লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
আর্মের ২০১৭ সালের প্রসেসর রোডম্যাপ প্রকৌশলী
এক সময় আমরা সিপিইউ বা প্রসেসর বলতে ইন্টেল বা এএমডির কথাই মনে করতাম। কয়েক বছর আগেও এদের দুর্দান্ত প্রতাপ ছিল। পিসি বা ল্যাপটপে এখনও তাদের রাজত্ব বজায় রয়েছে, তবে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটের ব্যাপক জনপ্রিয়তার মুখে তারা বেশ মস্নান হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। পিসি বা ল্যাপটপ যেখানে মিলিয়নের কোটায় রয়েছে, সেখানে স্মার্টফোনের পরিধি বিলিয়নে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটে ইন্টেল বা এএমডির প্রসেসর তেমন নেই বললেই চলে। এখানে রাজত্ব করছে আর্ম (অজগ) প্রসেসর। এক সময় ইন্টেল মরিয়া হয়ে উঠেছিল অ্যাটম প্রসেসরের মাধ্যমে স্মার্টফোন মার্কেট দখল করার জন্য, কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি। এদিকে পিসি বা ল্যাপটপে উইন্ডোজের (অ্যাপলের ক্ষক্ষত্রে ওএসএক্স বা ম্যাক ওএস) আধিপত্য থাকলেও স্মার্টফোনে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে গুগলের অ্যান্ড্রয়িড ও অ্যাপলের আইওএস। সম্প্রতি ইন্টেল অ্যাটম প্রসেসর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বলে জানা যায়। ফলে আর্ম প্রসেসরের অপ্রতিহত গতি আরও ক্ষক্ষপ্র হয়েছে। এর ফলে আর্ম প্রসেসর কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে, তা জানার আগ্রহ প্রযুক্তিবোদ্ধাদের মধ্যে বেশ বেড়েছে।
হালে আর্ম নতুন কোরের রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়েছে পরবর্তী বছরের জন্য। লক্ষণীয়, ইন্টেল বা এএমডির মতো আর্ম হার্ডওয়্যার তৈরি করে না বরং নতুন ডিজাইন বা নকশা তৈরি করে বিক্রি করে। ক্রেতা কোম্পানিগুলো সে নকশাকে বিশেষায়িত করে অর্থাৎ তাদের উপযোগী করে নির্মাণ করে হয় নিজেদের পণ্যে ব্যবহার করে অথবা বাজারজাত করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অ্যাপল, স্যামসাং, অ্যাভয়, কোয়ালকম, এনভিডিয়া, মিডিয়াটেক ইত্যাদি। এবার দেখা যাক, আগামী বারো মাসে অ্যান্ড্রয়িড ডিভাইসকে ক্ষমতা দেয়ার জন্য আর্ম প্রসেসরে কী অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে।
করটেক্স এ৭৩ প্রিমিয়াম কোর
সর্বোচ্চ জাতের প্রসেসর হিসেবে করটেক্স এ৭২-এর পরবর্তী প্রজন্ম এ৭৩ কোরের ঘোষণা দিয়েছে আর্ম কোম্পানি। এ৭২-এর যে দুটো সংস্করণ গত বছর ঘোষণা দিয়েছিল, তা হলো- ২৮ ন্যানোমিটার ও ১৬ ন্যানোমিটার কোর নকশা। এ৭৩ কোর এ৭২-এর তুলনায় ৩০ শতাংশ দ্রুতগতিসম্পন্ন ও ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হবে বলে আর্ম জানিয়েছে। এ৭২-এর যেখানে শিখর গতি ছিল ২.৫ গিগাহার্টজ, সেখানে এ৭৩-এর সর্বোচ্চ গতি হবে ২.৮ গিগাহার্টজ। ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ব্যাপারটি আসবে ১০ ন্যানোমিটার ওয়েফারে নামিয়ে ফেলার জন্য। ফলে করটেক্স এ৭৩ কোর মাত্র ০.৬৫ বর্গ মিলিমিটারের আকৃতির হবে। তবে ১০ ন্যানোমিটারে উৎপাদনের কথা থাকলেও ১৬ বা ১৪ ন্যানোতেও উৎপাদিত হতে পারে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন।
