লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাই-এর মান বের করা
পাই-এর মান বের করা
আমরা দেখেছি ছোট-বড় যেকোনো বৃত্তের পরিধিকে এর ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ করলে সব সময় এর মান দাঁড়ায় ২২/৭। আর এই মানকেই আমরা বলি পাই (চর)। এই পাইকে আমরা প্রকাশ করে থাকি গ্রিক বর্ণমালার π বর্ণ বা অক্ষরটি দিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা যদি পাইয়ের মান দশমিকে প্রকাশ করতে যাই, তবে দেখা যাবে দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত এর মোটামুটি মান ৩.১৪ প্রায়। তিন দশমিক স্থান পর্যন্ত এর মান ৩.১৪১ প্রায়। আর চার দশমিক স্থান পর্যন্ত এর মান ৩.১৫১৫ প্রায়। এভাবে যত বেশিসংখ্যক দশমিক স্থান পর্যন্ত এর মান বের করতে যাই না কেনো, এর মান আসন্নই থেকে যায়, এর একদম সঠিক মান পাওয়া যায় না। ৫০ হাজার দশমিক স্থান কিংবা লাখো-কোটি দশমিক স্থান পর্যন্ত মান বের করলে এর মান আসন্নই থেকে যাবে। অর্থাৎ এই ২২/৭ সংখ্যাটির মান সব সময় আসন্ন মান হিসেবেই থেকে যাবে। কারণ, ২২ সংখ্যাটি কখনই ৭ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য নয়। বিশ্বে যত কমপিউটার আছে, সব একসাথে নিয়ে বিশ্বের সব মানুষ যদি ২২-কে ৭ দিয়ে অনন্তকাল ভাগ করে যেতে থাকে, তবুও এর ভাগের কাজ শেষ করা যাবে না। এছাড়া ভাগফলে কোনো নাম্বার প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি পাওয়া যায় না। গণিতের জগতে এ ধরনের সংখ্যাকে বলা হয় ইরেশনাল নাম্বার। পিথাগোরাসসহ প্রাচীন সময়ের অনেক বিখ্যাত গণিতবিদ বিস্মিত হয়ে যান, যখন এরা দেখতে পেলেন এ ধরনের একটি ‘ইমপিউর’ তথা অবিশুদ্ধ সংখ্যার অসিত্মত্ব রয়েছে।
আজকের দিনের কোনো কোনো গণিতবিদ মনে করেন, পাইয়ের আরও অনেক অবাক করা গুণাগুণ রয়েছে : এটি একটি নরমাল নাম্বার। এর অর্থ এ সংখ্যায় ০ থেকে ৯ পর্যন্ত অঙ্কগুলো বসে একদম এলোমেলোভাবে। এ ক্ষেত্রে এ অঙ্কগুলো কখনই কোনো প্যাটার্ন মেনে বসে না। বরং যদি দশ দিকবিশিষ্ট কোনো নম্বর-ছক বা ডাইস বারবার মেরে পাওয়া এলোমেলো সংখ্যা বসিয়েই যাই, তবে যেনো এই পাইয়ের মানের ধাঁচের একটি সংখ্যা বের করা হয়েছে বলেই মনে হবে। ব্যাপারটি যেন এমন, আপনি যদি ধারাবাহিকভাবে ১২৩৪৫৬৭৮৯ অঙ্কগুলো এই পাইয়ের মান পাওয়ার আশা করে লাখো-কোটি দশমিক স্থান পর্যন্ত মান বের করেন, তারপরও তা পাবেন বলে আশা করতে পারেন না। এমনকি আমরা যদি পুরো রবীন্দ্র রচনাবলিতে ব্যবহার করা অক্ষরগুলো ধারাবাহিকভাবে অ-এর জায়গায় ১, আ-এর জায়গায় ২, ই-এর জায়গায় ৩ ইত্যাদি সংখ্যামান বসিয়ে একটি সংখ্যা তৈরি করি, তবে সেখানেও পাইয়ের মানের মতো একই ধরনের এলোমেলো প্যাটার্নের একটি সংখ্যা পাব।
পাইয়ের মান বের করার নানা পদ্ধতি রয়েছে। এসবের মধ্যে সিকুয়েন্স বা সিরিজ নাম্বার পদ্ধতি একটি। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে গটফ্রিড উইলহেম লিবনিজ (১৬৪৬ - ১৭১৬) উদ্ভাবিত একটি সিরিজ বা সংখ্যাধারা। এই সিরিজে যোগ করা হয়েছে অসীম সংখ্যক পদ। আর এ সিরিজের সমষ্টি পাইয়ের মানের মোটামুটি কাছাকাছি। তার উদ্ভাবিত এই সিরিজ বা ধারা মতে :
π = ৪/১ - ৪/৩ + ৪/৫ - ৪/৭ + ৪/৯ - ৪/১১ + ...
