• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:৯৩
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০০৮ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
কমপিউটার শিক্ষা
তথ্যসূত্র:
শিক্ষাঙ্গন
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতায় তখন বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফলের বিষয়টি কমপিউটারে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়৷ তখন থেকেই কমপিউটারকে একটি বিষয় হিসেবে পাঠ্য করার জন্য আমি লবিং করতে থাকি৷ কিন্তু তবুও তখন এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি৷

এরপর বেগম খালেদা জিয়ার সরকার কমপিউটার সমিতির দাবিকে সামনে নিয়ে যাবার জন্য ৯২ সালে স্কুল-কলেজে কমপিউটার শিক্ষার পাঠক্রম প্রস্তুত করে৷ সেই পাঠক্রম অনুসারে বই লিখে কোর্সটি চালু করতে করতে সময় লেগে যায় চার বছর৷ ১৯৯৬ সালে এসএসসিতে কমপিউটার বিষয়টি চালু হয়৷ আমি এসএসসি পর্যায়ে কমপিউটার কোর্স চালু করার জন্য পাঠ্যবই লেখার দায়িত্ব নিই এবং ১৯৯৬ সালে সেই বই দিয়ে এসএসসি পর্যায়ে কমপিউটার বিষয়টি চালু হয়৷ এরপর ১৯৯৮ সালে এইচএসসি পর্যায়ে এই কোর্সটি চালু হয়৷ তখনো এইচএসসিতে আমার বইটিই ছিলো একমাত্র পাঠ্যপুস্তক৷

১৯৯৭ সালে জেআরসি কমিটিতে আমরা শিক্ষায় কমপিউটারের গুরুত্ব দিতে পেরেছিলাম বলেই সরকার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় কমপিউটার সরবরাহের উদ্যোগ নেয়৷ মূল পরিকল্পনাটি আওয়ামী লীগ সরকারের হলেও তারা কমপিউটার বিতরণের কাজটি শুরু করে যেতে পারেনি৷ কার্যত সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমপিউটার দেয়া শুরু করে ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে৷ তবে ২০০১-০২ থেকে কয়েক বছর কমপিউটার বিতরণ প্রক্রিয়াটি অব্যাহত ছিলো৷ এখন আবার সেটি বন্ধ রয়েছে৷ সরকারি হিসাব মতে ২০০৮ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৬,১৩২টি কমপিউটার স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসায় দেয়া হয়েছে৷ ইন্টেলের সহায়তায় আরো ২৮০টি কমপিউটার বিতরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে৷ সরকার এই কার্যক্রমটি অব্যাহত না রাখায় তথ্যপ্রযুক্তিতে জনসম্পদ তৈরি হওয়া হুমকির মুখে পড়ে৷

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দাবি করা হচ্ছে, এই সময়ে কমপিউটার বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ যথেষ্ট পরিমাণে হয়েছে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, এ পর্যন্ত ২৭,৯২০ জন শিক্ষককে কমপিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে৷ মাইক্রোসফটের সহায়তায় আরো ৪,৬০০ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে৷ এর ফলে প্রায় ৩২ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন৷

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, বিগত এক যুগ বা এক দশকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কমপিউটার বিষয়টি প্রচলনের পরিমাণ একেবারে কম নয়৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪,৩২৪টি প্রতিষ্ঠান কমপিউটার বিষয়ে শিক্ষাদান করছিল৷ ২০০৩ সালে এই সংখ্যা হাজারখানেকের মতো ছিল৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ার পরিমাণ প্রায় চার গুণ৷ অন্যদিকে ২০০৩ সালে যেখানে এই বিষয়ে মাত্র ১২ হাজার ছাত্র পাস করেছিল সেখানে ২০০৭ সালে প্রায় ৪০ হাজার ছাত্র পাস করেছে৷