আইপ্যাড ২ ও স্যামসাং গ্যালাক্সি এস৩-এ করটেক্স এ৯ কোর সংযোজনের ফলে তা সবার নজর কাড়ে। তারপর থেকে প্রত্যেক নতুন প্রজন্ম উন্নত দক্ষতা নিয়ে বাজারে আবির্ভূত হয়েছে। আর্মে বিগডটলিটল কৌশলের ফলে ক্ষুদ্র কোরে দ্রুত কোরের সমন্বয়ের কাজের বোঝাকে ভাগ করা সম্ভব হয়েছে। প্রতীয়মান হচ্ছে, এ৭৩ নকশায় ৬ কোর থাকবে। তাতে দুটি এ৭৩-এর সাথে এ৫৩-এর চারটি কোর নকশা থাকবে।
হেক্সা কোর এ৭৩ অষ্ট কোর এ৫৩-এর মতো আকৃতির হবে। কিন্তু গতিতে খুব উচ্চতায় থাকবে।
উচ্চ দক্ষতার করটেক্স এ৩৫
ইন্টেলের অনুসরণে আর্মও তাদের মোবাইল প্রসেসর পরিবারকে তিন ভাগে ভাগ করেছে। ৬৪ বিটের উৎকর্ষ পরিবারের প্রসেসরগুলো করটেক্স এ৭২ ও এ৫৭ স্থাপত্য ভিত্তির ওপর নির্মিত। ভালো দক্ষতাসম্পন্ন ৬৪ বিটের প্রসেসরগুলো করটেক্স এ৫৩ স্থাপত্যের ওপর এবং কমদক্ষতার প্রসেসরগুলো এ৫ ও এ৭ নকশার ভিত্তির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে, তবে এতে ৬৪ বিট রাখা হয়নি। এ৭-এর প্রতিস্থাপন হিসেবে এ৫৩-কে চিন্তাভাবনা করছে আর্ম। তবে এ ব্যাপারে তারা এখনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। কারণ এ৫৩ দক্ষতার ব্যাপারে বেশ অগ্রগামী হলেও বিদ্যুৎতের অপচয় বেশি করে। ফলে দ্বিধায় রয়েছে কোম্পানি। তবে এ শূন্যতাকে পূরণের জন্য তারা করটেক্স এ৩৫ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে এটি এ৫৩-এর তুলনায় ৩২ শতাংশ কম বিদ্যুৎ ব্যয় করবে। এ৩৫ তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হবে- ০১. এ৭-এর তুলনায় ৪০ শতাংশ দক্ষ হবে, ০২. ৬৪ বিটের স্থাপত্য ও ০৩. ৩২ শতাংশ কম বিদ্যুৎ ব্যয় যেমন- ২৮ ন্যানোমিটার স্কেলে ১ গিগাহার্টজ গতিতে মাত্র ৯০ মিলিওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় করবে। এ ছাড়া এটিকে বিভিন্নভাবে কনফিগার করা সম্ভব হবে। যেমন- একক, দ্বৈত বা চতুষ্টয় কোর দিয়ে গঠন করা যাবে এবং এর পাশাপাশি এল-২ ক্যাশকে ১২৮ কিলোবাইট থেকে ১ মেগাবাইটে উত্তরণ ঘটানো যাবে। ফলে এ৩৫ বহুমুখী রূপ ও কার্যকারিতা নিয়ে বাজারে হাজির হতে যাচ্ছে।
করটেক্স এ৩২
ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে সন্দেহ নেই। কেউ বলছেন, আগামী দিনে এরই রাজত্ব হবে। অন্যরা বলছেন, এটি সময়ের অপচয় মাত্র। যাই হোক, আইওটি উন্নয়নের ব্যাপারে এতদিন বিশেষজ্ঞেরা কাজ করেছেন করটেক্স এম সিরিজের মাইক্রোকন্ট্রোলার দিয়ে। ফিটন্যাসব্যান্ড জাতীয় একক ফাংশনবিশিষ্ট ডিভাইসে আর্মের এ প্রসেসরগুলো জনপ্রিয়। এ লক্ষক্ষ্য তারা উপরিউক্ত প্রসেসরের পরিবর্তে করটেক্স এ৩২ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে মূলত এ৩৫-এর