পাইয়ের মানের আরেকটি ধারা প্রকাশ করেছেন নীলকান্ত সমাজী (১৪৪৪-১৫৪৪)। এর মান পাইয়ের মানের আরও বেশি কাছাকাছি। এখানে
π = ৩ + ৪২ X ৩ X ৪ - ৪৪ X ৫ X ৬ + ৪৬ X ৭ X ৮ - ৪৮ X ৯ X ১০ + ...
আর পাইয়ের মান বের করার নিচের সূত্রটি ১৬৫৫ সালে উদ্ভাবন করেন জন ওয়ালিস :
π = ২ X ২১ X ২৩ X ৪৩ X ৪৫ X ৬৫ X ৬৭ X ৮৭ X ৮৯ ঢ ...
শক্তিশালী কমপিউটার ব্যবহার করে পাইয়ের মান বের করা হয়েছে ১০ ট্রিলিয়ন দশমিক স্থান পর্যন্ত (১-এর পর ১৩টি শূন্যের ঘর পর্যন্ত)।
ফ্রেন্ডলি নাম্বার
আসুন ২২০ ও ২৮৪ এই সংখ্যা দু’টি নিয়ে একটি ব্যাপার লক্ষ করি। ২২০ সংখ্যাটিকে আমরা যে যে সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করতে পারি, সেগুলা হলো : ১, ২, ৪, ৫, ১০, ১১, ২০, ২২, ৪৪, ৫৫ ও ১১০। ২২০ সংখ্যাটির এই ভাজকগুলো একসাথে যোগ করলে যোগফল হয় ২৮৪। আবার ২৮৪ সংখ্যাটিকে যেসব সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করা যায়, সেগুলো হলো : ১, ২, ৪, ৭১ ও ১৪২। ২৮৪ সংখ্যাটির এই ভাজকগুলো একসাথে যোগ করলে যোগফল হয় ২২০। তাহলে আমরা পেলাম- ২২০ সংখ্যাটির ভাজকগুলোর যোগফল ২৮৪। আর ২৮৪ সংখ্যাটির ভাজকগুলোর যোগফল ২২০। এই সংখ্যা দু’টির মধ্যে অবাক করা এই সম্পর্কটি থাকার কারণে বলা হচ্ছে ২২০ ও ২৮৪ হলো ফ্রেন্ডলি নাম্বার। তাহলে ফ্রেন্ডলি নাম্বারের সংজ্ঞাটি কী দাঁড়ায়?
গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাসের দেয়া সংজ্ঞা মতে, দু’টি সংখ্যাকে তখনই ফ্রেন্ডলি নাম্বার বলা হবে, যখন পারস্পরিকভাবে একটির ভাজকগুলোর যোগফল অপর সংখ্যাটির সমান হবে।
গ্রিক গণিতবিদেরাই প্রথম জানতে পারেন ২২০ ও ২৮৪-এর ফ্রেন্ডলি সংখ্যাজোড়ের কথা। ১৬৩৬ সালে ফ্রেন্ডলি নাম্বারের আরেকটি সংখ্যাজোড়ের কথা জানতে পারেন ফরাসি গণিতবিদ পিঁয়েরে ডি ফারমেট। এ সংখ্যা দু’টি হলো ১৭২৯৬ ও ১৮৪১৬। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ৬০টিরও বেশি ফ্রেন্ডলি সংখ্যাজোড় আবিষ্কৃত হয়। মজার ব্যাপার, দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম ফ্রেন্ডলি সংখ্যাজোড় ১১৮৪ ও ১২১০-এর কথা আমরা জানতে পারিনি ১৮৬৭ সালের আগে। মাত্র ১৬ বছর বয়েসি এক ইতালীয় এই দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম ফ্রেন্ডলি সংখ্যাজোড়টি তখন জানতে পারে। তার নাম নিকোলো প্যাগানিনি।
কমপিউটারের সাহায্যে হিসাব-নিকাশ করে সময়ের সাথে ফ্রেন্ডলি সংখ্যাজোড়ের সংখ্যা বাড়িয়েই তোলা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও ফ্রেন্ডলি নাম্বার নিয়ে গণিতবিদদের মনে নানা প্রশ্ন জাগছে। গণিতবিদেরা দেখেছেন, ফ্রেন্ডলি নাম্বার দু’টির উভয়েই জোড় হয়, নতুবা উভয়েই বিজোড় হয়। তাদের প্রশ্ন, কেনো এমন হয়? এমন ফ্রেন্ডলি সংখ্যাজোড় কি পাওয়া যাবে, যার একটি সংখ্যা জোড়, আরেকটি বিজোড়? কেনো প্রতিটি ফ্রেন্ডলি বিজোড় সংখ্যা ৩ দিয়ে বিভাজ্য?
রেফিজিট নাম্বার
১৯৭ একটি বিস্ময়কর সংখ্যা। এর রয়েছে তিনটি ডিজিট বা অঙ্ক : ১, ৯, ৭। আমরা যদি এই অঙ্ক তিনটি যোগ করি তবে দেখতে পাই ১ + ৯ + ৭ = ১৭। এবার যদি এই যোগের কাজটি ফেবোনাচ্চি স্টাইলে চালিয়ে যাই, তবে নিচে উল্লিখিত রূপ পাব।
১ + ৯ + ৭ = ১৭
৯ + ৭ + ১৭ = ৩৩
৭ + ১৭ + ৩৩ = ৫৭
১৭ + ৩৩ + ৫৭ = ১০৭
৩৩ + ৫৭ + ১০৭ = ১৯৭
লক্ষ করুন, আমরা এ প্রক্রিয়ার আবার মূল সংখ্যা ১৯৭-এ ফিরে এসেছি। কোনো সংখ্যা নিয়ে এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চালিয়ে আবার যদি মূল সংখ্যায় ফিরে আসা যায়, তবে এ সংখ্যাটিকে বলা হয় জবঢ়ভরমরঃ ঘঁসনবৎ। এখানে ১৯৭ হচ্ছে তিন অঙ্কের একটি রেফিজিট নাম্বার। তেমনইভাবে ৭৫ হচ্ছে দুই অঙ্কের একটি রেফিজিট নাম্বার। উপরে উল্লিখিত ফেবোনাচ্চি ধরনের যোগের কাজটি এ ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে চালিয়ে আমরা পাই :
৭ + ৫ = ১২
৫ + ১২ = ১৭
১২ + ১৭ = ২৯
১৭ + ২৯ = ৪৬
২৯ + ৪৬ = ৭৫
আমরা শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে এলাম মূল সংখ্যা ৭৫-এ। অতএব ৭৫ একটি দুই অঙ্কের রেফিজিট সংখ্যা। আপনি কি ৭৫-এর মতো আরো কয়েকটি দুই অঙ্কের এবং ১৯৭-এর মতো কয়েকটি রেফিজিট সংখ্যা বের করতে পারবেন? আসলে এ ধরনের বিভিন্ন অঙ্কের বহু রেফিজিট সংখ্যা রয়েছে। চেষ্টা করেই দেখুন না বের করতে পারেন কি না।
গণিতদাদু