• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > বাধ্যতামূলক কমপিউটার : শিক্ষা কাগজ থেকে বাস্তবে
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৩ - জুলাই
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
শিক্ষাব্যবস্থা
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি ধারা
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
বাধ্যতামূলক কমপিউটার : শিক্ষা কাগজ থেকে বাস্তবে

শুধু নির্বাচন করা যে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন-ইয়াজউদ্দিন সরকারের দায়িত্ব ছিল, সেই সরকার সংবিধানের ফাঁক গলিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে যেভাবে পুরো দুটি বছর দেশ শাসন করে গেল, সেটি যে এক ধরনের খারাপ দৃষ্টান্ত তাতে কারও কোনো সন্দেহ নেই। প্রায় সবাই এ বিষয়ে একমত, সেটি ছিল বেসরকারি মডেলের সামরিক শাসন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে পুরো দুই বছর দেশ শাসন করা ও রাজনীতিকে নতুন ছকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা নিয়ে সরকারি দল তো বটেই, বিরোধী দলও তীব্র সমালোচনা করে থাকে। কিন্তু শুধু খারাপটাই সেই সরকারের চরিত্র ছিল না। আমি স্মরণ করতে পারি, ক্ষমতায় এসেই সরকার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সেই সরকারের কঠোর পদক্ষেপ দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আরও অনেক বিষয় ছিল, যা সেই সরকারের ইতিবাচক কাজ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল। রাজনীতির কুটচক্র যদি সরকারের এজেন্ডাতে না থাকতো তবে সেই সরকারটিকেই হয়তো দেশের অন্যতম সেরা সরকার হিসেবে গণ্য করা হতো।

প্রখ্যাত মাইনাস টু ফর্মুলার উদ্ভাবক সেই সরকারের সব কিছুকেই তুবড়ি বাজিয়ে ফেলে দেয়া সম্ভব নয়- সম্ভবত সেই চেষ্টা করা হয়নি। বিশেষ করে আমি যদি বর্তমান সরকারের শিক্ষানীতির দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাব ২০০৮ সালে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেসব ইস্যুতে সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছিল তার ইতিবাচক বিষয়গুলো সরকারের নীতিমালায় প্রতিফলিত হয়েছে। আমি স্মরণ করতে পারি, সেই সময়ে ড. মনিরুজ্জামান মিঞার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি শিক্ষা বিষয়ে কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা বর্তমান সরকারের শিক্ষানীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। আমি বিশদ আলোচনা না করেও এ কথাটি খুব সহজেই স্মরণ করতে পারি, সেই কমিটিই প্রথম বাধ্যতামূলক কমপিউটার শিক্ষা প্রচলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমার ১০০ নাম্বারের দাবিকে সর্বসম্মতক্রমে ৫০ নাম্বারে এনে কমিটির সব সদস্য একমত হয়েছিলেন, মাধ্যমিক স্তরে সব বিভাগের ছেলেমেয়েদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে কমপিউটার বিষয়টি পাঠ করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতিনিধিসহ কমিটির একজন সদস্যও বাধ্যতামূলক কমপিউটার শিক্ষার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি। আমি আরও কৃতজ্ঞ, বর্তমান সরকার শুধু সেই সিদ্ধান্তের সাথে একমতই থাকেনি বরং সেই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, এরই মাঝে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে আমরা অষ্টম শ্রেণীতেও বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক হিসেবে দেখতে পাব। অন্যদিকে চলতি জুলাই মাস থেকেই একাদশ শ্রেণীতে বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিষয়ের বই লেখা হয়েছে। বই প্রকাশিতও হয়েছে। অন্যদিকে যদিও এবারই নবম ও দশম শ্রেণীতে বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার কথা ছিল, তথাপি সেটি এবার করা সম্ভব হয়নি। আশা করা হচ্ছে, সব কিছু পক্ষে থাকলে ২০১৫ থেকে বিষয়টি নবম ও দশম শ্রেণীতে বাধ্যতামূলকভাবেই পাঠ্য হবে।