উচ্চ মাধ্যমিকে ২০০৭ সালে মোট ১,৬৯৯টি প্রতিষ্ঠান কমপিউটার শিক্ষা প্রদান করে৷ ২০০৭ সালে ছাত্রছাত্রীর পাসের সংখ্যা ছিলো ৫৪,৭৪৭ জন৷ মাদ্রাসায় ২০০৭ সালে ২,৪৬০টি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৩,৩৪৯ জন ছাত্রছাত্রী পাস করেছে৷ ২০০৭ সালে ১৫৪টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪,৫৭৩ জন ছাত্রছাত্রীর মাঝে ২,৮৩৪ জন পরীক্ষার্থী ছিলো৷ এর বাইরে ২০০৭ সালে ৪৪৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএসসি ভোকেশনাল পর্যায়ে ১১,০৭৩ ছাত্রছাত্রীর মাঝে ৫,৭২৪ জন ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছে৷ এর বাইরেও ১,৩২৪টি এইচএসসি (বিএম)কোর্সে২০০৭ সালে ২৭,১৫৬ জন ছাত্রছাত্রীর মাঝে ২২,৪৩২ জন পরীক্ষার্থী ছিলো৷

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কমপিউটার শিক্ষার অবস্থাটি একেবারেই নাজুক৷ চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা একটু চোখ বুলাতে পারি৷

০১. মাধ্যমিক স্তরে কমপিউটার শিক্ষা সিলেবাসটি ২০০২ সালে একবার পর্যালোচনা করা হলেও উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠক্রমটি ১৯৯২ সালের৷ প্রায় সব ক্ষেত্রে মাধ্যমিকের পাঠ্য বিষয় উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্য বিষয়ের চাইতে আপডেটেড৷ দৃষ্টান্তটি এমন- মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ভিজ্যুয়াল বেসিক পড়ে, কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা পাঠ করে বিলুপ্ত কিউ বেসিক৷ কিউ বেসিক এখন কোনো কমপিউটারে ইনস্টল করাও যায় না৷

০২. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা উচ্চতর গণিত নিতে গেলে কমপিউটার বিষয়টি নিতে পারে না৷ বিষয়টি চতুর্থ অপশনাল বিষয় হিসেবে নিতে হয় বলে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা প্রধানত উচ্চতর গণিত পাঠ করে থাকে৷

০৩. মাইক্রোসফটের সহায়তায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেয়ার পরও একই বিষয়ে পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যায় না৷ এ বিষয়ের জন্য নির্ধারিত কোনো শিক্ষক পদ নেই৷ এই পদে নিয়োগের জন্যও কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই৷

০৪. যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়টি শিক্ষা দেয়া হয়, এর প্রায় সবগুলোতেই প্রয়োজনীয় কমপিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সম্বলিত কমপিউটার ল্যাব নেই৷ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল যে এসব সমস্যার বিষয় সম্পর্কে অবহিত নয় তা নয়৷

গত ৪-৫ জুলাই ২০০৮ রাজেন্দ্রপুরে আইসিটি পলিসি নিয়ে দুদিনব্যাপী আলোচনার সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের সাথে (খালিদ হোসেন) আমার এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এবং তিনি আমাকে প্রধান উপদেষ্টাকে প্রদত্ত একটি প্রতিবেদনের কপি সরবরাহ করেন৷ আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র ধরে যেসব তথ্য দিয়েছি তার সব সেই প্রতিবেদন থেকে নেয়া৷ জানা গেছে, বছর চারেক আগে থেকেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইসিটি বিভাগ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ যদিও বিস্তারিত বলা নেই, তবুও আমার মনে হচ্ছে, এটি হবে কলা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান এমন আরো একটি শাখা৷ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় পর্যায়ে এই বিষয়টি চালু হবে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে একটি কমিটিও গঠন করেছে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এই কমিটির আহ্বায়ক এবং বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন), কার্যনির্বাহী পরিচালক- বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল, মহাপরিচালক-কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, চেয়্যারম্যান-এনসিটিবি এবং পরিচালক, আইআইসিটি-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহকারী প্রধান কে এম আলী রেজা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (কারিগরি)মো: আক্তারুজ্জামান তালুকদার এই কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন৷ মোট ৮ জন সদস্যের ৭ জন আমলা এবং ১ জন শিক্ষাবিদ৷ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প খাতের কেউ এই কমিটিতে নেই৷ এই খাতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন কমপিউটার বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের লেখক, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ; এমনদের কেউও এই কমিটিতে নেই৷

