লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
এক দশকে ইউটিউব
২০০৫-এর এপ্রিলের এমনই এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জাবেদ করীম যুক্তরাষ্ট্রের স্যান দিয়াগো চিড়িয়াখানায় একপাল হাতির সামনে ১৮ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। পরে নিজেদের তৈরি ‘ইউটিউব’ নামের নাম-না-জানা নতুন এক ভিডিও দেখার ওয়েবসাইটে পরীক্ষামূলক প্রথম ভিডিও হিসেবে আপলোড করেন এটি। এরপর পেরিয়ে গেছে এক দশক। শুধু লেখা-ছবির সাদামাটা রূপ থেকে বেরিয়ে এসে ওয়েবসাইট এখন মাল্টিমিডিয়ার চমৎকার উপস্থাপনায় পরিণত হয়েছে। ইউটিউবের ব্যবহার এখন নিত্যদিনের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও দেখার ওয়েবসাইটে পরিণত তো হয়েছেই, একশ’ কোটি মানুষের প্রতি মিনিটে আপলোড হওয়া তিনশ’ ঘণ্টার হাসি-কান্নার চিত্র পৌঁছে দিচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রামেত্ম। ইউটিউব ট্রেন্ড ব্লগে দশক পূর্তি উপলক্ষে মাসব্যাপী উদযাপনের ঘোষণা দেয় ইউটিউব কর্তৃপক্ষ। তিন সহপ্রতিষ্ঠাতার ছোট্ট সেই উদ্যোগ গত এক দশকে কীভাবে আজকের টেক-জায়ান্টে পরিণত হলো তা-ই ফিরে দেখা এই লেখার উদ্দেশ্য।
২০০৫
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-বে ২০০২ সালে অনলাইনে অর্থ লেনদেনের ওয়েবসাইট পেপাল কিনে নিলে পেপালের তিন কর্মী চ্যাড হার্লি, স্টিভ চেন ও জাবেদ করীমের নতুন কিছু তৈরি করার পরিকল্পনা থেকেই ইউটিউবের শুরু। সে সময় তাদের সবার পকেটেই বেশ কাঁচা অর্থ ছিল। শুরুর দিকের ঘটনা কিছুটা অস্পষ্ট, তবে ২০০৫-এর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ইউটিউবের ডোমেইন নিবন্ধন করা হয়। এপ্রিলের ২৩ তারিখে জাবেদ করীম প্রথম ভিডিও আপলোড করেন এবং পরের মাসে ওয়েবসাইটটির পরীক্ষামূলক সংস্করণ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একই বছর নভেম্বরে ৩৫ লাখ ডলারের বিনিয়োগ পেলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে।
শুরুর সেই বছরেই ইউটিউবের একটি ভিডিও বিজ্ঞাপন দশ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়। বিজ্ঞাপনটিতে ব্রাজিলের ফুটবল খেলোয়াড় রোনালদিনহোর গোল্ডেন বুট নেয়ার দৃশ্য ছিল।
২০০৬
প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাঝেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যায় ইউটিউব, দ্রুত উন্নয়নশীল ওয়েবসাইটগুলোর তালিকায় দখল করে নেয় নিজের জায়গা। জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় ৬৫ হাজার নতুন ভিডিও আপলোড হতে থাকে, যা প্রতিদিন ১০ কোটি বার দেখা হয়।
ফেব্রুয়ারিতে সম্প্রচার সংস্থা এনবিসির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। চিরাচরিত সম্প্রচার ব্যবস্থার ডিজিটাল যুগে প্রবেশের সেই শুরু। আজ তা কোথায় তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
দ্রুত বর্ধনশীল প্রতিষ্ঠানটির ওপর নজর পড়ে গুগলের। গত অক্টোবরের ৯ তারিখে ১৬৫ কোটি ডলারে ইউটিউব কিনে নেয়ার ঘোষণা আসে তাদের পক্ষ থেকে। সে সময়ে মাত্র ৬৭ জন কর্মী ছিলেন ইউটিউবে। গুগলের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সিদ্ধামেত্ম ইউটিউব নিজ নামে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে থাকে।
২০০৭
শখের বসে তৈরি ভিডিও থেকেও যে আয় করা সম্ভব, ২০০৭ সালে তাই শিখিয়েছে ইউটিউব। সে সময় অনেকেই তাদের চাকরি ছেড়ে ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করা শুরু করেন। অনেকে সফলও হন।
জুলাইয়ে সিএনএনের সাথে যৌথভাবে প্রথমবারের মতো ২০০৮ সালের মার্কিন নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের আয়োজন করে ইউটিউব। সেখানে মার্কিন নাগরিকেরা ভিডিও বার্তায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের প্রশ্ন পাঠিয়েছিল। আর এভাবেই নাগরিক সাংবাদিকতার মাধ্যমে পরিণত হয় ইউটিউব।
‘চার্লি বিট মাই ফিঙ্গার অ্যাগেইন’ নামে দুটি শিশুর ৫৬ সেকেন্ডের ভিডিও ইউটিউবের মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত ভিডিওটি ৮২ কোটির বেশিবার দেখা হয়েছে।
২০০৮
নভেম্বরে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং টিভি অনুষ্ঠানমালা প্রচারের জন্য বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় ইউটিউব। এর আগে ১০ মিনিটের বেশি দীর্ঘ ভিডিও আপলোড করার সুযোগ ছিল না। প্রস্থে ৪৮০ পিক্সেল ভিডিও আপলোড করার সুযোগ চালু হয় এই বছরেই।
২০০৯
ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অবদানের জন্য পিবডি অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয় ইউটিউবকে।
এপ্রিলে ইউটিউবের মাধ্যমেই জাস্টিন বিবারকে সারা বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আমেরিকান সংগীতশিল্পী ইউশার।
পাইরেসি এবং স্বত্ব নিয়ে নানা ঝামেলার জন্য সংগীতজ্ঞেরা ইউটিউব পছন্দ করতেন না। ভেভোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে অফিশিয়ালি প্রচার শুরু করা হয়।
২০১০
বিনামূল্যে সরাসরি ভিডিও সম্প্রচারের সুযোগ করে দেয়া হয় মার্চে। আইপিএলের ৬০টি ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ইউটিউবে। পছন্দ হওয়া বা না হওয়ার ওপর ভিত্তি করে থাম্ব আপ/ডাউন এবং ফোরকে ভিডিও প্রযুক্তি যোগ করা হয়।
২০১১
আরব বসমেত্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইউটিউব। বিক্ষোভকারীদের নানা ভিডিও ওয়েবে ছড়িয়ে পড়ে জনমত গঠন এবং আন্দোলন সুসংগঠিত করতে সাহায্য করে। শুধু ইউটিউবের জন্য, যা অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া যাবে না- এমন ভিডিও তৈরির জন্য গুগল ১০ কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার খরচ করে।
২০১২
এনবিসির সাথে যৌথভাবে ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক সরাসরি সম্প্রচার করে ইউটিউব। যেকোনো ডিভাইস থেকে প্রথমবারের মতো মানুষ অলিম্পিক অনুষ্ঠান সরাসরি দেখতে পায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্পী সাইয়ের ‘গ্যাংনাম’ স্টাইল গানটির কথা সবারই জানা। ইউটিউবে সবচেয়ে বেশিবার দেখা ভিডিও এটি। এই ভিডিওটি প্রথম ১০০ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করে।
‘ইউটিউব ইলেকশন হাব’ নামে চ্যানেল চালু করা হয়, যেখানে সে বছর মার্কিন নির্বাচন সংক্রান্ত সব খবর প্রচার করা শুরু করে।
২০১৩
মার্চে মাসিক অনন্য ভিজিটরের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। এরপর ইউটিউব মানুষের জীবনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যায়। যেকোনো ধরনের প্রচারে প্রথম পছন্দ হিসেবে ইউটিউবকে বেছে নিচ্ছে সবাই। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্য কিংবা বড় ক্রীড়ানুষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ধারণ করা ভিডিও বার্তা প্রতিদিন পৌঁছে দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের কাছে।
২০১৩ সালের পরের ঘটনাগুলোর রেশ আমাদের চোখ থেকে এখনও মুছে যায়নি। এক দশকের বর্ণাঢ্য ইতিহাসে উল্লেখ করার মতোও অবশ্য কিছু নেই এই সময়টাতে। ইউটিউব এর পরে অনেকটাই পরিণত অবস্থায় চলে এসেছে। প্লাটফর্মটির উন্নয়ন তো চলছেই, তবে সমাজে কী প্রভাব ফেলছে তাই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। ইউটিউবের মাধ্যমে এমন অনেক কিছু প্রচার হয়েছে, যা হয়তো প্রচার হওয়া উচিত ছিল না।
২০১৪
২০১৪ সালে এসে ইউটিউবের এই দিকটা মানুষের চোখে পড়ে। ইউটিউবের একেকটা ভিডিও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমগুলোর সংবাদে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণ, তার প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক, তার ব্যাপারে নানা খবর প্রচারিত হলেও ওই বছরে ওবামা বিশেষভাবে ইউটিউবের জন্য তৈরি সাক্ষাৎকারে অংশ নিয়েছেন। এক দশক কম সময় নয়, অন্যদিক থেকে দেখলে খুব বেশিও কিন্তু নয়। অথচ এই সময়টাতে অনলাইন একটি প্লাটফর্ম কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটিকে জনগণের মুখোমুখি বসিয়ে দিয়েছে সেটাই আশ্চর্যের