক্ষ তা মাইকিং করে আখচাষীদের সতর্ক করে দেয়। কিন্তু অনেক কৃষক এ খবর পান না, ফলে কৃষক তার আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আখ কেটে ফেলেন। এতে করে তিনি লোকসানের মুখোমুখি হন।
দ্বিতীয়টি হলো অ্যাওয়ারনেস মেসেজ। অর্থাৎ, আখ মাড়াই মৌসুমের বাইরে (তিন মাস), আখ চাষ মৌসুমে (নয় মাস) আখচাষী এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পারবেন আখ উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য। এর মধ্যে অন্যতম হলো, কবে থেকে মিল কর্তৃপক্ষ সার, কীটনাশক সরবরাহ শুরু করবে, কখন ও কিভাবে সার-কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে, কবে মিল কর্তৃপক্ষ ঋণ কার্যক্রম শুরু করবে, আখের রোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন সতর্কতামূলক তথ্য প্রভৃতি।
তৃতীয়টি হলো, আখচাষীর অভিযোগ জানাবার সুযোগ। আখচাষীর যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তা এসএমএসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারবেন। কৃষকরা জানান, অভিযোগ কমবেশি তারা বিভিন্ন সময়ে করেছেন, কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। তাদের এ অভিযোগ সুগার করপোরেশনের বড় কর্মকর্তা তো দূরের কথা, মিল কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা পর্যন্তই পৌঁছায়নি। আশা করা হচ্ছে, ইলেকট্রনিক পূর্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তাদের এসব অভিযোগ আগামী দিনে নীতিনির্ধারক কর্মকর্তা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।
ইলেকট্রনিক পূর্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে যেসব সেবা পাওয়া যাচ্ছে, তা কতখানি কার্যকর এবং একে আরো বেশি ফলদায়ক করতে হলে কোথায় কী পরিবর্তন আনা দরকার- এ বিষয়ে মিল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, মিল মাঠকর্মী, সুগার করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এবং আখচাষীদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা হয়। আখচাষীদের মধ্যে ধনী ও প্রান্তিক চাষীদের নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়। এর ফলে সময় বাঁচবে, ঘটবে অর্থ সাশ্রয়। ধনী চাষীরা বলেছেন, এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের একটি সনাতনী পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করেছে। মাঠকর্মীরা সমালোচনা করেন যে, এ ব্যবস্থায় আখচাষীরা তাদের সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ করবেন, এর ফলে চাষীদের সাথে তাদের সুসম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তাছাড়া, এসএমএস ইংরেজিতে হওয়ায় প্রান্তিক চাষীরা এসবের কিছুই বুঝবেন না। সমালোচকরা প্রশ্ন করেন, প্রান্তিক কতজন চাষীর কাছে মোবাইল ফোন আছে যে তারা এসএমএসের খবর জানতে পারবেন? কিন্তু খোলামেলা আলোচনার মধ্যেই এ প্রশ্ন ও সমালোচনার উত্তর মেলে। প্রান্তিক চাষীরা উল্টো মিল মাঠকর্মীদের সমালোচনা করে বলতে শুরু করেন, মোবাইল না থাকাটা কোনো সমস্যা নয়, আমরা পাশের বাড়ির কারো না কারো মোবাইলের মাধ্যমে খবর জানতে পারব।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো এসব খোলামেলা আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ এমন সব সুপারিশ, যা ইলেকট্রনিক পূর্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে টেকসই করার ক্ষেত্রে জরুরি। প্রধান সুপারিশগুলো হলো- ইলেকট্রনিক পূর্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কেবল ই-পূর্জি ইস্যু, অ্যালার্ট মেসেজ, অ্যাওয়ারনেস মেসেজ দেয়া এবং অভিযোগ জানানোর সুযোগ থাকাই যথেষ্ট নয়, একে হয়ে উঠতে হবে আখচাষীদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে। যাতে করে এই মাধ্যম আখচাষীদের জন্য একটি ‘পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি চ্যানেল’ হয়ে ওঠে। এই সুপারিশের সূত্র ধরে মতামত বেরিয়ে আসে আখ চাষ মৌসুমে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা জরুরি, এতে প্রান্তিক আখ চাষীরা বেশি লাভবান হবে। সিডিএরা মতামত দেন, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে বড় পর্দায় যদি আখচাষ উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়, এতে একদিকে যেমন আখচাষীরা তথ্যসচেতন হবে, অন্যদিকে তারা বেশি আখ চাষে আগ্রহী হবেন।
ই-পূর্জি ইস্যু করা হচ্ছে
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে বর্তমান ব্যবস্থায় ই-পূর্জি ইস্যু, অ্যালার্ট মেসেজ, অ্যাওয়ারনেস মেসেজের জন্য যে ব্যয় হবে এ অর্থ আসবে কোথা থেকে? এ ব্যাপারে সুগার করপোরেশন কর্তৃপক্ষ একাধিক বিকল্প বিবেচনা করছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- এ অর্থ আসবে সুগার করপোরেশনের থোক বরাদ্দ থেকে। সেক্ষত্রে প্রশ্ন ওঠে, যখন দেশের সব মিলে এ পদ্ধতি চালু হবে তখন কি এই থোক বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে তাদের জন্য? দ্বিতীয়টি হলো- এই অর্থ অন্য কোনো উৎস তথা দাতা সংস্থা থেকে খুঁজে বের করা। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, তারা কি বছরের পর বছর ধরে এ অর্থ যোগান দিতে রাজি হবে? ঠিক এ প্রেক্ষাপটেই তৃতীয় মতটি আসে, তা হলো- এ অর্থ আখচাষীদের কাছ থেকেও আসতে হবে। অবশ্যই তা আংশিক। সুগার করপোরেশন জানায়, আখচাষীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ঘটবে এমনভাবে যে, তারা টেরই পাবে না।
আখচাষীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত আসে অভিযোগ জানানোর জন্য যে এসএমএস করতে হবে এবং এর জন্য যে খরচ হবে তা আখচাষীরা বহন করবেন কি-না? এ বিষয়ে প্রান্তিক আখচাষীরা জানান, আমাদের অভিযোগ আমরা বহু চেষ্টা করেও মিলের এমডি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। বর্তমান এ পদ্ধতিতে আমরা এসএমএস করে শুধু মিলের এমডি নয়, সুগার করপোরেশনের চেয়ারম্যানের কাছে পর্যন্ত অভিযোগ পৌঁছাতে পারব। এভাবে একজন-দুইজন করে শত শত, হাজার হাজার আখচাষী যখন বলতে শুরু করবেন এবং বার বার যখন অভিযোগ জানাতে থাকবেন, তখন তা আর কেউই এড়াতে পারবেন না। এর জন্য যদি বছরে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা ব্যয় করতে হয় করব। এটা তো আমাদের আখ চাষের উন্নয়নের জন্যই ব্যয় হবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : manikswapan@yahoo.com