লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
মুক্তচিন্তা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সংশোধন
মুক্তচিমত্মা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সংশোধন
সরকার তার শাসন মেয়াদের শেষ পর্বে এসে সম্প্রতি সংশোধন করেছে বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন। এ সংশোধনী নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এরা মনে করছে, এ আইন মুক্তচিমন্তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তবে সরকার পক্ষ বলছে, এ সংশোধনী নিয়ে ভয়ভীতি বা উদ্বেগ প্রকাশের কোনো কারণ নেই। এ সংশোধনীর পর সবচেয়ে বড় সমালোচনা এসেছে এর ৫৭ নম্বর ধারা নিয়ে। এছাড়া প্রশ্ন উঠেছে- কেনো অতি তাড়াহুড়ো করে অধ্যাদেশ জারি করে এ আইন সংশোধন করার প্রয়োজন পড়ল? আমরা দেখলাম, রাষ্ট্রপতি গত ১৯ সেপ্টেম্বর এক অধ্যাদেশ জারি করে আলোচ্য আইনটি সংশোধন করলেন। অথচ এ রাষ্ট্রপতিই আবার জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবান করলেন ২০ তারিখে? অতএব স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে, এতটা তাড়াহুড়ো করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এ আইন সংশোধনের কী প্রয়োজন পড়ল? অধ্যাদেশ এড়িয়ে কি সংসদে সংশোধনী বিল এনে তা পাস করানো যেত না? সমালোচকেরা বলছেন, নিশ্চয় এর পেছনে লুকিয়ে আছে সরকারের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য, গোপন অভিলাষ। সরকার চায় এর মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বারিত করতে। বিশেষ করে তাদের আপত্তি এই সংশোধিত আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারা নিয়ে। ধারাগুলো দেশের মানুষের মুক্তচিন্তার পথে অমত্মরায় হয়ে থাকবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের উন্নয়নে অন্যান্য খাতের মতো আইসিটি খাতের একটা বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। আইসিটি উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য সূচক। আমরা সবাই চাই, তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। এ কাজটি যেনো সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে, সে প্রয়োজনেই আমরা ২০০৬ সালে পেলাম তথ্যপ্রযুক্তি আইন। এ আইন আমাদের মুক্তচিমত্মা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করবে- নিশ্চয় এমনটি কাম্য হতে পারে না। এমনটি আমাদের সংবিধানও অনুমোদন দেয় না। আমাদের সংবিধানের ৩৯ (১) নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে : ‘চিমত্মা ও বিবেকে স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অতএব এমন আইন করা যাবে না, যা মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। কিন্তু সরকার সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে কার্যত সে কাজটিই করল।
এ আইনের ভয়ঙ্কর দিক হলো, এ আইনে কেউ দোষী সাব্যসত্ম হলে তাকে ৭ থেকে ১৪ বছর জেলে কাটাতে হবে। আগে এ আইনের আওতায় মামলা করতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হতো। এখন আর সে অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। পুলিশ যাকে ইচ্ছে অভিযুক্ত করে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করে তার বিরম্নদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারবে। ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১-এর যেকোনো একটি ধারায় এ ধরনের গ্রেফতার ও মামলা চলতে পারে। এ ধারায় অভিযুক্তদেরকে ৭ থেকে ১৪ বছর জেল খাটার আশঙ্কায় আশঙ্কিত থাকতে হবে। ৫৪ নম্বর ধারাটি কমপিউটার সিস্টেম বিনাশ করার অপরাধ সংক্রামত্ম। ৫৬ ধারাটি কমপিউটার সিস্টেম হ্যাক করা সংক্রামত্ম। ৫৭ নম্বর ধারাটি মিথ্যা, অশস্নীল ও মানহানিকর তথ্য ব্যবহারের অপরাধ সংক্রামত্ম। আর ৬১ নম্বর ধারাটি অন্যের কমপিউটারে প্রবেশের অপরাধ সংক্রামত্ম। মত প্রকাশের পথে সবচেয়ে বেশি অমত্মরায় হয়ে দাঁড়াবে ৫৭ নম্বর ধারাটি। ভিন্নমত দমনে ক্ষমতাসীনদের মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার হবে এ ৫৭ নম্বর ধারা। ফলে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে এ ধারা। এ আইনের আলোকে অপরাধ বলে বিবেচিত যে সংবাদ, তা সংবাদপত্রে ছাপলে প্রচলিত আইনে এর সাজা ৩ বছর। অথচ তা অনলাইনে প্রকাশ করলে সাজা ৭ থেকে ১৪ বছর। কী অবাক করা স্ববিরোধিতা!
সংশোধিত আইনটি একদিকে সংবিধানবিরোধী, অন্যদিকে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় তা বাতিলযোগ্য। কারণ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক দেশে তা হতে পারে না, এটি সংবিধানেরই ঘোষণা। আমরা এর সর্বসাম্প্রতিক এ সংশোধনী বাতিল দাবি করছি।