প্রসেসর রক্ষায় পানি, কথাটি কমপিউটারপ্রেমীদের একটু বিচলিত করবে। কিন্তু বাস্তবতা এই, প্রসেসর রক্ষায় পানির ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে।
কয়েক বছর আগেও কমপিউটারের প্রসেসর অতিরিক্ত গরম হওয়ার ফলে নষ্ট হতো। এর একটি বড় কারণ ছিল প্রসেসরের ফ্যান নষ্ট হয়ে যাওয়া। আবার একটানা কাজ করার ফলে অনেক সময় প্রসেসর গরম হয়ে বারবার কমপিউটার হ্যাং করত। আবার অনেক সময় কমপিউটারে সঙ্কেত দিত, প্রসেসর অতিরিক্ত গরম হলে। পেন্টিয়াম ২, ৩ প্রসেসর সিরিজে এ সমস্যা বিদ্যমান ছিল। যদিও এখনকার কোর আই কিংবা এমএমডির ফেনম সিরিজের কিছু কিছু প্রযুক্তির প্রসেসরে কাজের বেশি চাপ পড়লে একই সাথে প্রসেসর বেশি গরম হলে কাজের গতি কমিয়ে প্রসেসরের তাপমাত্রা ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়। তথাপি অতিরিক্ত তাপ উৎপন্নের ফলে প্রসেসরের ভেতরের ট্রানজিস্টরগুলোর কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। অন্যদিকে কাজের গতি কমিয়ে আনায় প্রসেসরের কাজ শেষ করতে সময় লেগে যায় বেশি।
এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে বহুল প্রচলিত কোর আই, ফেনমের মতো প্রসেসরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে বজায় রাখার জন্য মাদারবোর্ড থেকেও বড় হিটসিঙ্ক দরকার হয়। কিন্তু প্রসেসর ও মাদারবোর্ড নির্মাতা কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য যেখানে আকার আরো কমিয়ে আনা, সেখানে এত বড় আকারের হিটসিঙ্ক কীভাবে থাকবে। অন্যদিকে আবার বাড়লেও তো খুব কার্যকর হয় না। কারণ প্রসেসরের জন্য দরকার খুব দ্রুত তাপ শোষণ করে এমন শোষণকারী বস্ত্ত। আবার প্রসেসর ছাড়াও মাদারবোর্ডের বড় বড় আইপি কিংবা গ্রাফিক্সকার্ডের ব্যাপারও একই রকম। প্রসেসরের তাপমাত্রা নিয়ে ১৯৯২ সাল থেকে চলমান এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯২ সালে প্রসেসরগুলোতে প্রতি বর্গ সেমি জায়গায় যেখানে ৭ ওয়াট উৎপন্ন করার মতো ট্রানজিস্টর ছিল। ২০০২ সালে সেখানে প্রতি বর্গ সেমিতে দাঁড়ায় ৭০ ওয়াট এবং ২০১১ সালে ব্যবহার হচ্ছে ১৮০ ওয়াট/সেমি২। ফলে বেশি ঘনত্বে অতিরিক্ত ট্রানজিস্টর থাকায় প্রতি বর্গ সেমি জায়গায় তাপও সমানুপাতে বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী হিটসিঙ্কে তেমন পরিবর্তন হয়নি। এ তাপ উৎপাদন ভবিষ্যতে আরো বাড়বে অবধারিত। আর হিটসিঙ্ক যত বড়ই হোক না কেন, এমন কোনো উপাদান নেই যা প্রতি বর্গ সেমি থেকে খুব দ্রুততার সাথে এত পরিমাণ তাপ শোষণ করবে। অন্যদিকে বড় বড় সার্ভারের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরো প্রকট।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য হাইড্রো সিস্টেম, এএমডি, ইন্টেলের মতো ৭টি বড় কোম্পানি যৌথভাবে ২০০৬ সাল থেকে কাজ শুরু করে। দীর্ঘ পাঁচ বছর গবেষণার পর প্রবহমান পানি দিয়ে প্রসেসর ঠান্ডা করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। পানি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় কারণ এর সহজলভ্যতা এবং তাপ ধারণ ক্ষমতা।
প্রসেসর অতিরিক্ত গরম হওয়ার ফলে প্রধানত তিন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। এ তিন ধরনের সমস্যাই (ওয়ার বন্ড ফেইলিওর, ডাই ফ্র্যাকচার, ডাটা এরর) প্রসেসরের ভেতর তৈরি হয়, যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম। যার কারণে বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই বাইরে থেকে বুঝতে পারে না।
এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এয়ারকুলার পদ্ধতিতে (যেখানে হিটসিঙ্কের ওপরে ফ্যান লাগানো থাকে) প্রসেসর থেকে যে পরিমাণ তাপ শোষিত হতো ওয়াটার কুলারে (পানি প্রবাহিত পদ্ধতি) তার দ্বিগুণ তাপ শোষিত হয়। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি করা ওয়াটার কুলার বাজারে আসা শুরু হয়েছে।
এবার আসা যাক, ওয়াটার কুলার কীভাবে কাজ করে। যাদের ডিজেল/পেট্রোল গাড়ির ইঞ্জিন সম্পর্কে ধারণা আছে তারা অনেকেই রেডিয়েটরের কাজ সম্পর্কে জানেন। রেডিয়েটরের ভেতর পানি থাকে এবং এ পানি ইঞ্জিনের তাপ শোষণ করে ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখে। ওয়াটার কুলারের মূল অংশ দুটি- রেডিয়েটর ও চিলার। চিত্রে দেখা যায় রেডিয়েটর থেকে প্রথম পাইপ দিয়ে ঠান্ডা পানি নিচের দিকে নেমে সিপিইউর ওপরের প্লেটে অবস্থান করে। এ পানি একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছলে চিলারের মাধ্যমে তা অন্য পাইপে রেডিয়েটরে উঠে আসে।
চিলারে এক ধরনের হাইড্রো সিস্টেম কাজ করে। যার মূল কাজ হলো পানির গতি তৈরি করা। রেডিয়েটরে অসংখ্য চিকন ও পাতলা পাইপ একটি অপরটির সাথে যুক্ত থাকে। এ পাইপগুলোর গায়ে পাতলা পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের হিটসিঙ্ক বসানো থাকে। ফলে গরম পানি যখন এ পাইপগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন এসব অ্যালুমিনিয়ামের হিটসিঙ্ক পানির তাপ শোষণ করে আসেত্ম আসেত্ম গরম হয়। রেডিয়েটরের ওপরে থাকা চলমান ফ্যান এ পাইপ ও হিটসিঙ্কগুলো ঠান্ডা করতে থাকে। এ হিটসিঙ্কগুলোর মাঝে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব থাকে, যার ভেতর দিয়ে বাতাস অনবরত চলাচল করে। দ্বিতীয় পাইপে সিপিইউর গরম পানি চিলারে উঠে আসে এবং চিলার তা রেডিয়েটরের বিভিন্ন পাইপে ছড়িয়ে দেয়। এ পানি রেডিয়েটরে এসে ঠান্ডা হতে থাকে। পুনরায় যখন সিপিইউর তাপ শোষণকারী পানি গরম হয় তখন এ পানি দ্বিতীয় পাইপের মাধ্যমে চিলার থেকে গতি নিয়ে রেডিয়েটরের ঠান্ডা পানিকে ধাক্কা দেয়। ফলে রেডিয়েটরে থাকা পানি প্রথম পাইপের মাধ্যমে সিপিইউর ওপরের প্লেটে জমা হয়। এ প্রক্রিয়া অনবরত চলতে থাকে। অনেক সময় চিলারের পরেও একটি ফ্যান থাকে, যা সরাসরি প্রসেসরের ওপরে পানিভর্তি যে প্লেট থাকে তাতে কাজ করে। সেক্ষেত্রে প্রসেসরের ওপরে থাকা পানিভর্তি ট্যাঙ্ক কিছুটা ঠান্ডা থাকে। এর একটি সুবিধা হলো পানি রেডিয়েটরে এসে ঠান্ডা হতে সময় কম লাগে।
ইতোমধ্যেই ওয়াটার কুলারের আরো একটি উন্নত সংস্করণ তৈরি হয়েছে। যেখানে যুক্ত হয়েছে থার্মো ইলেকট্রিক চিলার। এ নতুন ধরনের চিলার প্রসেসরের তাপমাত্রা সবসময় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার ভেতর রাখতে সক্ষম হয়। এ ধরনের ওয়াটার কুলারের জন্য দরকার মাত্র ১২ ভোল্ট ও ৫ ওয়াট বিদ্যুৎ। ফলে বিদ্যুতের দিক দিয়েও এটি সাশ্রয়ী।
ওয়াটার কুলার পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেক কোম্পানি রো সিস্টেম তৈরি করেছে। রো সিস্টেমে পুরো কমপিউটার সিস্টেমের জন্য ৩/৪টি ওয়াটার কুলার সিরিজে যুক্ত থাকে। যেখানে মাদারবোর্ডের চিপের জন্য একটি, গ্রাফিক্স কার্ডের জন্য একটি, প্রসেসর ও কেসিংয়ের জন্য দুটি কুলার ব্যবহার হয়। এ ধরনের রো সিস্টেম ব্যবহারকারীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। যদিও রো সিস্টেমের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। তথাপি এটি ব্যবহার করলে আপনার পুরো কমপিউটার নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : minitohid@yahoo.coma