লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
লগারিদম
লগারিদম। গণিতের এক মজার জগৎ। আমাদের স্কুল-কলেজে গণিত বিষয়ে এই লগারিদম পড়ানো হয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ছাত্রদের এই লগারিদম অবশ্যই পড়তে হয়। গণিতের বাইরে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার নানা গাণিতিক হিসাব-নিকাশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই লগারিদমের সাহায্য নেয়। বিজ্ঞান বিষয়ের ব্যবহারিক ক্লাসে ও গাণিতিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে এই লগারিদম ব্যবহার করা হয়। বড় বড় সংখ্যার গুণ ও ভাগ খুবই জটিল, লগারিদমের সাহায্য নিলে তা সহজে সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই লগারিদম বিষয়টি সম্পর্কে ছাত্রদের বাস্তব ধারণা খুবই কম। ফলে লগারিদম সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা না নিয়েই শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়ে। তবে বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে বিজ্ঞান জানতে হবে, অতি জ্ঞানীগুণী হতে হবে- এমন কোনো কথা নেই। সামান্য লেখাপড়া জানা মানুষও আগ্রহী হলে বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারবে এবং তা ব্যবহার করে গাণিতিক কাজ সহজে নিজে নিজেই করতে পারবে। এ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সবার জানা-বোঝার মতো সহজ করে লগারিদমের একটি সাধারণ পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস পাব এ লেখায়। তবে এর ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ স্থানাভাবে এখানে নেই। শুধু লগারিদম সম্পর্কে একটি সাধারণ পরিচিতিই এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
আমরা অভিজ্ঞতায় জেনেছি- কোনো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা কয়েকবার পাশাপাশি বসিয়ে গুণ করলে আমরা অন্য একটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাই। উদাহরণ টেনে বলা যায়, ২ সংখ্যাটিকে পাশাপাশি ৩ বার বসিয়ে গুণ করলে আমরা গুণ ফল পাই ৮। অর্থাৎ ২ ক্ম ২ ক্ম ২ = ৮ বা ২৩ = ৮। এ ক্ষেত্রে ২-কে বেইজ বা ভিত্তি ধরলে এখানে বলতে পারি, ৮-এর লগারিদম ৩। আমরা গণিতের ভাষায় লিখি : log2 (8) = 3। বাংলায় লিখতে পারি লগ২ (৮) = ৩। আমরা তা পড়তে গেলে পড়ি এভাবে : ‘the logarithm of 8 with base 2 is 3’ অথবা ‘log base 2 of 8 is 3’ অথবা ‘the base-2 log of 8 is 3’ অথবা ২ ভিত্তি সাপেক্ষে ৮-এর লগ ৩।
লক্ষণীয়, এখানে আমরা তিনটি সংখ্যা রয়েছে : ৮, ২, ৩। ৮ হচ্ছে সেই সংখ্যা, যার লগারিদম আমরা জানতে চাই। ২ হচ্ছে বেইজ। আর ৩ নির্ণেয় লগারিদম নাম্বার। এর অর্থ আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়- বেইজ যদি ২ হয় তবে ৮-এর লগারিদম কত? তখন আমার উত্তর হবে ৩।
এখন যদি প্রশ্নটা হয় এমন- ২ বেইজ ধরলে ৬৪-এর লগারিদম কত? অর্থাৎ লগ২ (৬৪) = কত? আমরা জানি ২ ক্ম ২ ক্ম ২ ক্ম ২ ক্ম ২ ক্ম ২ = ৬৪ কিংবা ২৬ = ৬৪। তখন আমরা সহজেই বলতে পারি এ ক্ষেত্রে ২ বেইজ ধরলে ৬৪-এর লগারিদম ৬। অর্থাৎ লগ২ (৬৪) = ৬।
বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলার জন্য আমরা এবার আরেকটি উদাহরণ দেখব। ধরা যাক, প্রশ্ন করা হলো ৫ বেইজ ধরলে ৬২৫-এর লগারিদম কত? গণিতের ভাষায় প্রশ্নটি লিখতে হবে এভাবে :
ষড়ম৫ (৬২৫) = ?, লগ৫ (৬২৫) = কত?
