শহিদুল ইসলামের মতোই এখন দেশের লাখ লাখ আখচাষীর মুখেই হাসি ফুটতে শুরু করেছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী ১২ নভেম্বর ২০১০ দেশের সব চিনিকলের জন্য ই-পুর্জি উদ্বোধন করে সেই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেন। তিনি বলেন- আমি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার কাজ সম্পন্ন করেছে। এটি একটি আনন্দ সংবাদ হচ্ছে, দেশের প্রায় আড়াই লাখ আখচাষী চিনিকলে আখ সরবরাহের ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতির সুবিধা নিতে পারছে। এই পদ্ধতিতে এসএমএসের মাধ্যমে চাষীদের আখ বিক্রয়ের অনুমতিপত্র বা পুর্জি দেয়ার তথ্য দিচ্ছে। এর ফলে মিলে আখ বিক্রয়ে বহুলশ্রুত অভিযোগ ও অনিয়মের দিন শেষ হয়েছে। অতীতে যে কাজে প্রয়োজন হতো কয়েক দিন, এখন তা সম্পন্ন হচ্ছে কয়েক সেকেন্ডে। আমি অবগত হয়েছি, আখচাষীরা এখন মিলের ক্রয়কেন্দ্রগুলোতে আখ বিক্রির বার্তাই শুধু এসএমএসের মাধ্যমে পাচ্ছেন না, আখের মূল্য পরিশোধের খবর, সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং বিভিন্ন পরিচর্যা ও সেবার খবরও তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাচ্ছেন।
সনাতনী পুর্জি ও ই-পুর্জি
সনাতন পুর্জি ব্যবস্থাপনায় চিনিকলের তালিকাভুক্ত আখচাষীর আখ মাড়াইয়ের সময় চিনিকল থেকে কাগজে লেখা পুর্জি দেয়া হতো। এই কাগজে তিনদিনের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আখ সরবরাহ করার কথা বলা হয়। প্রতি পুর্জিতে সাধারণত ১২০০ কেজি থেকে ১৪০০ কেজি আখ সরবরাহ করা যায়। পুর্জিতে আখচাষীর নাম, ঠিকানা, পাসবই নম্বর, ইউনিট ও সেন্টারের নাম, আখ সরবরাহের তারিখ ও পরিমাণ উল্লেখ থাকে। স্বাধীনতাপূর্ব থেকে এ পদ্ধতিতে চাষীদের পুর্জি দেয়া হয়ে আসছে। পুর্জি বিতরণের জন্য নির্দিষ্ট লোকবল না থাকায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ চিনিকলের বিভিন্ন সেন্টার, চাষীদের প্রতিবেশী, অন্য চাষীর মাধ্যমে চাষীর কাছে পুর্জি পাঠাতো। এ প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চাষীর হাতে যথাসময়ে পুর্জি পৌঁছত না। আখচাষীরা জানান, ‘হয়ত আমার কোনো চাষীভাই কেন্দ্রে গেছেন, সিআইসি (সেন্টার ইনচার্জ) তাকে আমার পুর্জিটা আমার কাছে পৌঁছে দিতে বললেন। যিনি আমাকে পুর্জি দেবেন তিনি হয়ত কাগজটা হারিয়ে ফেললেন, ভুলে গেলেন বা যেদিন আখ জমা দেয়ার শেষ দিন সেদিন আমি পুর্জিটা হাতে পেলাম। তখন তো আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা।’
ই-পুর্জি এই সনাতনী চিত্র পাল্টে দিয়েছে। সব হয়রানি থেকে আখচাষীরা মুক্তি পাচ্ছে। কারণ, ই-পুর্জি একটি স্বচ্ছ, দ্রুতগতিসম্পন্ন প্রক্রিয়া। মিল থেকে ই-পুর্জি ইস্যু হওয়া মাত্র চিনিকলের সফটওয়্যারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে তা এসএমএস আকারে চাষীর মোবাইলে দৃশ্যমান হয়। অর্থাৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আখচাষীদের কাছে পুর্জি তথ্য পাঠানোই হলো ই-পুর্জি। সনাতন পুর্জির মতো ই-পুর্জিতেও আখচাষীর নাম, ঠিকানা, পাসবই নম্বর, ইউনিট ও সেন্টারের নাম, আখ সরবরাহের তারিখ ও পরিমাণ উল্লেখ থাকে। তবে এখানে হাতে লেখা চিরকুটের পরিবর্তে চিনিকলের সার্ভার থেকে আখচাষীদের মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে পুর্জি পাঠানো হয়। পূর্বে পুর্জির কাগজ পেতে আখচাষীদের দুয়েক দিন দেরি হতো। ক্ষেত্রবিশেষে আখ সরবরাহের নির্ধারিত দিনের পরে আখচাষীর হাতে পুর্জির কাগজ আসতো। বর্তমানে পুর্জি ইস্যু হওয়ার সাথে সাথে চাষীর মোবাইলে পুর্জির তথ্য পাঠানো হচ্ছে। তাছাড়া এসএমএসের মাধ্যমে চাষীদের আখের মূল্য পরিশোধসংক্রান্ত তথ্যও দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