কমিটি কয়েকটি সভা করে এই বিষয়ের একটি কারিকুলাম নির্ধারণ করেছে৷ তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজি ও কমপিউটারের প্রতিটিতে ২০০ নম্বর করে ৬০০ এবং গণিত, উচ্চতর গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্ম, পদার্থ ও রসায়ন বিষয়ে ৬০০ নম্বর দিয়ে মোট ১২০০ নম্বরের একটি বিভাগ মাধ্যমিক পর্যায়ে খোলা যায়৷ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও ১২০০ নম্বরের ব্যবস্থাসহ বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, গণিত ও কমপিউটার নামের ৬টি বিষয়ের প্রতিটিতে ২০০ নম্বর রাখা হয়েছে৷ কোনো পর্যায়ে কোনো অপশনাল বিষয় রাখা হয়নি৷

গত ৫ জুন ২০০৮ সচিবালয়ের মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত আইসিটি টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির সভায় আমি এই বিষয়টি মূল কমিটিতে আলোচনার জন্য প্রস্তাব করি৷ কেবিনেট সচিব আলী ইমাম মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে সভায় এই বিষয়টিকে টাস্কফোর্সের মূল কমিটির সভার প্রথম আলোচ্যসূচি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়৷ সেই সভায় শিক্ষা সচিবকে এ বিষয়ে কার্যপত্র প্রস্তুত করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ আগামী কোনো এক সময়ে অনুষ্ঠিতব্য টাস্কফোর্সের সভায় এটি সম্ভবত আলোচিত হতে পারে৷ আশা করি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি আলোচিত হলে এর সঙ্কটগুলো কাটানোর চেষ্টা সফল হতে পারে৷

ইতোপূর্বে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা এবং শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টির কারিকুলামের পাশাপাশি কমপিউটার সরবরাহ এবং আইসিটি বিভাগ চালু করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি৷ সেটি সূচনা ছিলো মাত্র৷ তবে আমরা বলতে পারি যে, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার মূল সঙ্কটগুলো হচ্ছে : ক. কমপিউটার শিক্ষা বিষয়ে স্কুল-কলেজের পাঠক্রম নবায়ন হয়নি৷ স্কুলেরটি একবার পর্যালোচনা করা হলেও কলেজেরটির অবস্থা ভয়ঙ্কর৷ খ. স্কুল-কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা কমপিউটার শিক্ষা নামক এই অপশনাল বিষয়টি পড়তে পারে না৷ গ. স্কুল-কলেজ কোনো পর্যায়েই এই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগে কোনো নীতিমালা নেই৷ স্কুলে কোনোমতে এই বিষয়টি অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা পড়াতে সক্ষম হলেও কলেজে এই বিষয়টি পড়াতে অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা হিমশিম খান৷ ঘ. কারিগরি বা ভোকেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমপিউটার শিক্ষার মান জঘন্য৷ ঙ. স্কুল-কলেজে কমপিউটার শিক্ষার ল্যাব বা এই ধরনের কোনো অবকাঠামো নেই৷ চ. সরকার বিদ্যমান কমপিউটার শিক্ষা বিষয়ে কোনো পরিবর্তন না করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আইসিটি নামে একটি বিভাগ খুলছে৷

আইসিটির নতুন বিভাগ

আমরা জেনেছি যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইসিটি নামে একটি নতুন বিভাগ খোলার প্রস্তুতি নিয়েছে৷ এজন্য আমলাতান্ত্রিক কমিটির সহায়তায় বিবিধ বিষয় নির্ণয় করা হয়েছে৷ কিন্তু যাদের দিয়ে এই বিষয়টির বিভিন্ন বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি যথেষ্ট নয় বলেই মনে হয়৷ সাত আমলা ও এক শিক্ষাবিদ দিয়ে কমপিউটার শিল্প খাতের কোনো প্রতিনিধিত্ব না রেখে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধমিক স্তরে আইসিটি বিভাগ খোলার জন্য সিলেবাস বা কারিকুলাম ও বিষয় বাছাই করে খুব ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করি না৷ বরং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটিকে যে বিষয়টি এখন মাধ্যমিক পর্যায়ে চালু আছে প্রথমে সেই বিষয়টি শেখানোর সাথে জড়িত সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ এর কারিকুলাম, বিজ্ঞান বিভাগসহ সব ছাত্রছাত্রীর জন্য কমপিউটার বিষয়টিকে আবশ্যিক করা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান, শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা, অবকাঠামো তৈরি করা ইত্যাদি অবশ্যই করা দরকার৷

একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে প্রথমেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কেমন করে দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কমপিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত করা যাবে৷ সরকার ঠিক করবে কোন স্তরে কখন এটি বাধ্যতামূলক করা যায়৷ এর জন্য সরকার অবকাঠামো গড়ে তোলাসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করবে৷

আমাদের আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, এই দুনিয়াতে টিকে থাকতে হলে আমাদের কমপিউটার-শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে৷ আর এজন্য কেবল আইসিটি নামের একটি বিভাগ চালু করলেই হবে না, বরং একেবারে শৈশব থেকে যাতে করে কমপিউটারের সাথে যুক্ত হওয়া যায় সেই কথা ভাবতে হবে৷

২০০৪ সাল থেকেই দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আইসিটি নামের একটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু হবার কথা ছিলো৷ তবে দুর্ভাগ্য চার বছরে এর বাস্তব কোনো অগ্রগতি হয়নি৷ শুধু আলাদা বিভাগ চালু করা নয়, বরং প্রথম কাজটি হলো কমপিউটার শেখার জন্য হাতের কাছে কমপিউটার যোগান দেয়া৷ আমাদেরকে এখন এমন উপায়ের কথা ভাবতে হবে, যাতে পুরো দেশের সব মানুষকে কমপিউটার-শিক্ষিত করা যায়৷ আরও স্পষ্ট করে ভাবতে হবে, কিভাবে সব মানুষের, বিশেষত ছাত্রছাত্রীর হাতে কমপিউটার দেয়া যায়৷

বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের হাতে কমপিউটার দেবার একটি আলোচিত উপায় হলো কম দামী ল্যাপটপ কমপিউটারের ব্যবস্থা করা৷ বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আমাদের মতো অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো এ ধরনের অনেক উদ্যোগ নিয়েছে৷ ওএলপিসি নামের একটি প্রকল্প শুরুই হয়েছিলো মাত্র একশ ডলালে শিশুদের হাতে ল্যাপটপ পৌঁ ছে দেয়ার জন্য৷ প্রকল্পের আওতায় এরই মাঝে ছয় লাখেরও বেশি ল্যাপটপ শিশুদের হাতে পৌঁ ছে গেছে৷ যদিও এই প্রকল্প থেকে একশ ডলালে ল্যাপটপ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তথাপি এর আবেদন কম হয়নি৷ এই প্রকল্প থেকেই আগামী দুই বছরের মাঝে ৭৫ ডলারে ল্যাপটপ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷ আমি মনে করি, এমন দামের একটি কমপিউটার যন্ত্র আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় কমপিউটার শিক্ষা তথা শিক্ষার ক্ষেত্রেই বিপ্লব আনতে পারে৷ এই বিপ্লবটি কেনো জরুরি তার আরও কিছু কারণ আমরা উপলব্ধি করতে পারি৷