বাধ্যতামূলক এই শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত কিছু বিষয় নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।

বিষয়ের নাম ও ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কমপিউটার : প্রসঙ্গত এ কথাটি বলা দরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাধ্যতামূলক কমপিউটার শিক্ষা বিষয়টিকে ‘কমপিউটার শিক্ষা’ না রেখে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ নাম দিয়েছে। সময়ের বিবর্তনে এখন এ পরিবর্তনটি তাদের বিবেচনায় হয়তো অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তবে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি পড়ানোর পাশাপাশি কমপিউটার বিজ্ঞান, কমপিউটার প্রকৌশল, সফটওয়্যার প্রকৌশল ইত্যাদিকে ঘিরে একটি বিষয় নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে আলাদাভাবে রাখা যেত। যেমন করে বাধ্যতামূলক অঙ্ক ছাড়াও উচ্চতর গণিত পাঠ্য হতে পারে, তেমন করে কমপিউটার বিজ্ঞান একটি বিষয় হিসেবে রাখা উচিত ছিল। এমনকি সাধারণ বিজ্ঞান সবার পাঠ্য হিসেবে রাখার পরও পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা ইত্যাদি আলাদাভাবে পড়ানো হয়। আমি মনে করি বিজ্ঞান, বাণিজ্য ইত্যাদির মতো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পড়ার একটি আলাদা ধারাও চালু করা যেতে পারে। এমনকি সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অপশনাল বা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কমপিউটার বিজ্ঞান বাছাই করার ব্যবস্থা থাকলে বিশেষ করে যারা ভবিষ্যতে কমপিউটার বিষয়েই সণাতক বা সণাতকোত্তর স্তরে লেখাপড়া করবে তাদের জন্য সহায়ক হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাধ্যতামূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা বিষয়টিতে কমপিউটার বিজ্ঞানের উচ্চতর এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে যুক্ত করার চেষ্টা নেই। এটি হয়তো সঙ্গতও নয়। বস্ত্তত এটি এখন সাধারণ জ্ঞানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয়টিতে সাধারণভাবে এ বিষয়ের যা জানা দরকার তাদেরকে সেটিই জানতে হবে, সবার বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

পাঠক্রম : জাতীয় পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বিষয়টির জন্য যে পাঠক্রম প্রণয়ন করেছে সেটিকে আমি খুব সহজভাবে নিতে পারছি না। ১৯৯২ সালে যখন নবম-দশম শ্রেণীর জন্য কমপিউটার শিক্ষা বইয়ের পাঠক্রম তৈরি করা হয়, তখন শুধু শিক্ষাবিদদের মন রাখতে গিয়ে তাতে এমনসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা কোনোভাবেই আমরা ইন্ডাস্ট্রি থেকে চাইনি। এ বিষয়টি জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সেই পাঠক্রমের। এখনও দেশে কমপিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক যে শিক্ষা দেয়া হয় তার পাঠক্রম ইন্ডাস্ট্রির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বস্ত্তত শিক্ষার্থীদেরকে তাদের সণাতকোত্তর পর্যায় শেষ করে ইন্ডাস্ট্রিতে এসে নিজেদেরকে যোগ্য করে তুলতে হয়। আমরা বারবারই বলে আসছি, স্কুল পর্যায়ের কমপিউটার শিক্ষা কোনোভাবেই কমপিউটার বিজ্ঞানচর্চা নয়। শিক্ষার্থীরা যাতে কমপিউটারের ব্যবহারকারী হয় এবং এ প্রযুক্তিকে যেনো তারা তাদের জীবনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা করাই মূলত এ পর্যায়ের শিক্ষার লক্ষ্য। আমাদের সেই ধারণাটি পাঠক্রমে প্রতিফলিত হয়নি। কমপিউটার বিজ্ঞান একটি আলাদা বিষয় এবং সেই বিষয়টিকে কমপিউটার বিজ্ঞান হিসেবেই কাউকে কাউকে পড়ানো উচিত। নবম-দশম শ্রেণী থেকে সেই কাজটি করা যেতে পারে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে একে আলাদা বিভাগও করা যেতে পারে। কিন্তু বাধ্যতামূলক কমপিউটার শিক্ষা পড়িয়ে সবাইকে কমপিউটার ব্যবহারকারী বানানো উচিত। আশা করব এনসিটিবি ইন্ডাস্ট্রির সাথে কথা বলে পাঠক্রমকে পুনর্বিন্যাস করবে।