সনাতনী পুর্জি ও ই-পুর্জি ব্যবস্থাপনা তুলনা করলে দেখা যায়- সনাতনী পুর্জিতে চাষীদের কাছে পুর্জি পৌঁছাতে দেরী হতো, অনেক সময় চাষীর সাক্ষাত না পেলে তার কাছে পুর্জি পৌঁছানো সম্ভবই হতো না, তিন দিনের মধ্যে পুর্জি না পেলে চাষী চিনিকলে আখ সরবরাহ করতে পারতেন না, বিপুলসংখ্যক চাষীর কাছে পুর্জি বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল, সময় ও অর্থের প্রয়োজন হয়, যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে আখ মাড়াই বন্ধ থাকলে আখ সরবরাহ থেকে সাময়িক বিরত থাকার জন্য চাষীদের তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করা সম্ভব হতো না, আখ বিক্রির অর্থ পেতে চাষীদের অনেক হয়রানি ও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হতো। অন্যদিকে এখন মোবাইলের মাধ্যমে এসএমএস করে তাৎক্ষণিকভাবে চাষীদের কাছে পুর্জি পাওয়া নিশ্চিত করা ছাড়াও চাষীদের সেচ, সার, কীটনাশক, ঋণ ও আখের দাম পরিশোধসংক্রান্ত তথ্যও প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে, আখ কাটা ও মিলে সরবরাহ করার জন্য চাষী যথেষ্ট সময় পাচ্ছে, ফলে চাষীর সময় বাঁচার পাশাপাশি হয়রানিও কমেছে, পুর্জি পাওয়া নিয়ে চাষীদের কোনো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
ই-পুর্জির সাফল্য ও স্বীকৃতি
ই-পুর্জির পাইলট উদ্যোগটি সফলতার সাথে বাস্তবায়নের জন্য ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা-২০১০-এ ই-সেবা ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। ই-উদ্যোগ ও জীবিকা ক্যাটাগরিতে প্রথম জাতীয় ‘ই-কনটেন্ট ও উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি পুরস্কার-২০১০’ লাভ করেছে। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডি-নেট এ পুরস্কার দেয়। এছাড়া ই-পুর্জি ব্যবস্থাপনা ভারতের মন্থন পুরস্কার-২০১০-এর ই-কৃষি ও জীবিকা ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছে। তবে সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হচ্ছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা দেড় লাখ আখচাষীর কাছ থেকে। যারা ই-পুর্জির এসএমএসকে বলছেন দিন বদলের এসএমএস।
টেকসই ই-পুর্জি
ই-পূর্জি স্থায়ী বা টেকসই হবে দুটি কারনে। এক. বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন এই সেবাকে নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করছে এবং তারা উপলব্ধি করেছে এই সেবার মধ্য দিয়ে ব্যাপকসংখ্যক আখচাষী উপকৃত হবেন। তার চেয়েও বড় কথা এই সেবার মাধ্যমে চিনিকলে আখ উৎপাদন বাড়বে, ফলে আয় বাড়বে এবং কমবে অব্যবস্থাপনা। দুই. আখচাষীরা এই সেবাকে গ্রহণ করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
চ্যালেঞ্জ ছিল একাধিক। শুরুতে মিল কর্তৃপক্ষ বলেছিল, এমন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এখানে বেমানান। তারা যুক্তি হাজির করেছিল- সব আখচাষীর কাছে মোবাইল নেই, থাকলেও তারা এই এসএমএস পড়তে পারবেন না। কারণ তারা নিরক্ষর। তার ওপর ইংরেজিতে লেখা এসএমএস বোঝার সাধ্য তাদের নেই। মাঠকর্মীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেছিল এই বলে, আখচাষীর সাথে তাদের দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। ট্রেড ইউনিয়ন বলেছিল, অনেকের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এসব তথ্যপ্রযুক্তি চলবে না। সমালোচনা করে বলেছিল, এসব উদ্যোগ মোবাইল কোম্পনিগুলোর আয় বাড়ানো ছাড়া নতুন কোনো ফল বয়ে আনবে না।
কিন্তু কয়েক মাসের মাথায় তাদের সবার ধারণা পাল্টে গেল। আখচাষীরা তাদের অভিজ্ঞতায় বলেছেন, এসএমএস ইংরেজি, এতে কোনো সমস্যাই হয়নি তাদের। কারণ এ সমস্যা তারা সমাধান করেছেন তাদের সন্তান বা পড়শীদের মাধ্যমে।
ই-পুর্জি চালু করার আগে এ মৌসুমে ১৩টি চিনিকলের প্রতিটিতে একটি করে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। উল্লেখ্য, ১৫টি চিনিকলের ৩০০০ সদস্যকে ১৫০০টি টিমে ভাগ করে এটুআই প্রোগ্রাম এবং খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন যৌথভাবে এ প্রশিক্ষণ প্রদান করে। পরে এ ১৫০০টি টিম সারাদেশের দেড় লাখ আখচাষীকে গ্রুপ মিটিংয়ের মাধ্যমে ই-পুর্জি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : manikswapna@yahoo.com