লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
আবদুল কাদের ভাইকে যেমন দেখেছি
এই তো সেদিন প্রখ্যাত সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তান ভাই চলে গেলেন, মানে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে গেলেন। ঘটনাচক্রে ১৯৯৬ সালে মোস্তান ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। সাপ্তাহিক ‘রাষ্ট্র’ সম্পাদনা ও প্রকাশনা দুই-ই করছিলেন তিনি। আমাকে বললেন তার পত্রিকায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে লেখা দেয়ার জন্য। আমি লেখা শুরু করলাম এবং এভাবেই ধীরে ধীরে তার ও তার পত্রিকার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়লাম। তিনি সব সময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিতে থাকলেন। এরই মধ্যে একদিন মোস্তান ভাইয়ের বাসার বৈঠকখানায় আমি অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য। এমন সময় শ্যামবর্ণের কোট পরিহিত এক ভদ্রলোক কিছু দাওয়াতপত্র হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকলেন। তিনি পরিচয় দিয়ে বললেন তার নাম আবদুল কাদের এবং সেই সাথে কমপিউটার জগৎ-এর সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা বললেন। আবদুল কাদের ভাইয়ের সাথে এভাবেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ এবং পরিচয়। কমপিউটার জগৎ আয়োজিত প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে মোস্তান ভাইকে দাওয়াত দেয়ার জন্য তিনি এসেছিলেন। আমাকেও তিনি দাওয়াত দিয়ে গেলেন এবং জগৎ-এ লেখার অনুরোধ করলেন। সত্যি বলতে কি, কাদের ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। কারণ, আমি আগেই তার নাম জানতাম এবং প্রায় নিয়মিতভাবে কমপিউটার জগৎ পড়তাম বলে তার নামটা সবসময় স্মৃতিতে জাগরূক ছিল। মোস্তান ভাইয়ের একটি উক্তি আজও আমার কানে অনুরণন হয়ে বাজে। তিনি একজন রুশ দার্শনিকের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘প্রতিভা হচ্ছে মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সামাজিকীকরণ’। এ কথার বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই আবদুল কাদের ভাইয়ের জীবনে। মোস্তান ভাইও এ দর্শন অাঁকড়ে ধরে এগিয়েছিলেন, কিন্তু রূঢ় বাস্তবতার কারণে বেশিদূর এগুতে পারেননি। তবে সাংবাদিক হিসেবে তিনি বেশ সফল হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বেশ সফলতা দেখিয়েছেন আবদুল কাদের ভাই, যিনি অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে তার প্রতিভাকে বিকশিত করতে পেরেছেন।
কয়েক মাস পর সাপ্তাহিক রাষ্ট্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি একদিন আজিমপুরে কমপিউটার জগৎ অফিসে যাই এবং নাজমা কাদের ভাবি ও অনুসহ অনেকের সাথে দেখা করি। আবদুল কাদের ভাই তখন অফিসে ছিলেন না। আজও মনে পড়ে সেদিন ভাবি আমাকে অনেক সমাদর করে জগৎ-এর দুটো বার্ষিক অ্যালবাম উপহার দিয়েছিলেন। আমাকে আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, আপনি জগৎ পরিবারের সদস্য হয়ে যান। এরপর জগৎ-এর জন্য লেখা শুরু করলাম এবং ক্রমান্বয়ে জগৎ পরিবারের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। আবদুল কাদের ভাই আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ এবং নির্দেশনা দিতেন।
তিনি আমাকে নিবন্ধকার থেকে রিপোর্টারের পর্যায়ে উত্তরণ ঘটিয়ে ছিলেন। দেশী ও আন্তর্জাতিক মেলা, দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ বা নীতি-নির্ধারকদের সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, তার খবরাখবর রাখতেন এবং নিজেকে সবসময় আপডেটেড রাখতেন। কমপিউটার জগৎ-এর সম্পাদনার কাজটি বেশ নিপুণভাবে করতেন। আমাদেরকে লেখা ভাগ করে দিতেন। উৎস তিনি নিজেই সংগ্রহ করতেন।
মূলত আবদুল কাদের ভাই কমপিউটার জগৎকে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের অন্যতম সেরা উপাদান হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। এ প্রযুক্তিকে সারাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। উল্লেখ্য, মোস্তান ভাইসহ তিনি প্রথম যে সংখ্যাটি বের করেছিলেন, তাতে প্রচ্ছদ ছিল ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’। সেটি ১৯৯১ সালের মে মাসের কথা। তিনি এ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সর্বোপরি, দেশের তরুণ মেধাবীদের খুঁজে বের করার জন্য নিয়মিত প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। এতে বেশ ক’জন তরুণকে তিনি জাতির সামনে হাজির করেছিলেন, যারা আজ বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত। তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল সম্ভাবনার কথা দেশের নীতি-নির্ধারকদের বিভিন্নভাবে বুঝাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি শুধু প্রিন্ট মিডিয়া নিয়েই সন্তষ্ট ছিলেন না বরং একে সম্প্রসারণ করে অন্যান্য গণমাধ্যমে সম্প্রসারিত করেছিলেন। এমনকি তিনি আমাকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি জানতেন কাকে দিয়ে কোন কাজটি করালে ভালো ফল পাওয়া যাবে। অর্থাৎ তিনি আমাদের সবার সফল দিকগুলো জানতেন এবং সে অনুযায়ী কাজ ভাগ করে দিতেন। তিনি ২০০০ সালে ‘মিলেনিয়াম বাগ’ নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশে অদ্যাবধি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার কতিপয় অংশ আবদুল কাদের ভাইয়ের প্রাপ্য বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। এ ব্যাপারে একটি কথা উল্লেখ না করলে কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর তা হলো নাজমা কাদের ভাবির বিশাল অবদানের কথা, যিনি এ প্রতিষ্ঠানে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন, যা আজও অব্যাহত আছে। আর্থিকভাবে বুনিয়াদ গড়ার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান রয়েছে।
আবদুল কাদের ভাই ও মোস্তান ভাইয়ের মতো উদ্যোগী মানুষের বেশ অভাব রয়েছে। এত তাড়াতাড়ি আবদুল কাদের ভাই চলে যাবেন ভাবিনি। আমি যখন অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দেই ২০০২ সালে, তখন তিনি বেশ অসুস্থ। মারণব্যাধি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। ২০০৩ সালের ৩ জুলাই যখন তিনি মারা যান, তখন খবরটা শুনে ঠিক থাকতে পারিনি। কারণ, আমার তখন ধারণা ছিল না তিনি মারণব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। পরে এ ব্যাপারে জানতে পারি স্বপন ভাইয়ের কাছে। একটি বিষয় না বললেই নয়, আবদুল কাদের ভাই ছিলেন একজন স্বল্পভাষী, বিনয়ী এবং গোছানো মানুষ। তিনি এতই সুসংগঠিত ছিলেন, মৃত্যুকালে তিনি পরে যে কাজগুলো সমাধা করতে হবে তার বিবরণও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বিশাল এক তালিকা, যা দেখে আমি বিস্ময়বোধ করেছি। এতে বোঝা যায়, কতদূর দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। সবকিছু সুচারুরূপে সম্পন্ন করা তার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল।
পরিশেষে বলব, সরকার যদি আবদুল কাদের ভাইয়ের অবদানকে পর্যালোচনা করে এবং স্বীকৃতি দেয়, তাহলে এটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে তথ্যপ্রযুক্তি প্রাঙ্গণে আজ যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে। গুণীজনের সম্মাননা আমরা কি আশা করতে পারি না?