লক্ষ করুন, ৫ ক্ম ৫ ক্ম ৫ ক্ম ৫ = ৬২৫ অথবা ৫৪ = ৬২৫। এখানে চারটি ৫ পাশাপাশি বসিয়ে গুণ করলে আমরা গুণফল পাই ৬২৫। অতএব এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, ৬২৫-এর লগারিদম ৪। আর তা লিখে প্রকাশ করতে পারি এভাবে : লগ৫ (৬২৫) = ৪।
প্রিয় পাঠক, যারা একটু মনোযোগ দিয়ে লেখাটি এ পর্যন্ত পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই লগারিদম সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পেয়েছেন। উপরে আমরা ২-ভিত্তিক ও ৫-ভিত্তিক লগারিদমের উদাহরণ দেখলাম। কিন্তু আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসগুলোতে যে লগারিদম চর্চা করি, তা সাধারণত ১০-ভিত্তিক লগারিদম। এই ১০-ভিত্তিক লগারিদমের কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। ১০-কে বেইজ বা ভিত্তি ধরে যে লগারিদমের হিসাব-নিকাশ করা হয়, তাকে বলা হয় কমন লগারিদম। প্রকৌশলীরা এই ১০-ভিত্তিক লগারিদম নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। তাছাড়া আমাদের সামগ্রিক কাজকর্ম যেহেতু দশমিক-ভিত্তিক, তাই ১০-ভিত্তিক লগারিদম নিয়ে কাজ করাই ভালো। আমাদের সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরে একটি লগ বাটন রয়েছে। এ বাটন ব্যবহার করে ক্যালকুলেটর থেকে সহজেই কোনো সংখ্যার ১০-ভিত্তিক লগ কত, তা জেনে নিতে পারি। ক্যালকুলেটর নিয়ে কোনো নাম্বার লিখে লগ বাটন চাপলে যে নাম্বারটি পাই, তা হলো ১০-কে পাশাপাশি কতবার বসিয়ে সবগুলো গুণ করলে নেয়া প্রদত্ত সংখ্যাটি পাওয়া যাবে।
সে যা-ই হোক, আমরা জানি :
১০১ = ১০, অতএব লগ১০(১০) = ১
১০২ = ১০০, অতএব লগ১০(১০০) = ২
১০৩ = ১০০০, অতএব লগ১০(১০০০) = ৩
১০৪ = ১০০০০, অতএব লগ১০(১০০০০) = ৪
১০-ভিত্তিক লগ যেহেতু কমন লগারিদম, সেহেতু আমরা ১০-ভিত্তিক লগারিদম লেখার সময় বেইজ ১০ লিখি না। যখন কোনো লগারিদম লেখার সময় বেইজ লেখা থাকবে না, তখন আমরা ধরে নেব এর বেইজ ১০। যেমন আমরা লগ১০(১০০) = ২ না লিখে আমরা লিখি লগ (১০০) = ২, তেমনি লগ (১০০০) = ৩, লগ (১০০০০০০০) =৭ ইত্যাদি।
এবার লক্ষ করুন, উপরে আমরা দেখেছি ১০-কে বেইজ ধরলে ১০-এর লগ ১, আর ১০০-এর লগ ২। অতএব সহজেই অনুমেয়, ১০-কে বেইজ বিবেচনা করলে ১০-এর চেয়ে বড় এবং ১০০-এর চেয়ে ছোট সংখ্যার লগারিদম হবে ১-এর চেয়ে বড় এবং ২-এর চেয়ে ছোট। তেমনি ১০০-এর চেয়ে বড় ও ১০০০-এর চেয়ে ছোট সংখ্যার লগারিদম হবে ২-এর চেয়ে বড় এবং ৩-এর চেয়ে ছোট। অতএব লগারিদম নম্বর হতে পারে একটি দশমিক নাম্বার। যেমন ১০১.৪১৪৯৭...= ২৬, অতএব লগ১০(২৬) = ১.৪১৪৯৭...।