গত ২৪ জুলাই ২০০৮ আমাদের সময়-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা স্কুলে এখন আর বই বহন করে না৷ তারা বই-এর বদলে সাথে ল্যাপটপ বহন করে৷ এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, বাজারে শিশুদের উপযোগী ল্যাপটপের জোয়ার বইছে এখন, যার দামও অবিশ্বাস্যভাবে কম৷ একই সাথে বইগুলো সফটওয়্যারে পরিণত হয়েছে৷ আমি নিজে বিশ্বের বড় বড় কমপিউটার নির্মাতাদের এ ধরনের নতুন নতুন কমপিউটার দেখে অভিভূত হয়েছি৷ কয়েক মাস আগে আমার হাতে পড়েছিলো আসুস নামের একটি কোম্পানির ইপিসি৷ মাত্র সাত ইঞ্চি পর্দার এই পিসিটি ব্যবহার করতে গিয়ে আমি এর ছোট পর্দা ও কম স্টোরেজ ক্ষমতা নিয়ে অসুবিধা অনুভব করি৷ কিন্তু সেই অসুবিধার বিষয়টি খুব জোরালোভাবে অনুভব করার আগেই আসুস ৯ ও ১০ ইঞ্চি পর্দার ও ৩০ গিগাবাইট থেকে বেশি ধারণক্ষমতার হার্ডডিস্কসহ কমপিউটার বাজারজাত করা শুরু করেছে৷ মে মাসে আমি ইন্টেলের ক্লাসমেট পিসি-২ দেখে এসেছি৷ আসুস ইন্টেলের সেই কমপিউটারগুলোই নিজের নামে বাজারজাত করছে৷ জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতে এই পিসিগুলো বাজারজাত হয়েছে৷ বাংলাদেশে আসুসের পরিবেশক আমাকে এমন একটি পিসি দেখিয়েছেন৷ তারা আমাকে জানিয়েছেন, মাত্র ছাবিশ হাজার টাকায় এমন একটি পিসি ঢাকার বাজারে পাওয়া যাবে৷ ভারতেও এই পিসির দাম ছাব্বিশ হাজার রুপী৷ এই তুলনায় বাংলাদেশে এই ল্যাপটপের দাম অনেক কম৷ আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা যাতে এ ধরনের পিসি কিনতে পারে তার জন্য সরকার সাবসিডি দিতে পারে৷ কৃষককে সারে ভর্তুকি দিতে পারলে, রফতানিতে নগদ সহায়তা দিতে পারলে সরকার কমপিউটারে ভর্তুকি দিতে পারবে না কেন? এনজিওগুলো এই খাতে কাজ করতে পারে৷ কমপিউটার ঋণ সহায়তা বা বিনামূল্যে কমপিউটার বিতরণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হতে পারে৷ এমনকি আসুস বা এমন পিসি নির্মাতাদের সাথে আলোচনা করে বড় অর্ডার দিয়ে এসবের দামও কমিয়ে আনা যায়৷ ইন্টেল যেহেতু এটি বানায় সেহেতু ইন্টেলের কাছ থেকে সরকার কম দামে কিট কিনতে পারে এবং ইন্টেলকে এক্ষেত্রে সাবসিডি দিতে অনুরোধ করতে পারে৷ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করাটাও একটি সহজ উপায় হতে পারে৷ অথচ এসব কোনো বিষয়ে আমাদের সরকার আদৌ কিছু ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না৷

সম্প্রতি একটি কমপিউটার প্রতিষ্ঠান একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে দেখিয়েছে, সরকার যদি বছরে মাত্র ৩০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা মাসে মাত্র পঞ্চাশ টাকা করে ফি দেয় তবে মাত্র পাঁচ বছরে দেশের সব প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ২০টি কমপিউটারের একটি করে কমপিউটার ল্যাব স্থাপিত হতে পারে৷ এই ল্যাবে কমপিউটারের পাশাপাশি নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, ওয়াইফাই ইত্যাদিও দেয়া যাবে৷ আরো মজার বিষয় হলো, ছাত্রছাত্রীরা পঞ্চাশ টাকা করে মাসে দিয়ে তাদের স্কুলের জন্য কমপিউটার খাতে সরকারের যে বিনিয়োগ হবে সেটি সরকারকে তারা ফেরত দিয়ে দিতে পারবে৷

সর্বশেষ আরও একটি কাজের কথা বলতে চাই৷ কেবল কমপিউটার থাকলেই শিক্ষার পরিবর্তন হবে না৷ কমপিউটার ল্যাব গড়ে তুললে শিক্ষার্থীরা কমপিউটার বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারবে৷ এতে তাদের অনুশীলন করার সুযোগ তৈরি হবে৷ কিন্তু আমাদের প্রয়োজনটা আরও বড়৷ আমরা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এমন ব্যবস্থায় যেতে চাই যাতে ছাত্রছাত্রীরা বই না নিয়ে স্কুলে আসবে৷ এজন্য তাদের হাতে কমপিউটার দেয়ার পাশাপাশি বইগুলোকে সফটওয়্যারে রূপান্তর করতে হবে৷ আর বিলম্ব না করে সরকারের উচিত সেই কাজেও হাত দেয়া৷


ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
২০০৮ - আগস্ট সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস