লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মইন উদ্দীন মাহমুদ
মোট লেখা:২৭
লেখা সম্পর্কিত
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির আন্দোলন এবং অধ্যাপক আবদুল কাদের
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গনে যে ক’জন ব্যক্তি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদের। আবদুল কাদের প্রযুক্তিবিদ বা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসায়ী না হয়েও বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারে অনন্য অবদান ছিল তার। অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদের স্কুলজীবন থেকেই ছিলেন প্রচ-ভাবে প্রযুক্তিপ্রেমী। স্কুলজীবনেই তিনি ‘টরেটক্কা’ নামে একটি মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। অধ্যাপক আবদুল কাদের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও কমপিউটারের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ১৯৮৯ সালে আজিমপুর চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে কমপিউটার লাইন নামের একটি কমপিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার পর থেকেই তিনি বাংলায় কমপিউটারবিষয়ক ম্যাগাজিন প্রকাশনার চিমত্মাভাবনা শুরু করেন। কেননা, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, কমপিউটার হতে পারে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার। সে জন্য প্রথমে দরকার কমপিউটার-ভীতি দূর করা এবং কমপিউটার-প্রশিক্ষেত জনবল তৈরি করা। সে উপলব্ধিতে আবদুল কাদের তার পত্রিকা কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম প্রকাশনা শুরু করেন ১৯৯১ সালের মে মাসে ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ সেস্নাগান নিয়ে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ অধ্যাপক আবদুল কাদের ২০০৩ সালের ৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন।
আজকের তরুণ প্রজন্মের ধারণা
বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে। আজকের বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মূলত এরপর থেকেই বাংলাদেশে সৃষ্টি হয় তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উদ্যামতা ও কর্মচাঞ্চল্যতা।
অবশ্য এর আগে জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে যখন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেন এ দেশের অর্থনীতির মুক্তির অন্যতম এক চাবিকাঠি হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি। তাই তিনি প্রযুক্তিপণ্যের ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করেন। শুধু তাই নয়, তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল তৈরি করার জন্য প্রতি বছর দেশে দশ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করেন। এসব কারণে দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা প্রযুক্তিবান্ধব প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু এর আগে দেশের আইসিটির অঙ্গনে চিত্র কখনও এমন ছিল না। দেশের আইসিটি অঙ্গনের অবস্থার উত্তরণ কীভাবে হলো, কোন অবস্থা থেকে এ অবস্থার উত্তরণ তা আমাদের তরুণ প্রজন্মের যেমন জানা উচিত, তেমনই আমাদেরও উচিত তাদেরকে জানানো। কেননা, প্রকৃত ইতিহাস জানা না থাকলে কখনই কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া যায় না। প্রকৃত ইতিহাসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান পাথেয় বা দিশারি।
জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি
১৯৯৬ সালের আগে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির সার্বিক অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন কমপিউটার সম্পর্কে এ দেশের মানুষের তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না, ছিল নেতিবাচক ধারণা। তখন দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে প্রায় সবাই মনে করতো দেশে কমপিউটারের ব্যাপক ব্যবহার হলে দেশে শুধু যে বেকারত্বের হার অনেক বেড়েই যাবে তা নয় বরং অনেকের চাকরিচ্যুতিও হতে পারে কমপিউটার জ্ঞান না থাকার কারণে। সে সময় হাতেগোনা কয়েকটি কমপিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকলেও তা ছিল শুধু উচ্চবিত্ত শ্রেণীর নাগালে। সরকারি মন্ত্রী-আমলাদের কমপিউটার সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণা না থাকলেও ছিল প্রচ- ভীতি। আর এ কারণেই বাংলাদেশের পাশ দিয়ে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের লাইন যাওয়ার সময় প্রায় বিনে পয়সায় ফাইবার অপটিক সংযোগের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় দেশের গোপন তথ্য পাচার হয়ে যাওয়ার ভয়ে বা অজুহাতে। সে সময় কোনো এক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও কমপিউটারকে ‘শয়তানের বাক্স’ বলে অভিহিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
শুধু তাই নয়, কমপিউটারকে গণ্য করা হতো বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে। আর এ কারণে বাজেটে কমপিউটার ও কমপিউটারসংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপর শুল্ক এবং করও ছিল অনেক বেশি। এ সময় আইসিটিসংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়ী সংগঠন বলতে ছিল শুধু বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি, যার সদস্য সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকজন এবং বেসিসসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সংগঠনগুলোর জন্মই হয়নি তখন। সুতরাং কমপিউটার ও কমপিউটারসংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপর থেকে আরোপ শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করানোর জন্য যৌক্তিক দাবিগুলো জোরালোভাবে জানানোর জন্য কমপিউটার জগৎ ছাড়া তখন কেউই ছিল না বলা যায়। কেননা, সে সময় তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে দৈনিক পত্রিকাগুলোর মনোভাবও ছিল বেশ নেতিবাচক। এ ছাড়া বাংলায় কমপিউটারবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কনটেন্টের অভাব। কমপিউটারবিষয়ক হাতেগোনা কিছু ইংরেজি পত্রিকা এ দেশে পাওয়া গেলেও তা বাংলায় রূপান্তর করার মতো লোক ছিল না বলা যায়।
আবদুল কাদেরের দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত
কমপিউটার লাইন চালু করার পর থেকেই তিনি বাংলায় কমপিউটারবিষয়ক ম্যাগাজিন প্রকাশনার চিমত্মাভাবনা শুরু করেন। এ ব্যাপারে আইসিটিসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন, কিন্তু তারা কেউই তাকে আইসিটিবিষয়ক বাংলায় মাসিক পত্রিকা প্রকাশনার ব্যাপারে সাহস বা উৎসাহ দেননি। শুধু তাই নয়, তখন কেউ কেউ তাকে সাহস বা উৎসাহ দিতে না পারলেও নেতিবাচক মন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি বাংলায় কমপিউটারবিষয়ক ম্যাগাজিন প্রকাশনার কাজে হাত দেয়াকে অতিসাহসী বা পাগলামো উদ্যোগ হিসেবে মন্তব্য করেন অনেকেই। কেউ কেউ তো চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, এ পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে তিন থেকে চার সংখ্যার বেশি প্রকাশিত হবে না। কেননা, সে সময় এ দেশের জনসাধারণ থেকে শুরু করে সরকারি নীতি-নির্ধারণী মহলে অনেকেই মনে করতেন, দেশে কমপিউটারের ব্যাপক বিস্তার ঘটলে বেকারত্বের হার শুধু বাড়বেই না বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেকের চাকরিচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
কমপিউটার যে দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার হতে পারে, সে উপলব্ধিতে আবদুল কাদের তার পত্রিকা কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম প্রকাশনা শুরু করেন। এখন সরকার ঘোষিত যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, এটি মূলত কমপিউটার জগৎ-এর মূল সেস্নাগান বা দাবি ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’-এর ধারাবাহিক ফসল বা বলা যেতে পারে আধুনিক সংস্করণ মাত্র।
