• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > নির্বাচনে নতুন বিতর্কে সেলফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: ইমদাদুল হক
মোট লেখা:৬২
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৩ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
মোবাইল
তথ্যসূত্র:
রির্পোট
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
নির্বাচনে নতুন বিতর্কে সেলফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া

জীবনের পরতে পরতে এখন প্রযুক্তির ছোঁয়া। এ ছোঁয়ার আবেশে দিন দিন বদলে যেতে শুরু করেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচার। ব্যক্তিক জীবনের পাশাপাশি বাদ পড়ছে না সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। এ পরিবর্তনে আমরা কিন্তু কম আনন্দিত নই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিসরে এ আনন্দ কখনও কখনও জড়িয়ে পড়ছে ‘প্রাইভেসি’ আর ‘সিক্রেসি’ দ্বন্দ্বে। সেই দ্বন্দ্বের সুরতহাল ছাড়াই আমরা হররোজ চেষ্টা করি প্রবাহমান নদীতে বাঁধ দিতে। ফলে প্রবল বেগে ফুঁসে ওঠে জনরোষ। তারপর হররোজ চলে অন্ধকার পথে হেঁটে চলার নানা চোরাপথের সন্ধান। তৈরি হয় ইচ্ছে মতো বিধিমালা আর আইন-কানুন। ‘বজ্র আঁটুনি আর ফসকা গেঁড়ো’ প্রবাদ আরও একবার সত্যি হয়ে ওঠে জীবনে। অথবা প্রতিমত দমনের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার হয়। দেখা দেয় নবতর জটিলতা।

এমনই এক জটিল পথে এবার পা বাড়িয়েছে আমাদের নির্বাচন কমিশন। প্রযুক্তির সহায়তায় সীমিত আকারে ই-ভোটিং পদ্ধতিতে যাত্রা শুরু করলেও এবার তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে যাচ্ছে এ প্রযুক্তিকেই। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রচারণার ক্ষেত্রে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া ও সেলফোনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ন্ত্রণের বিধান রেখে তৈরি হচ্ছে নতুন আচরণবিধি।

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত বিধির খবরে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে কোনো ব্যক্তি টেলিভিশন, প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোনো প্রচারণা চালাতে পারবেন না। সেলফোনে এসএমএসের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা যাবে না। অশস্নীল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ই-মেইল পাঠানো নিষেধ। এছাড়া ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কোনো মিথ্যাচার চলবে না।

অথচ আগে থেকেই প্রচারণার বক্তব্য প্রসঙ্গে বর্তমান বিধিমালার ১১(ক) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি নির্বাচনী প্রচারণাকালে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করিয়া বক্তব্য প্রদান বা কোন ধরনের তিক্ত বা উস্কানিমূলক কিংবা লিঙ্গ, সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোন বক্তব্য প্রদান করিতে পারিবেন না।’

আইনত যা মানহানিকর, সহিংসতায় বা অপরাধে উস্কানিমূলক, লিঙ্গ-ধর্ম-সম্প্রদায় বা অন্য যেকোনো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা তা এখানে নিষেধ করাই আছে। এ বিধি ইন্টারনেটে দেয়া তথ্য ও বক্তব্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এমন পরিস্থিতিতে নতুন এ বিধি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর বিশেষভাবে নৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন নেটিজেনেরা।

অভিজ্ঞজনদের মতে, সেলফোন ও ইন্টারনেটে ‘অপপ্রচার, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য বা অশস্নীল ও মিথ্যা তথ্য বা মিথ্যাচার’-এর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। এমন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কমিশনকে ‘অপপ্রচার’, ‘কুরুচি’, ‘অশস্নীলতা’ ও ‘মিথ্যা’ নির্ধারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু কোনো দলীয় রাজনীতির প্রতি কমিশনের পক্ষপাত ছাড়া প্রচারণায় এসব বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা কঠিন। কারণ কোনো তথ্য বা বক্তব্যে ভিন্নদলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের দেখা মেলে। এ ব্যাপারে কমিশন পক্ষ নিলে সুষ্ঠু নির্বাচন কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া এ ধরনের ‘নৈতিক’ ও ‘রাজনৈতিক’ নিষেধাজ্ঞা শুধু ইন্টারনেটসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে আরোপ জনমনে প্রশ্নের জন্ম দেবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রার্থী ও তাদের পক্ষে ইন্টারনেটে প্রচারণার তদারক করতে পারে। যেমন- একজন প্রার্থীর পক্ষে যেসব ইন্টারনেট ঠিকানা (ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ বা গ্রম্নপ, টুইটার অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি) থেকে প্রচারণা চালানো হবে, সেসব ঠিকানার তালিকা জমা নেয়ার বিধান করতে পারে। যাতে বর্তমান বিধিমালায় বর্ণিত মানহানি, উস্কানি ও ঘৃণা এসব ওয়েব ঠিকানা থেকে প্রচার হলে প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু অনির্দিষ্টভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নির্বাচনী আলাপ-আলোচনায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেই। তাই এ উদ্যোগ আগামী জাতীয় নির্বাচনে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করবে বলেই মনে করেন বিশেস্নষকেরা।

রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটনের মতে, আমাদের সবার ভালো করে জানাও নেই এনভেলপের চিঠির সাথে তুলনীয় সামান্য কোনো নিশ্চয়তাও ইন্টারনেটে নেই। স্মার্টফোনে নেই। ইয়াহু, জিমেইল, হটমেইল, ওয়াই মেইল, গুগল মেইল- এ সবই একেবারে উন্মুক্ত। একদম উন্মুক্ত ই-মেইল সার্ভিস এগুলো। স্কাইপ, ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস এসব সার্ভিসে আমাদের ই-মেইল, ইনস্ট্যান্ট চ্যাট, মেসেজ, ছবি, তথ্যাবলী যাবতীয় কিছু ঠিক যেনো খোলা পোস্টকার্ডের মতো। অথচ কেনো আমি খামে ভরে চিঠি পাঠাচ্ছি, এ অভিযোগ রাষ্ট্র কখনও আমার বিরুদ্ধে তোলেনি। তুলতে পারেনি। তোলাটা নিতান্তই অবান্তর বটে। এ নিয়ে যুক্তিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু আমার ই-মেইলকে ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়্যার দিয়ে খামের মতো করে আড়াল করার প্রাইভেসি-প্রচেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্র। প্রাইভেসি রক্ষার ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়্যারকে অবৈধ, অপরাধমূলক বলে প্রতিপন্ন করার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে। বেশি বেশি কোডিং করে, এনক্রিপশনের সফটওয়্যার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরাই পারি ইন্টারনেটের স্বাধীনতা আর আমাদের প্রাইভেসি নিশ্চিত করতে। এর জন্য এত বিধি-বিধানের দরকার আছে বলে মনে করি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউলস্নাহর অভিমত, নির্বাচনে প্রযুক্তি কে, কীভাবে ব্যবহার করবেন ছেড়ে দেয়া হোক তাদের ওপর। একে নিয়ন্ত্রণ নয়, জনগণ তথা ভোটারদের সচেতন করার মাধ্যমে সত্য-অসত্যের মধ্যে পার্থক্য বোঝার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই প্রার্থীরা অসত্য প্রচারণা চালিয়ে পার পাবেন না। এজন্য আইনের প্রয়োজন নেই। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ বা সেলফোনে এসএমএস বন্ধ কোনো সমাধান নয়। নির্বাচন কমিশনকে এ জাতীয় বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে কীভাবে একে শক্তিশালী করে তোলা যায়, সেদিকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে।

সন্দেহ নেই, বিশ্বজুড়েই সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব রাখছে। বাংলাদেশেও দিন দিন বাড়ছে এর ব্যবহার। জনআগ্রহেই আসছে নির্বাচনেও ঠিকই এর ব্যবহার বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে নাকি জনগণের কাছেই সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের বিষয় ছেড়ে দেয়া হবে তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এ বিতর্ক নিরসনে খোলামেলা উদ্যোগ নিতে হবে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা আর সচেতনতা তৈরিই অন্যতম দাওয়াই বলে মনে করেন বিজ্ঞজনেরা।

একইভাবে দেশে সেলফোনের বিস্তার ঘটার পাশাপাশি নির্বাচনেও এর নানা ব্যবহার বেড়েছে। ইতোমধ্যেই এসএমএসের মাধ্যমে ভোট প্রার্থনার বিষয়টি বেশ নজর কেড়েছে। পাশাপাশি ফ্ল্যাক্সিলোডের মাধ্যমে অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগও রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপট থেকে নির্বাচন কমিশন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু এটা চিহ্নিত করা যেমন সহজ নয়, তেমনি প্রমাণ মিললে প্রচলিত বিধিতেও কিন্তু শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তা না করে বিধি প্রণয়নের এ উদ্যোগ যে বিতর্ক সৃষ্টি করবে তা নির্বাচন কমিশনকে প্রযুক্তি প্রতিবান্ধব কিংবা স্বচ্ছতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে কি না তাও ভেবে দেখা দরকার

ফিডব্যাক : netdut@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৩ - আগস্ট সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস