লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
টিআইএম নুরুল কবীর
মোট লেখা:২
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি
মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প : পরিবর্তন ও উন্নয়নের অংশীদার
সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্ড সিইও, অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম এপারেটর্স অব বাংলাদেশ
বাংলাদেশে মোবাইল টেলিফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র এক দশকের মধ্যে এমন দ্রুত হারে বেড়েছে, যা ইতোপূর্বের সব প্রত্যাশার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রতি দেশের মানুষের ব্যাপক আস্থা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একটি প্রযুক্তি পুরো একটি সমাজের মানুষের জীবনধারার দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে।
বাংলাদেশে ২০০৩ সালে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর হার ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। বিগত এক দশকে মোবাইল ফোনের গ্রাহকসংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পৃথিবির মাত্র ১৪টি দেশ গ্রাহকসংখ্যার দিক দিয়ে ১০ কোটির ঘরানায় (১০০ মিলিয়ন ক্লাব) নিজেদের নাম লেখাতে পেরেছে। ১০ কোটির ঘরানায় বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ১২তম, যেখানে ফিলিপাইন ১৩তম ও মেক্সিকো ১৪তম।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান
মোবাইল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম দুটি সুফল হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উৎপাদন ক্ষেত্রে সহায়ক অবদান। মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প খাতের উন্নয়ন বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো গড়ে তোলার পক্ষে সহায়ক হয়েছে এবং সেই সাথে গ্রাহক সাধারণের দৈনন্দিন দেয়া-নেয়ার রীতি ব্যাপক হারে বদলে দেয়ার পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে আসছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরেরা (এমএনও) বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে এসেছে। উপরন্তু দেশের ৬৪টি জেলা শহরে ইতোমধ্যে থ্রিজি নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিয়েছে।
জীবনের সার্বিক মানোন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প সমাজের অসংখ্য মানুষের জীবনে গঠনমূলক পরিবর্তন সূচিত করেছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন শুধু মৌখিক আলাপের একটি সুবিধাজনক যন্ত্র নয়, বরং তা একাধারে ব্যবসায় ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজনীয় যোগাযোগ মাধ্যম, একটি বার্তা বাহক, ক্যালকুলেটর এবং এফএম রেডিও ও ইন্টারনেটের সুবাদে সংবাদ, তথ্য জানা ও বিনোদনের উৎকৃষ্ট একটি মাধ্যম। কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার ভূমিকা চতুর্মাত্রিক। প্রথমত, প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান। অর্থাৎ টেলিযোগাযোগ শিল্পে এবং টেলিযোগাযোগ শিল্পসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরবরাহ, জোগান ইত্যাদি কাজে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও লোকজন দিয়ে সৃষ্ট কর্মসংস্থান। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান, অর্থাৎ যেসব কাজ বাইরে থেকে করানো হয়, সেসব কাজের সূত্র ধরে এবং সরকার টেলিযোগাযোগ খাত থেকে লব্ধ রাজস্ব যখন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কার্যক্রমে ব্যয় করে, সেসব কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট কর্মসংস্থান। তৃতীয়ত, পরোক্ষ কর্মসংস্থান, অর্থাৎ লভ্যাংশ থেকে নির্বাহিত বিবিধ খরচ, যা ঘুরে-ফিরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। চতুর্থত, বর্ধিত কর্মসংস্থান, অর্থাৎ টেলিযোগাযোগ শিল্পে নিযুক্ত কর্মচারীরা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের আয় থেকে ব্যয় করার ফলে যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরেরা (এমএনও) বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৬ লাখের বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
উদ্ভাবনী সেবার ভূমিকা
মোবাইল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত বিস্তর যোগাযোগ ও কর্মতৎপরতার ক্ষেত্র তৈরি করে, যা পক্ষান্তরে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা- বেগবান করে তোলার মধ্য দিয়ে মোট জাতীয় উৎপাদন প্রবৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প লাখ লাখ মানুষের জন্য টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা ও কার্যক্রমের মান উন্নত করতে সহায়ক অবদান রাখে। মোবাইল টেলিযোগাযোগ খাত উপরোক্ত সুবিধার পাশাপাশি আরও অনেক ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার প্রেক্ষাপট রচনা করে। মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প সম্প্রতি বেশ কিছু উদ্ভাবনী সেবা প্রবর্তন করেছে, যা গ্রাহক সাধারণের জীবন ও জীবিকায় ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ। মানুষ এখন তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে পারছে, ট্রেনের টিকেট ক্রয় ও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন ফি ইত্যাদি দিতে পারছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আবহাওয়া ও ফলন বিষয়ে তৎক্ষণাৎ তথ্য সহজে পেয়ে যাওয়ায় কৃষকের জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়ন হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে মানুষ এখন শুধু কয়টি শর্ট কোডে ডায়াল করে মুহূর্তের মধ্যে একজন দক্ষ চিকিৎসকের সাথে কথা বলে যথাযথ পরামর্শ নিতে পারছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এসএমএসের মাধ্যমে বর্তমানে সার্বজনীন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা এসএমএসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে তালিকাভুক্ত হতে পারছে। চাকরি বাজারের চাহিদার দিক বিবেচনা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের ওপর বিশেষ কোর্স চালু করা হয়েছে।