আবদুল কাদের শুধু পত্রিকা প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি কমপিউটার সম্পর্কে সর্বসাধারণের মনে ভীতি দূর করতে ও সবার কাছে পরিচিত করতে কমপিউটারকে নিয়ে গেছেন বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে।
যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলন শুরু
যেহেতু আবদুল কাদের কমপিউটার বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কমপিউটারের চলমান প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা রাখতেন, তাই কমপিউটার জগৎ-এর প্রকাশনার শুরু থেকেই এমন সব বিষয়ে লেখার পরিকল্পনা করেন, যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায় এবং কমপিউটার সম্পর্কে জনমনে ভীতি দূর হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে আন্দোলনের রূপ নেয়। এ দেশের জনগণের হাতে কমপিউটার তুলে দেয়ার দাবি জানিয়ে ১৯৯১ সালের ১ মে ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ সেস্নাগানধর্মী প্রচ্ছদ প্রতিবেদন দিয়ে শুরু করেন কমপিউটার জগৎ-এর যাত্রা। এ সময় কমপিউটার এবং কমপিউটারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পণ্যের ওপর ছিল ব্যাপক কর। কমপিউটারের ব্যাপক প্রসার করতে চাইলে এই হারে করারোপ অবশ্য প্রত্যাহার করা উচিত। এ উপলব্ধিতেই ১৯৯১ সালের জুন মাসে ‘বর্ধিত ট্যাক্স নয়, জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপায় কমপিউটার জগৎ। এতে বলা হয়, কমপিউটার হতে পারে বেকারত্ব দূর করার চাবিকাঠি ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির চালিকাশক্তি। এ জন্য দরকার স্বল্পমেয়াদি কিছু সহজ বিষয়ে কমপিউটার জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ। ডাটা এন্ট্রি ছিল এমনই এক ক্ষেত্র, যা ১৯৯০-৯১ থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এ বিষয়ে অক্টোবর ১৯৯১ সালে ‘ডাটা এন্ট্রি : অফুরন্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ’ শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপিয়েই ক্ষান্ত হননি অধ্যাপক আবদুল কাদের, এ নিয়ে কিছু সভা-সেমিনারও করেছেন।
লেখক তৈরির উৎস
শুরু থেকেই আমি কমপিউটার লাইনের পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলাম। পাশাপাশি কমপিউটার জগৎ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকেই এর সার্বিক কর্মকা--র সাথেও জড়িত ছিলাম আজো এর সাথে জড়িত আছি এর সহযোগী সম্পাদক হিসেবে।
সেই সূত্রেই জেনেছি, আইটিবিষয়ক লেখক সৃষ্টি ও নতুন নতুন আইটি ম্যাগাজিনের প্রেরণার উৎসও ছিলেন আবদুল কাদের। কমপিউটার জগৎ পত্রিকা প্রকাশের সম্ভবত মাস দুয়েক আগে অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদের তার এক ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. ভূঁইয়া ইকবালের ছোটভাই ভূঁইয়া ইনাম লেলিনকে কমপিউটার জগৎ-এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেন। যিনি পরবর্তী সময়ে ‘কমপিউটার বিচিত্রা’ নামে আরেকটি কমপিউটারবিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন সম্ভবত ১৯৯৫ সালে। কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার কয়েক মাস পর কমপিউটার লাইনের ছাত্র মো: তারেকুল মোমেন চৌধুরী সহকারী সম্পাদক হিসেবে কমপিউটার জগৎ-এ যোগ দেন। পরে তিনি ‘কমপিউটার ভুবন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ সালে। ১৯৯২ সালে বুয়েটের ছাত্র জাকারিয়া স্বপন কমপিউটার জগৎ-এ সহযোগী সম্পাদক হন। তিনিও বছর দুয়েক পরে ‘কমপিউটিং’ নামে পত্রিকার সাথে যুক্ত হন নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদেরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশীর ছেলে ইকো আজহার ঢাকা ভার্সিটির কমপিউটার সায়েন্সের ছাত্রাবস্থায় কমপিউটার জগৎ-এ লেখালেখি শুরু করেন। পরে এই পত্রিকার প্রথমে সহযোগী ও পরে কারিগরি সম্পাদক হন। এরপর তিনি ইত্তেফাক পত্রিকার কমপিউটারের পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। গোলাম নবী জুয়েল ১৯৯২ থেকে কমপিউটার জগৎ-এ লেখালেখি শুরু করেন এবং ডিসেম্বর মাসে কমপিউটার জগৎ-এর লেখক সম্পাদক হিসেবে উন্নীত হন। গোলাম নবী জুয়েল পরে কমপিউটার বিচিত্রার সাথে সম্পৃক্ত হন এবং সেখানে নিয়মিতভাবে লেখালেখি শুরু করেন। এভাবে শামীমু্জ্জামান প্রমি, মোস্তাফা স্বপন, হাসান শহীদ, শামীম আখতার তুষার, ফাহিম হুসাইন, ইথার হান্নান, জেসান রহমান, ওমর আল জাবির মিশো, আবু সাঈদ, শোয়েব হাসান, নাদিম আহমেদ, জিয়াউস শামছ এমনি একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের কমপিউটার বিষয়ে লেখালেখির হাতেখড়ি অধ্যাপক আবদুল কাদেরের কাছে। তেমনি বেশ কিছু কমপিউটারবিষয়ক পত্রিকার পরোক্ষভাবে প্রেরণার উৎসাহ ছিলেন অধ্যাপক আবদুল কাদের। সুতরাং বলা যেতে পারে, অধ্যাপক আবদুল কাদেরের তথা কমপিউটার জগৎ-এর অন্যতম একটি সাফল্যের দিক হলো আইটিসংশ্লিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখা।
মরহুম আবদুল কাদের যেমনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তেমনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে বা দাবি আকারে উপস্থাপন করতে তিনি নিজে না লিখে দেশের বিখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্টদের দিয়ে কমপিউটার জগৎ-এ লিখিয়েছেন। সেজন্য তিনি এসব প্রখ্যাত সাংবাদিককে প্রয়োজনীয় রসদ বা তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় গাইডলাইন দিতেন। এজন্য আবদুল কাদেরকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে এবং জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিকদের দিয়ে নিয়মিতভাবে কমপিউটার জগৎ-এ লিখিয়েছেন যাতে সব মহলে দাবিগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায়। কমপিউটার জগৎ-এ নিয়মিতভাবে আইটিবিষয়ক লেখালেখি করে অনেকে রীতিমতো আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। এসব বিখ্যাত সাংবাদিকের মাঝে অন্যতম হলেন নাজিম উদ্দিন মোস্তান, আবীর হাসান, আজম মাহমুদ, কামাল আরসালান, তাজুল ইসলাম, গোলাপ মুনীর প্রমুখ। উল্লেখ্য, গোলাপ মুনীর তার জীবদ্দশা থেকে আজ পর্যন্ত এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
পাঠক সৃষ্টিতে অধ্যাপক আবদুল কাদের
অধ্যাপক আবদুল কাদের কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার শুরু থেকে পরিকল্পনা করেন কমপিউটারের সুফল জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। সেজন্য কমপিউটার প্রযুক্তি প্রোগ্রামগুলোর ওপর বাংলা ভাষায় সহজবোধ্য করে কিছু বই প্রকাশ করতে হবে। কমপিউটার প্রযুক্তিবিষয়ক বাংলা বই প্রকাশ সে সময় ছিল আরেক দুঃসাহসিক কাজ। এমনকি তা কল্পনা করাও ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। আবদুল কাদের সাহসিকতার সাথে ৮টি বিষয়ে বাংলায় বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সেগুলো ছিল ডস, ওয়ার্ডস্টার, লোটাস, ডিবেজ, উইন্ডোজ, ওয়ার্ড পারফেক্ট, ট্রাবলশুটিং ও ডিটিপি। তিনি এই বইগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বাইরে বিক্রি না করে কমপিউটার জগৎ-এর গ্রাহকদের ফ্রি দিতেন। এই বইগুলো প্রকাশের পরপর তিনি পত্রিকায় এক ঘোষণা দেন, যা নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে কমপিউটার জগৎ-এ প্রকাশিত হতো। কেউ এ পত্রিকার এক বছরের গ্রাহক হলে পছন্দমতো বিনামূল্যে যেকোনো দুটি বই ফ্রি পাবেন। এই গ্রাহক যদি অপর কাউকে গ্রাহক করেন, তাহলে তিনি আরও দুটি বই ফ্রি পাবেন এবং নতুন গ্রাহকও অনুরূপভাবে তার পছন্দমতো দুটি বই ফ্রি পাবেন। এভাবে রাতারাতি কমপিউটার জগৎ-এর গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়, যা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। বলতে বাধা নেই- আমি , ভূঁইয়া ইনাম লেলিন ও তারেকুল মোমেন চৌধুরী প্রবলভাবে মরহুম আবদুল কাদেরের এ কার্যক্রমের বিরোধী ছিলাম। আমরা তিনজনই এমন কার্যক্রমকে নিছকই পাগলামো মনে করতাম। কেননা, সে সময় কমপিউটার জগৎ-এর আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেকগুণে বেড়ে গিয়েছিল। তিনি শুধু আমাদের বলতেন, ‘প্রথমে জাতিকে সেবা দাও, সব সময় ব্যবসায় করতে চেয়ো না’। তিনি মনে করতেন- পাঠক বাড়লে কমপিউটারের ব্যাপারে জনসচেতনতা যেমন বাড়বে, তেমনি এ সংশিলষ্ট যৌক্তিক দাবিগুলোর প্রতি জনসমর্থনও বাড়বে, যা প্রযুক্তি আন্দোলনকে বেগবান করবে। সুতরাং বলা যায়, মরহুম আবদুল কাদের দেশে কমপিউটারবিষয়ক পাঠক বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা পরবর্তী পর্যায়ে নতুন নতুন পাঠক সৃষ্টি বা সূচনা করতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে।