একটি সংস্করণ, যাতে ৬৪ বিট থাকবে না, তবে এর দক্ষতা এ৩৫-এর তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি হবে। ফিটনেস ব্যান্ড ও পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির পরবর্তী প্রজন্মে এ প্রসেসর ব্যবহার হওয়ার আশা ব্যক্ত করছে আর্ম। এটিও কনফিগারেবল হবে, তথা ১ গিগাহার্টজ পর্যন্ত উন্নীত করার পাশাপাশি চতুর্কোরবিশিষ্ট করা যাবে। যদিও এ ডিভাইসগুলোতে সীমিত আকারে অপারেটিং সিস্টেম চলে, তবে এ৩২ উইন্ডোজসহ অ্যান্ড্রয়িড সিস্টেম পূর্ণ কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করতে পারবে। এটিকে নতুন জিপিইউ মালি-৪৭০-এর সাথে সংযোজন করা হবে, যা ৬৪০ বাই ৬৪০ পিক্সেল প্রদর্শন করতে পারবে। এ জিপিইউ মালি-৪০০-এর তুলনায় অর্ধেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে।
নতুন জিপিইউ মালি-জি৭১
সিপিইউর পাশাপাশি আর্ম নতুন জিপিইউ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর নাম দিয়েছে মালি-জি৭১, যা ২০১৫ সালের স্বর্ণ প্লেটধারী মালি-টি৮৮০-এর তুলনায় ২০ শতাংশ শক্তিদক্ষতা এবং ৪০ শতাংশ উচ্চদক্ষতা দেখাতে সক্ষম হবে। নতুন স্থাপত্যের নাম দেয়া হয়েছে ‘বিট ফ্রস্ট’। এটি সিপিইউর সাথে ক্যাশ মেমরি ভাগ করে নিতে পারবে। মূলত অ্যান্ড্রয়িডকে মাথায় রেখে এটির নকশা করা হয়েছে। মজার ব্যাপার, জি৭১ ডাইরেক্ট এক্স ১২ সমর্থন করবে এবং ভালো কোনো ওপেনসোর্স এপিআই গ্রাফিক্সকেও এটি সমর্থন দেবে। এ ছাড়া মোবাইলেও যাতে স্বচ্ছন্দে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা যায়, তার ব্যবস্থা এতে থাকবে। বলাবাহুল্য, এ বছরের কমপিউটেক্স মেলায় ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’ বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। আগামী বছর মোবাইল ভার্চুয়াল রিয়েলিটি পণ্য বিক্রির প্রধান কারণ হতে পারে বলে আর্ম ধারণা করছে। ৪-কে ডিসপ্লের প্যানেলের পাশাপাশি জি৭১-এর পারফরম্যান্স একটি সময়োপযোগী উপস্থাপনা হবে বলে আর্ম মনে করছে। জি৭১-এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি একক কোর থেকে ৩২ কোর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবার যোগ্যতা রাখে। এ ছাড়া এটি ১২০ হার্টজ রিফ্রেশ রেটে কাজ করতে পারবে। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের ডিভাইসে গেমিং বেশ চমৎকার সংযোজন হবে।
কার কখন আবির্ভাব হচ্ছে
আর্ম যেহেতু এএমডি বা ইন্টেলের মতো চিপ তৈরি করে না বরং অন্য কোম্পানির কাছে লাইসেন্স বিক্রি করে, সেহেতু এটা বলা মুশকিল কোন পণ্য কখন বাজারে আসছে। প্রায় ২৫০টি কোম্পানির কাছে আর্ম তার নকশা বিক্রি করে যারা তাদের স্মার্টফোন অনুযায়ী স্মার্টফোনযোগ্য ‘সিস্টেম অন এ চিপ’ তথা এসওসি তৈরি করে। এ ছাড়া কিছু কোম্পানির কাছে ‘স্থাপত্য লাইসেন্স’ বিক্রি করে, যারা তাদের নিজস্ব কোর নকশায় আর্ম ইনস্ট্রাকশন সংযোজনের সুবিধা পায়।
আইফোন ৫-এ অ্যাপল এ৬ এসওসি নির্মাণ করেছিল। হালে প্রচলিত এ৬এস আইফোন এ৯ এসওসিতে আর্মের ৬৪ বিটের ইনস্ট্রাকশন সংযোজিত করেছিল। স্যামসাংয়ের গ্যালাক্সি এস৭ ও এস৭এজ ফোনে ব্যবহার এক্সিনস এম১-এ নকশা অদল-বদল করা হয়েছিল। তবে স্যামসাং ও কোয়ালকম এখনও স্ট্যান্ডার্ড আর্ম এসওসি তৈরি করছে। এদিকে স্যামসাং এ৭২ কোর সংবলিত এক্সিনস চিপ অচিরেই বাজারে ছাড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে। তথ্যসূত্রে জানা গেছে, ক্রিসমাসের আগেই হয়তো বা এ৭৩ কোর সংবলিত ডিভাইস বাজারে এসে যেতে পারে। হাই সিলিকন নামে কোম্পানির কিরিন ৯৬০ এসওসি হুয়ায়ে নির্মিত মেট৯এ বাজারে এ বছরে আসবে বলে জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। এটি ১৬ ন্যানোতে তৈরি হবে। এ বছরের শেষের
দিকে এ৭২ ও এ৫৩ এসওসি সংযোজিত নতুন ডিভাইস বাজারে আসবে বলে জানা গেছে। যেমন- স্যামসাংয়ের গ্যালাক্সি সি৭-এ করটেক্স এ৫৩ কোর থাকবে, যা শিগগিরই বাজারে আসছে বলে জানা গেছে।
কোয়ালকমের সণ্যাপড্রাগন ৮২৮ দ্বৈত ও ৮৩০ চতুর্কোর দিয়ে তৈরি মডেম বা রাউটার ১ গিগাবিট/সেকেন্ড (এলটিই) ফোরজি গতি দিতে সক্ষম হবে বলে দাবি করা হয়েছে। হয়তো এ কারণে টেলস্ট্রা ও অপটাস এ বছরের শেষের দিকে ১ গিগাবিট/সেকেন্ড গতি গ্রাহকদের উপহার দিতে পারবে বলে আশ^স্ত করেছে।
ব্যাটারির স্থায়িত্ব
পারফরম্যান্স যতই সুতীক্ষন হোক না কেন, বেশিরভাগ ভোক্তাই একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেন- ‘ব্যাটারির স্থায়িত্ব ভালো হবে তো?’ নতুন প্রসেসরগুলোতে স্থায়িত্ব কিছুটা ভালো হলেও খুব আহামরি হবে তেমন নয়। মূলত স্মার্টফোনের দুটি জিনিস বেশি বিদ্যুৎ ব্যয় করে- একটি হচ্ছে সিপিইউ তথা প্রসেসর, অন্যটি হচ্ছে স্ক্রিন বা পর্দা। গবেষণায় দেখা গেছে, স্যামাসং গ্যালাক্সি এস৩-এর এ৯ কোরবিশিষ্ট এক্সিনস এসওসি ১৩০ মিলিওয়াট এবং এলসিডি প্যানেল ৩৬০ মিলি ওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় করে। এসওসির বিদ্যুৎ ব্যয় কমাতে সক্ষম হলেও ডিসপ্লে প্যানেলের তীব্র চাহিদার কারণে ব্যাটারি স্থায়িত্ব বাড়ানোর ব্যাপারে জটিলতা রয়েছে।
উপসংহার
যদি আপনি দ্রুততম পারফরম্যান্সের স্মার্ট ডিভাইস কিনতে চান, তাহলে আল্ট্রা লো পাওয়ার বাজারে এ৩৫, মেইনস্ট্রিম বাজারে এ৫৩ এবং প্রিমিয়াম ক্লাসে এ৭৩ কোর বেছে নিতে হবে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের এসওসি তথা স্মার্ট ডিভাইসটি করটেক্স এ৭৩ এবং মালি-জি৭১ দিয়ে নির্মিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই, যা ২০১৭ সালে বাজারে আসবে। তবে আগামী বছরের মেনুতে ৪-কে পর্দা এবং মোবাইল ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি) থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। ভোক্তারা যত বিলম্বে কিনবেন, তত বেশি লাভবান হবেন- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়