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের সুযোগ সাধারণ মানুষের, বিশেষত গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সূচিত করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি মোবাইল মানি গ্রাহক রয়েছে। মোবাইল মানি গ্রাহকের মধ্যে সক্রিয় অ্যাকাউন্টের গড় বিশ্ব হার ৩০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের সেবা চালু হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে সক্রিয় অ্যাকাউন্টের হার দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে।
তথ্য ও উপাত্তের যুগ
মোবাইল ফোন ব্যবহারের অভ্যাস বাড়ার সাথে সাথে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতিও সাধারণ মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মোবাইল টেলিযোগাযোগে দ্বিতীয় প্রজন্মের (টুজি) প্রযুক্তিতে মূলত ভয়েসের সুবিধার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তথাপি আমাদের দেশের অনেক সাধারণ গ্রাহক টুজি প্রযুক্তি দিয়ে ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে অভ্যস্ত। থ্রিজি প্রযুক্তি চালু হওয়ার ফলে গ্রাহকদের মাঝে ইন্টারনেটের চাহিদা খুব দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। থ্রিজি প্রযুক্তি চালু হওয়ার পর ভয়েসের চেয়ে বর্তমানে তথ্য-উপাত্তের প্রতি গ্রাহকের আগ্রহ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক পাঁচ কোটির কাছাকাছি ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৭.৩৫ শতাংশ মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মাধ্যমে সংযোগ নিয়েছে। প্রচুর গ্রাহক এখন ডেস্কটপের তুলনায় মোবাইল ফোনে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে ইন্টারনেটে প্রবেশ করার সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। গ্রাহকদের জীবনধারা সমৃদ্ধ করতে বাজারে আসছে নতুন নতুন উপাত্তসামগ্রী।
ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমজিডি) অন্তর্ভুক্ত বেশ কিছু লক্ষ্য সফলতার সাথে অর্জন করে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর কাছে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হওয়া সত্ত্বেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরী করা ও নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বমঞ্চে নন্দিত। আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষার প্রয়াসে বাংলাদেশের অবদান বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরেরা ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য সামনে রেখে বাস্তবক্ষেত্রে সে লক্ষ্য অর্জন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে ও অবদান রাখার জন্য সার্বিকভাবে সচেষ্ট। বাংলাদেশে সুবিন্যস্ত ফিক্স-নেটওয়ার্কের অভাব রয়েছে। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের স্বার্থে ওয়্যারলেস প্রযুক্তি একটি যথোপযুক্ত বিকল্প উপায়। কার্যত মোবাইল ব্রডব্যান্ড ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিশেষ চাবিকাঠি হতে পারে।
গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা
পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল এশিয়া-প্যাসিফিক, যার অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৫০টি দেশ এবং বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি। মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প খাত এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাম্প্রতিককালে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে আসছে। ২০১৩ সালে মোবাইল শিল্প খাত এ অঞ্চলের জিডিপিতে মোট ৪.৭ শতাংশ অবদান রাখে, যার পরিমাণ ৮৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রত্যক্ষভাবে টোলিযোগাযোগ শিল্প খাত ৩৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দিচ্ছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মোবাইল অপারেটরেরা এবং হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারীসহ পুরো টেলিযোগাযোগ খাত সম্মিলিতভাবে সেবার মূল্যমান গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার লক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহকসংখ্যা বিগত বছরগুলোতে বিস্ময়কর হারে বাড়লেও মোবাইল শিল্প খাত এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে যে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা হলো- এখনও পর্যন্ত জনগণের যে অংশ নেটওয়ার্কের বাইরে রয়ে গেছে তাদেরকে নেটওয়ার্কের আওতার মধ্যে আনা। নতুন গ্রাহকদের বেশিরভাগই আসবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্য থেকে। ফলে মোবাইল সেবার মূল্যমান আরও কমিয়ে আনা এবং নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করা আগামী সময়ের জন্য জরুরি বিষয়।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মোবাইল ব্যবহারের ওপর ১ শতাংশ হারে বাড়তি চার্জ আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাড়তি চার্জের ফলে মোবাইল সেবা নেয়ার ব্যয়ভার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সামনে নতুন গ্রাহক সৃষ্টির পথে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, তা ভালো মতো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করা যায়।
সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা
মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক গতি সঞ্চার করেছে। তথাপি টেলিযোগাযোগ শিল্পের অনেক সম্ভাবনাময় পথ এখনও পর্যন্ত অবরুদ্ধ। যেমন- দেশে এখনও একটি সময়োপযোগী টেলিযোগাযোগ নীতিমালা ও রোডম্যাপ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ শিল্প খাত সরকারের কঠোর নীতিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। করের হারও মাত্রাতিরিক্ত বেশি। বাংলাদেশের কর্পোরেট করের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ এবং ট্যারিফ হার সর্বনিমণ। এই বাস্ততার মধ্যে নেটওয়ার্কের বিস্তার ও সেবার মানোন্নয়নের স্বার্থে পুঁজি বিনিয়োগ করা যথেষ্ট দুরূহ।
সরকার যদি বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষে যথার্থই প্রযুক্তি কাজে লাগাতে আগ্রহী হয়, সে ক্ষেত্রে মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্পের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া দরকার। টেলিযোগাযোগ শিল্পের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জাতীয় লক্ষ্য সামনে এগিয়ে নিতে হলে, বাংলাদেশ সরকারকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে এবং প্রযুক্তিবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। মোবাইল অপারেটরেরা আগামীতে আরও বিনিয়োগ করার চিন্তাভাবনা করছে। তবে বিনিয়োগের অনুকূল সহায়ক নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া দরকার। পাশাপাশি একটি টেকসই কর নীতিমালা প্রণয়নও বিশেষ প্রয়োজন। টেলিযোগাযোগ শিল্পের অর্থনৈতিক সুফল যথাযথ পেতে হলে বাংলাদেশকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট আরও বিসত্মীর্ণ এবং সহজলভ্য করে তুলতে হবে। পর্যাপ্ত তরঙ্গ বরাদ্দের মাধ্যমে অপারেটরদের জন্য অল্প খরচে নেটওয়ার্ক তৈরি করে দেয়ার সুযোগ রাখতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবে গড়ে তোলার লক্ষে প্রয়োজন মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প খাতের প্রতি আন্তরিক দৃষ্টিপাত, প্রযুক্তি নিরপেক্ষতা, তরঙ্গ রোডম্যাপ, কর ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার দ্ব্যর্থহীন সামঞ্জস্য
জাতীয় রাজস্বে অবদান
সেবা খাতের মধ্যে মোবাইল টেলিযোগাযোগ খাত সরকারি কোষাগারে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে, যা সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখে আসছে। ভ্যাটসহ নানা ধরনের কর দেয়ার মাধ্যমে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরেরা (এমএনও) সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে সহায়ক অবদান রাখছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প মোট জাতীয় উৎপাদনে ৩.১ শতাংশ অবদান রাখে। মোট জাতীয় উৎপাদনে অবদানের এই হার এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট বেশি- ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় যা ০.৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১ শতাংশ এবং মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ১.৮ শতাংশ। ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরেরা (এমএনও) সরকারি রাজস্বে সর্বমোট ৪০ হাজার কোটি টাকা জোগান দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ের খাত বহুবিধ। মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরেরা (এমএনও) তাদের লভ্যাংশের বড় একটি অংশ খরচ করে ভ্যাট, আমদানি কর, হ্যান্ডসেট রয়্যালটি ইত্যাদি কর পরিশোধ বাবদ। মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প খাতে নিযুক্ত কর্মচারীরা যে বেতন পেয়ে থাকেন তা থেকে কর প্রদেয়। অন্যান্য খাতাভিমুখে যে লভ্যাংশ সঞ্চারিত হয় তা থেকেও রাজস্ব আদায় করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালে সরকারি কোষাগারে টেলিযোগাযোগ শিল্প খাত মোট রাজস্ব আয়ের ৮ শতাংশ দেয়। সার্বিকভাবে মোবাইল টেলিযোগাযোগ খাত থেকে সরকার বর্তমানে কম-বেশি ১০ শতাংশ রাজস্ব অর্জন করছে।
প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ
মোবাইল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও উদ্ভাবনী সেবা সারা পৃথিবীকে এক অভিন্ন লোকালয়ে পরিণত করেছে। মোবাইল টেলিযোগাযোগ পুঁজিঘন শিল্প খাত। নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও গ্রাহকের চাহিদা পূরণের স্বার্থে মোবাইল অপারেটরদের পর্যায়ক্রমে পুঁজি বিনিয়োগ করে যেতে হয়। মোবাইল টেলিযোগাযোগের অগ্রগতির সাথে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্পর্ক সুগভীর ও গঠনমূলক। বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত প্রযুক্তি এবং সেই প্রযুক্তি পরিচালনার দক্ষ জ্ঞান দেশে আমদানি হয়ে থাকে; সাথে করে নিয়ে আসে হালনাগাদ ব্যবস্থাপনা কৌশলাদি এবং ফলশ্রম্নতিতে বিস্তর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। বড় ধরনের বৈদেশিক বিনিয়োগ জাতীয় অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা বয়ে আনে। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে মোবাইল টেলিযোগাযোগ শিল্প খাত। ২০০১ সালে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ শিল্প খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের হার ছিল মাত্র ০.৯ শতাংশ। ২০১০ সালে এসে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬০.৪ শতাংশে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ৩০.৩৫ শতাংশ সরবরাহ এসেছে টেলিযোগাযোগ শিল্প খাতে, যার মোট পরিমাণ ৫২৫.২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ফিডব্যাক : timnkabir@gmail.com