অনন্য কিছু অবদান
এ শিল্প সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি একাধিক সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, আয়োজন করেছেন বিভিন্ন ক্যুইজ প্রতিযোগিতা, গুণী ও মেধাবীদের সম্মানিত করে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, কমপিউটারকে সর্বসাধারণের মধ্যে পরিচিত করার লক্ষ্যে তিনি ঢাকার জিঞ্জিরায়, কুমিলস্নার মুরাদনগর ও ভোলায় কমপিউটার নিয়ে যান। দেশের তরুণ মেধাবীদের উৎসাহিত করতে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইন্টারনেট সপ্তাহ ও কমপিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে যেমন- ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ওপর একাধিক সংবাদ সম্মেলন, মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রসারের জন্য সর্বপ্রথম জোরালো দাবি তুলে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছেন- ‘স্ট্যাটাস সিম্বল নয়, চাই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর হাতে মোবাইল ফোন’, যা সে সময় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এভাবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের দাবি, ণ২ক সমস্যা, ইউরোমানি কনভার্সন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু জাতির সামনে তুলে ধরেন।
সর্বস্তরে কমপিউটারে বাংলা প্রয়োগ, বিজ্ঞানসম্মত বাংলা কিবোর্ড ইত্যাদি বিষয় কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার শুরুর বছরেই জাতির সামনে তুলে ধরেন অধ্যাপক আবদুল কাদের।
প্রগতিমনা, বিজ্ঞানমনস্ক আবদুল কাদেরের মনন ও মস্তিষ্কের অনুরণনে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন তথ্য ও তথ্যাবলী প্রতিনিয়ত প্রবহমান ছিল। তিনি চিমত্মা করতেন কী করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন করা যায়। কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকার সাথে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন চাকাকে সমানতালে চালানো যায়। কীভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে আমাদের মধ্যে পুরনো ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও উন্নয়নমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর করা যায়। তিনি সব সময় বলতেন, আমাদের অদক্ষ জনশক্তিকে যথাযথ আইটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। দেশের আইটির মেধার সুষ্ঠু লালন ও পরিচর্যার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। আইটি খাতকে থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা এবং কমপিউটার সামগ্রীর ওপর থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্স পুরোপুরি প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে তিনি নিজের উদ্যোগে যোগাযোগ করতেন। এ ক্ষেত্রে আবদুল কাদেরের অবদান আইটি শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের চেয়েও বেশি ছিল- এ কথা অনেকেই স্বীকার করবেন তা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। তবে আগামী প্রজন্মকে তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের মধ্যে মরহুম আবদুল কাদেরের অবদানকে তুলে ধরতে হবে। সেই সাথে প্রয়োজন তাকে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে তার অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া। এতে করে আগামী প্রজন্ম এ ধরনের আন্দোলনে উৎসাহিত হবে
ফিডব্যাক : mahmood_sw@yahoo.com