আবার লগারিদম নেগিটিভ বা ঋণাত্মকও হতে পারে। ঋণাত্মক লগারিদমের অর্থ হচ্ছে বেইজ নম্বরটি দিয়ে কতবার ভাগ করলে প্রদত্ত সংখ্যাটি পাওয়া যাবে। যেমন প্রশ্ন করা হলো, ৮-কে বেইজ ধরলে ০.১২৫-এর লগারিদম কত হবে? আমরা জানি ১ গু ৮ = ০.১২৫। অতএব আমরা লিখতে পারি, লগ৮ (০.১২৫) = - ১। এবার লক্ষ করা যাক, ৫-কে বেইজ ধরে আরেকটি নেগিটিভ লগারিদমের উদাহরণ। আমরা জানি, ১ গু ৫ গু ৫ গু ৫ = ১ গু ৫-৩ = ০.০০৮। অতএব আমরা লিখতে পারি লগ৫ (০.০০৮) = - ৩।
অতএব এতক্ষণের আলোচনায় দেখেছি, যদি ২৩ = ৮ হয়, তবে লগ২ (৮) = ৩। এই বিষয়টি সাধারণীকরণ করলে বলতে পারি, যদি ax = y হলে loga (y) = x ।
আরেকটি সংখ্যার কথা আমরা জানি। এর নাম Euler Number, যা প্রকাশ করা হয় ব সঙ্কেত দিয়ে। আর এর সংখ্যা মান ২.৭১৮২৮...। এই সংখ্যাটিকে বেইজ ধরেও কোনো সংখ্যার লগারিদম বের করা হয়। এর নাম ন্যাচারাল লগারিদম। গণিতবিদেরা এ লগারিদম প্রচুর ব্যবহার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে এই ২.৭২৮২৮... নাম্বারটি পাশাপাশি কতবার বসিয়ে গুণ করলে প্রদত্ত সংখ্যার সমান হবে, তাই হবে কাঙিক্ষত লগারিদম নাম্বার।
ln (৭.৩৮৯) = loge (৭.৩৮৯) ≈ ২, কারণ ২.৭১৮২৮২ ≈ ৭.৩৮৯। এখানে সবিশেষ লক্ষণীয়, গণিতবিদেরা ইউলার নাম্বারকে বেইজ ধরে লগারিদম বের করার সময় log-এর স্থানে ln লিখে থাকেন ১০-ভিত্তিক লগারিদম থেকে পার্থক্য করার জন্য।
এই হচ্ছে লগারিদম সম্পর্কে মোটামুটি মৌল ধারণা। এ ধারণা পাওয়ার অর্থ লগারিদম আসলে কী, তার একটি পরিচয় পাওয়া। এখন লগারিদমকে কাজে লাগানোর প্রয়োজনে লগারিদম নাম্বার বের করার নিয়ম-কানুন ও কয়েকটি সূত্র জেনে নিয়ে এর ব্যবহার অনুশীলন করা। আগ্রহী যেকোনো জন তখন তা সহজেই জানতে-বুঝতে পারবেন। তবে স্থানাভাবে সে আলোচনায় যাওয়া সম্ভব নয়। সময় ও সুযোগ হলে সে বিষয়ের ওপর আরেকটি লেখায় আলোকপাত করার প্রত্যাশা রইল।
তবে এ লেখার শেষ দিকটায় আরেকটি লগারিদম-সংশ্লিষ্ট বিষয় উল্লেখ করতে চাই। এ বিষয়টি হচ্ছে এক্সপোনেন্ট। এক্সপোনেন্ট ও লগারিদমের মধ্যে একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। আমরা দেখেছি : ২৩ = ২ ক্ম ২ ক্ম ২ = ৮। এখানে ২-কে ৩ বার গুণ করে গুণফল পাই ৮। এখানে ৩-কে বলা হয় এক্সপোনেন্ট, আর ২-কে বলা হয় বেইজ। তাহলে একটি বেইজকে কতবার পাশাপাশি বসিয়ে গুণ করলে একটি সংখ্যা পাওয়া যাবে, সেটাই হচ্ছে এর এক্সপোনেন্ট।
গণিতদাদু