লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
প্রযুক্তি বিপ্লব
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি বিপ্লব
তথ্যমহাযুগের কয়েকটি সত্য
মানবসভ্যতায় তথ্যমহাযুগ যে চলছে, তথ্যের শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধিও নতুন নয়৷ কিন্তু বিষয়টাকে বাগে আনতে লেগে গেছে কয়েক হাজার বছর৷ একে এক পরম পাওয়া বললেও অত্যুক্তি হয় না৷ অথচ এই পাওয়াকে সবাই ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারছে-না৷
আসলে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগালে যে সুফল দেশ-জাতি পায় সেগুলো আমরা পাচ্ছি না৷ মূল বিষয় হচ্ছে মেধা শক্তির সমন্বয় করা৷ একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যেসব দেশ এখন শক্তিশালী অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তারা এই মেধার সমন্বয় করতে পেরেছে৷ আগে থেকে যারা উন্নত তারা আগেই অন্য উপায়ে মেধার সমন্বয় করেছে৷ উন্নত পশ্চিমা শক্তির কথা বাদ দিলেও নতুন যে দেশগুলো শক্ত অর্থনীতির ভিত গড়ে তুলেছে তাদের উদাহরণ টানলেই ভালোভাবে বোঝা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি সাহায্যে তাদের মেধা সমন্বয়ের মাধ্যমেই সাফল্যের দিকে এগিয়েছে৷ অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য৷ আর এগুলো প্রধানত কৌশল ও উদ্ভাবননির্ভর৷ অনেকে মনে করেন শিল্পে উদ্ভাবন লাগে, কৃষিতে লাগে না৷ কিন্তু বাজারের কৃষিপণ্যের দিকে তাকালেই বোঝা যায় অনেক পণ্য আগের মতো নেই৷ তরিতরকারি, শাকসবজি, মাছ-মাংসও আর আগের মতো নেই৷ একই পণ্য নতুন আকার-আকৃতি নিয়ে বাজারের শোভাবর্ধন করছে৷ চালের নতুন নতুন নাম আসছে, আলুর চেহারা বদলে গেছে, নতুন নতুন মাছ আসছে, যেসব পশুর মাংস খাওয়া হয় সেসব পশুরও পরিবর্তন ঘটছে৷ এগুলো তো উদ্ভাবনের মাধ্যমেই হয়েছে৷
এমন মনে করার কারণ সেই যে এমনি এমনি এই উদ্ভাবন ও কৌশল বদলের কাজগুলো হয়ে যাচ্ছে৷ আসলে তো মানুষই করছে এগুলো৷ লক্ষ করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, এখন আগের চেয়ে অনেক দ্রুত হচ্ছে পরিবর্তনগুলো৷ আগে যেখানে একটা উত্পাদন ব্যবস্থা বা বাণিজ্যিক নীতি ২০-৩০ বছর ধরে চলত এখন সেখানে ২-৩ বছর পর পরই বদলে যাচ্ছে পরিস্থিতি৷ এই অদলবদলটা করছে কিন্তু মেধাবীরা৷ আর মেধাবীদের জন্য সবচেয়ে সহজ ও সঠিক কাজের মাধ্যম হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি৷ মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মেধাবীদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা তা এখন দুর্মর হয়ে উঠেছে৷ এর কারণও তথ্যপ্রযুক্তি৷ আরো একট বিষয় লক্ষণীয়, মেধার প্রয়োজন এখন বেশি৷ কারণ মেধাবীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও কৌশল চালাতেও মেধাবীদের প্রয়োজন হচ্ছে অভাবিতমাত্রায়৷ যেসব দেশ-জাতি-সমাজ বেশিমাত্রায় মেধাবীদের সম্মিলন ঘটাতে পেরেছে বা পারছে তারাই এগিয়ে চলেছে৷ অনেক মেধাকে মেলাতে পারার কৃতিত্বই এখন জাতীয় সাফল্যের পরিচায়ক৷ এই মেধার সম্মিলন প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে মানচিত্রের রাজনৈতিক সীমারেখা অতিক্রম করেছে৷
তথ্যমহাযুগের প্রধান এ সত্যটাতে আমার বিস্মৃত হয়েছিলাম বলেই পিছিয়ে পড়েছি- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়৷ অন্যান্য এগিয়ে চলা দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পরিচালনামূলক কোন কাজেই মেধাহীনদের কোনো স্থান নেই৷ মধ্যম মানের মেধাবীরা চেষ্টা করে মেধাবীদের যোগ্যতর কাজে নিয়োজিত করতে কিন্তু সেই চেষ্টাটাই আমরা করিনি৷ আমাদের রাজনীতি থেকে নিয়ে দেশ পরিচালনা, শিল্প-বাণিজ্য, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিম-লেও এতমাত্রায় মেধাহীনের দোর্দা- প্রতাপ চলেছে এবং চলছে, মেধাবীরা দেবার জন্য কিছু করতে তো পারেইনি নিজেদের ক্ষেত্রেও তারা কাজের সুযোগ পায়নি৷ মাঝে মাঝে এদেশী মেধাবীদের খবর পাওয়া যায় বিদেশ থেকে৷ তাতে আমরা উত্তেজিত হই, কিন্তু তাও সাময়িকভাবে৷ সে উত্তেজনায় রেশ ধরে অন্য মেধাবীদের শনাক্ত করা কিংবা কাজে লাগানোর চেষ্টা না করে সরকার, না করে কোন বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান৷ এই কমপিউটার জগৎেসহ কয়েকটি পত্রিকা মাঝে মাঝে যেসব ট্যালেন্ট হান্টের উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোকে মডেল করেও এগিয়ে আসেনি শক্তসমর্থ তেমন কেউ৷
আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে একটা ভীতি আছে প্রথম থেকেই এবং সেই ভীতি কমার বদলে বেড়ে গেছে৷ তথ্যপ্রযুক্তির কথা বললেই অনেকে মনে করেন কমপিউটার ও বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষা নেয়ার কথা৷ কিন্তু আসলে যে কমপিউটার ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহারিক মূল শিক্ষাই জরুরি তা অনেকে মানেন না৷ শিক্ষাবিদ, সরকারি নীতিনির্ধারক, সাধারণ অভিভাবক মহলে এই না মানা লোরে সংখ্যাবৃদ্ধি অস্বাভাবিক৷ এর কারণ অসুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে সম্ভাবনাময় কিছু না দেখতে পাওয়া এবং দেশের শিল্প-বাণিজ্যের নেতিবাচক প্রবণতা৷ মূল ধারার কর্মসংস্কৃতিতে তথ্যপ্রযুক্তির আবশ্যিকতা স্বীকার না করা এবং সরকারি কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযাগপ্রযুক্তি ব্যবহার না করা থেকেই এই নেতিবাচক প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে৷ অনেকে যুক্তি দেখান, সব দেশে তো সরকার এসবের নিয়ামক নয়৷ কথাটা সত্যি সন্দেহ নেই, তবে যে দেশে সরকার অত্যাধুনিক টেলিযোগাযোগ খাত থেকে নিয়ে চাল-ডাল আলু-পটলের ব্যবসায় পর্যন্ত করে এবং গোপনীয়তা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র চালায় সেখানে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া আইসিটিনির্ভর কর্মসংস্কৃতি গড়ে উঠবে, এমন আশা করাটা বাতুলতা মাত্র৷
সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, সংস্কার বা সংশোধনের মাধ্যমে সমাজ খোলা না হয়ে রক্ষণশীলতার দিকে চলে যাচ্ছে৷ সরকার না চাইলেও সরকারকেই মূল বাজার ব্যবস্থায় হাত দিতে হচ্ছে- বেসরকারি ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় সরকারকেই নিতে হচ্ছে৷ কাজেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সরকার ছাড়া আইসিটি খাতের প্রসার একরকম অসম্ভব৷ ধরা যাক, বেসরকারি উদ্যোগে কোনো একটি উপজেলার একটি স্কুল আইসিটির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের কর্মসূচী নিলো, কিন্তু দেখা যাবে ইন্টারনেট সংযোগ, তথ্যের যোগান ইত্যাদির জন্য সরকারের ওপরই নির্ভর করতে হবে৷ অনেকে উপনিবেশবাদী ধারায় তথ্যসংক্রান্ত বিষয়াবলী সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখাকে এর জন্য দায়ী করেন৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বেসরকারি খাত খুব একটা উদ্যমী মনোভাবের পরিচয় এখন পর্যন্ত দেয়নি৷ ফলে সরকারের হাতেই রয়ে গেছে সবকিছু এবং আরো বিচিত্র হচ্ছে সরকারও জানে না কী করতে হবে? মূলত নিয়ন্ত্রণ কতটা শিথিল করলে তা অনিয়ম দূর্নীতির প্রকোপ এনিয়ে সত্যিকার উন্নয়ন ঘটাতে পারবে সেই সূত্রটাও সংশ্লিষ্ট কেউ জানেন না৷ আসলে সরকারকে সবজান্তা ভাবারও কোনো কারণ নেই৷ কেননা সরকার তো সেই ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত হয়, যারা আমাদের সমাজের সবরকম প্রবণতায় আক্রান্ত৷ মেধাহীনতা-উদ্যোগহীনতা বিশেষ করে অপার ক্ষমতা নিয়ে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারার দৈন্য সবসময়ই সব সরকারের মধ্যে দেখা গেছে৷ নেতিবাচক প্রবণতাও ছিল৷ সুযোগ ও সাধ্য থাকা সত্ত্বেও ই-গভর্নমেন্ট যে হয়নি, তা দেখাই যাচ্ছে৷ মেধাকে ভয় পাওয়ার একটা নেতিবাচক প্রবণতাও সব সময় রাজনীতিবিদ এবং সরকার পরিচালনাকারীদের মধ্যে দেখা গেছে৷ জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাকে ভয় পাওয়া থেকেই মূলত এই প্রবণতা৷ জাতীয় উন্নয়ন এবং দেশপ্রেমের বিষয়টাই পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে৷ তৃণমূর পর্যায় পর্যন্তও আইসিটির প্রসার এবং তার সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া আর সাথে সাথে তাদের মেধা ও মননের সেবা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করার কাজটাও হয়নি৷
তবে এখন সম্ভবত এই বিষয়গুলো উপলব্ধি কর সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে৷ বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তার সাথে শামিল হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে৷ বিশেষ করে মেধাবীদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে লাগানো আর অন্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় নামাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে৷ মূল কথা হচ্ছে তথ্যমহাযুগের সত্য অনুধাবন এবং সংগ্রামশীলতার শক্তি অর্জন৷