কাগজ থেকে বাস্তবে : একেবারে নিখাদভাবে যদি একথা বলা হয়, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি সব ছাত্রছাত্রীর জন্য পড়ানোর মতো অবকাঠামোগত অবস্থা আছে কি না, তবে খুব সহজেই একথা বলতে হবে, মোটেই নয়। অনেকেই এমন প্রশ্ন করেছেন, এভাবে অবকাঠামো ছাড়া তাড়াহুড়া করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এ বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা কি সমীচীন হয়েছে? কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কমপিউটার বিষয়ের শিক্ষকই নেই। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই কমপিউটার নামের যন্ত্রটিই নেই। যেখানে কমপিউটার যন্ত্র আছে সেখানেও যন্ত্রের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। এমন একটি পরিস্থিতি বাধ্যতামূলক কমপিউটার শিক্ষার সহায়ক নয়। আমিও কমপিউটার পড়ানোর অবকাঠামো গড়ে তোলার পক্ষে। শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বিষয়টি পড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু সব অবকাঠামো তৈরি করে বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে, এই মতের সাথে আমি একমত নই। বিশেষ করে যে ধরনের পাঠক্রম তৈরি করা হয়েছে, তাতে সব অবকাঠামো সম্পূর্ণ প্রস্ত্তত না করেও বিষয়টি পড়ানো শুরু করা যেতে পারে। তবে সরকারের সাড়ে চার বছরে সেই সব অবকাঠামো আরও প্রবলভাবে গড়ে তোলা উচিত ছিল।

মনে হয় বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ যথার্থ এবং সময়োচিত হয়েছে। তবে আমাদের কোনো কাজই আমরা একেবারে নিখুঁতভাবে শুরু করতে পারি না। এমনকি এ কাজটিও ক্রমান্বয়েই করা হয়েছে বলে যেসব সমস্যা রেখে আমরা শুরু করেছিলাম সেগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো এখনও করেনি। এমনকি সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বিষয়টির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

এখানে কয়েকটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি :

০১. কমপিউটার বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি সাধারণ শিক্ষকেরা পড়াতে পারবেন না বলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ক শিক্ষক দ্রুত নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া।

০২. বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রায় চার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপিউটার ল্যাব গড়ে তোলে। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে কাজটি করছিল। কিন্তু নতুন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গড়ে ওঠার পর থেকে কমপিউটার ল্যাব গড়ে তোলা বন্ধ হয়ে যায়। এ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, এসব ল্যাব গড়ে তোলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা ডিজিটাল ক্লাসরুম গড়ে তোলার নামে ল্যাব তৈরির প্রকল্প বন্ধ করে রাখে। এটি প্রবলভাবে ক্ষতিকর একটি ধারণা। দেশে যদি সত্যিকারভাবে বাধ্যতামূলক কমপিউটার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয় তবে কমপিউটার ল্যাব গড়ে তোলার বিকল্প নেই। যেমনি করে সরকার বিজ্ঞান ভবন ও বিজ্ঞানাগার তৈরি করেছে, তেমনি করে কমপিউটার ভবন ও কমপিউটার ল্যাবও তৈরি করে দেয়া উচিত।


ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস