• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ক্রাউডফান্ডিং: বাংলাদেশের অস্থান কোথায়?
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোহাম্মাদ আব্দুল হক
মোট লেখা:১৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৫ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
আইসিটি
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
৩৪ বিলিয়ন ডলারের ক্রাউডফান্ডিং: বাংলাদেশের অস্থান কোথায়?
ব্রিটেনের একটি ব্যান্ডদল তাদের পুনর্মিলনী সফরের জন্য ভক্তদের কাছে সহযোগিতা কামনা করে। ১৯৯৭ সালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভক্তরা সাড়াও দিলেন। বিশ্ব পেল অর্থ সংগ্রহের যুগান্তকারী একটি ধারণা, যা বর্তমানে সারা বিশ্বে ‘ক্রাউডফান্ডিং’ নামে পরিচিত। এই ধারণা থেকে জন্ম হয়েছে প্রথম ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম আর্টিস্ট শেয়ার। ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর এর সফলতা পরবর্তী সময়ে ফান্ড সংগ্রহের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। সারা বিশ্বে এখন কয়েক হাজার ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম আছে। বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে চলছে এর কার্যক্রম। আমাদের দেশে স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে ক্রাউডফান্ডিং কার্যক্রম। আমাদেরকে প্রস্ত্তত হতে হবে একে স্বাগত জানাতে। এই প্রতিবেদন থেকে আমরা ক্রাউডফান্ডিংয়ের বিস্তারিত জানব এবং জানব বিশ্ব যেভাবে এর মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে ও এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কী? তার আলোকে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখেছেন মোহাম্মদ আবদুল হক ও এআর হোসেইন
ক্রাউডফান্ডিং কী?
শুরুতেই জানা যাক ক্রাউডফান্ডিং আসলে কী? সহজ ভাষায়, অনেক লোকের কাছ থেকে অল্প অল্প করে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে ক্রাউডফান্ডিং বলে। মূলত ইন্টারনেট সেবাকে কাজে লাগিয়ে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এ কথা বলা যায়, ক্রাউডফান্ডিং হচ্ছে অর্থ সংগ্রহের একটি প্রক্রিয়া। অতীতেও ক্রাউডফান্ডিংয়ের অসিত্মত্ব ছিল, কিন্তু বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে স্যোশাল মিডিয়ার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তারা এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যারা অর্থ প্রদান করবে এবং যার বা যেই সংগঠনের অর্থ প্রয়োজন, তাদের মধ্যে যোগসূত্র করে দেয়ার কাজটি করে থাকে ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম। যেমন- ক্রাউড-কিউভ ব্রিটেনের একটি ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম, যারা ব্রিটেনে পরিচালিত কোনো ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারীদের সুযোগ করে দেয়।
ক্রাউডফান্ডিং কেনো ও কীভাবে?
ক্রাউডফান্ডিংয়ের যাত্রা গতি পায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে। ২০০৮ সালে আমেরিকাসহ ইউরোপের দেশগুলো যখন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ধুঁকছিল, তখন ব্যাংকগুলো নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কিছুই করতে পারছিল না। এমনকি পুরনো উদ্যোক্তাদেরও অর্থ সহায়তা পেতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছিল। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলো তাদের কার্যক্রম সঙ্কুচিত করে ফেলছিল। সেই সময়টাতে ক্রাউডফান্ডিং উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন আশার আলো দেখাতে শুরু করে। ২০০৯ থেকে মূলত ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মগুলো উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়। এনজেল লিস্ট ও উইফান্ডার প্লাটফর্ম দুটি কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তারা তাদের উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করার সুযোগ পায়। সেই থেকে শুরু। এরপর একের পর এক সফলতার গল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রাউডফান্ডিং। ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে একজন উদ্যোক্তা বা কোনো একটি সংগঠন তাদের প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। যেকোনো প্রকল্প যেমন মোশন পিকচার প্রমোশন থেকে শুরু করে লাইব্রেরি বানানো, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য, অসুস্থ-মেধাবী শিক্ষার্থীর চিকিৎসার জন্য, বন্যা বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত জনসাধারণের সাহায্যার্থে এমনকি ব্যক্তিগত ফান্ড গঠনের জন্যও ক্রাউডফান্ডিং প্রক্রিয়া ব্যবহার হয়। এর জন্য আপনাকে শুধু বোঝাতে হবে আপনার ফান্ড বাড়াতে চাওয়ার উদ্দেশ্য।
একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির কোনো প্রকল্পের জন্য ফান্ড সংগ্রহের সুযোগ পাওয়া যায় ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মে। এর জন্য একজন উদ্যোক্তাকে তার প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে এবং এই প্রকল্পের জন্য কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা উল্লেখ করে পোস্ট করতে হয়। পোস্ট করা শেষে উদ্যোক্তা ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মের কমিউনিটি সদস্য ও শুভাকাঙক্ষীদের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে। কখনও কখনও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নাও হতে পারে। ইন্ডিগোগো ২০১৪ সালে তাদের পরিচালিত ক্যাম্পেইনগুলোর মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ সফলভাবে ফান্ডিং করতে পেরেছিল। যদি আপনার অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হয়, তাহলে যা সংগ্রহ করতে পেরেছেন তাই রেখে দিতে পারেন। এই সিস্টেমকে বলা হয় কিপ ইট অল। আবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিয়ে দিতে পারেন, যাকে বলা হয় কিপ অল অর নাথিং। ক্রাউডফান্ডিং ব্যবস্থায় ফান্ড বাড়ানোর মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে অনেক মানুষের কাছ থেকে অল্প পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করা। যেমন- কোনো একটি প্রকল্পের জন্য যদি ১ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়, তাহলে তা ২০০ টাকা করে ৫০০ লোকে দিতে পারেন, আবার ১০০ টাকা করে ১০০০ লোকেও দিতে পারেন।
ক্রাউডফান্ডিংয়ের প্রকারভেদ
অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে ক্রাউডফান্ডিংকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে : ০১. ডোনেশন বা অনুদানভিত্তিক ক্রাউড ফান্ডিং। ০২. রিওয়ার্ড বা অর্থ প্রদানের বিনিময়ে কোনো পুরস্কার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ভিত্তিতে। ০৩. ইকুইটি বা ব্যবসায়ের শেয়ার দানের মাধ্যমে। ০৪. সুদভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং কার্যক্রম।
ডোনেশন বা অনুদানভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত সামাজিক কাজগুলোর জন্য ফান্ড বাড়ানো হয়। এই পন্থায় দাতা কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান না। শুধু একটি ভালো কাজে সহায়তা করার জন্য তৃপ্তি লাভ ছাড়া। বন্যার্তদের সাহায্য করার জন্য অনুদানভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। এছাড়া অসহায় কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত আর্থিক উন্নয়নের সাহায্যার্থেও অনুদান দেয়া যেতে পারে। ২০০২ সালে ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম কাজ শুরু করার এক বছর আগে ক্যারিন বসন্যাক নামে এক মহিলা তার ক্রেডিট কার্ডের লোন পরিশোধ করার জন্য সবার কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। এর জন্য তিনি সেভ ক্যারিন নামে একটি ওয়েবসাইটও চালু করেন। এই আবেদনের মাধ্যমে তিনি ১৩ হাজার ডলার সাহায্য পেয়েছিলেন। এর সাথে আরও ৭ হাজার ডলার যোগ করে তিনি তার ক্রেডিট কার্ডের লোন পরিশোধ করেন। অনেকে ক্যারিন বসন্যাককে ক্রাউডফান্ডিংয়ের প্রথম উদ্যোক্তা বলে থাকেন।
রিওয়ার্ডভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং মডেলের মাধ্যমে এখন সবচেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করা হয়। মানুষ কোনো একটি প্রকল্পে অর্থ দেয়ার বিনিময়ে কিছু সুযোগ-সুবিধা চায়। তাছাড়া যখন আপনার ব্যবসায় পরিচালনার জন্য অর্থ চাইবেন, তখন অর্থদাতাকেও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত। এই ধারণা থেকেই রিওয়ার্ডভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং মডেল কাজ করে। একে জনপ্রিয় করে তুলে বিশ্বের প্রথম ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম আর্টিস্ট শেয়ার। সেখানে একজন শিল্পী, যিনি গান করেন, তার গানের অ্যালবামের মূল্য বাবদ ভক্তদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা সংগ্রহ করেন। সেই টাকা দিয়েই তিনি অ্যালবাম প্রকাশ করার খরচ মেটান এবং অ্যালবাম বের হলে তার সিডি ভক্তদেরকে উপহার হিসেবে দেন। এই একই পদ্ধতিতে বিখ্যাত আইএম সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিল। যেখানে সিনেমাটির প্রযোজক ছিলেন সাধারণ মানুষ। তারাই এর জন্য অর্থ দিয়েছিলেন, যাদের কেউই এখানে ডোনার নন, সবাই ফান্ডার।
ইকুইটি ক্রাউডফান্ডিং মডেল বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল। এই মডেলটি মূলত বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তার মধ্যে সম্পর্কের কাজ করে। এইজন্য এই মডেলটি ক্রাউড ইনভেস্ট নামেও পরিচিত। এখানে একজন উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়িক মডেলটি বিস্তারিত উপস্থাপন করেন। আগ্রহী বিনিয়োগকারী তাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ পান এবং বিনিময়ে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নেন। ফলে প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় করে যা লাভ করবে, বিনিয়োগকারী তার শেয়ার অনুপাতে লভ্যাংশ নেবেন। এই মডেল অনুসারে এখানে কেউ ডোনার বা ফান্ডার নন, সবাই বিনিয়োগকারী। ব্যবসায় বাণিজ্যে বিনিয়োগের এটি একটা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ধরা হয়, যা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আলাদা। ব্যাংক ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলো যেখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না, সেখানে উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়ের জন্য ক্রাউডফান্ডিংয়ের এই মডেলটি অনুসরণ করে বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে পারেন। তবে এখানে একজন বিনিয়োগকারী ঠিক কত পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবেন, তা দেশভেদে নির্দিষ্ট করে দেয়া থাকে। আমেরিকাতে কোনো একজনের বার্ষিক আয় যদি ১ লাখ ডলারের কম হয়, তাহলে তিনি বছরে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করতে পারেন। প্রোফাউন্ডার ২০১০ সালে প্রথম ইকুইটি ক্রাউডফান্ডিং মডেল নিয়ে কাজ করে। ২০১২ সালে আমেরিকাতে এর জন্য একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়, যা এ বছরের মার্চ মাসে চূড়ান্ত হয়।
সুদভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং হচ্ছে যেখানে অর্থদাতা তার আর্থ দেয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট হারে সুদ নিয়ে থাকেন। সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এইভাবে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়া একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত লোন হিসেবে এই মডেল অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহ করার সুযোগ পান।
ডোনেশন বা রিওয়ার্ডভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম যেকেউ তৈরি করতে পারেন এবং আইনি কোনো বাধা ছাড়াই এর কার্যক্রম চালাতে পারবেন। কিন্তু ইকুইটি বা সুদভিত্তিক মডেলে ক্রাউডফান্ডিং কার্যক্রম চালাতে গেলে অনেকগুলো আইনি দিক অনুসরণ করে তা চালাতে হবে। এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমতি নেয়া লাগতে পারে এবং যারা বিনিয়োগ করবেন তাদের কর শনাক্তকারী নাম্বার রেজিস্ট্রেশন করা লাগবে। পাশাপাশি ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার কাগজপত্র থাকতে হবে।
বাংলাদেশে ক্রাউডফান্ডিংয়ের যাত্রা
এ বছরের শুরুর দিকে ওয়াইজ রহিমের হাত ধরে আমরা একটি ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম পাই, যা প্রজেক্ট ডটসিও নামে এদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে ছোট আকারে দুটি প্রজেক্টে সফলভাবে ফান্ডিং সম্পন্ন করেছে প্রজেক্ট ডটসিও। প্লাটফর্ম বলতে এই একটি আছে আমাদের দেশে। তবে এএম ইশতিয়াক সারওয়ার এক আইটি উদ্যোক্তা ‘পার এ পার’ নামে শুরু করতে যাচ্ছেন আমাদের দেশের দ্বিতীয় ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে মাহাবুব ওসমান ও তার দল ক্রাউডফান্ডিং সফট নামে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন। ৪ লাখ টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিগত জুন মাসে যাত্রা শুরু করা এই ক্যাম্পেইনটি সফলতার দিকেই এগোচ্ছে। এ কথা বলা যায়, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা চলতে পারছি না। তবে যাত্রা শুরু যেহেতু করতে পেরেছি, এখন আমরা যদি একে স্বাগত জানাই তাহলে খুব বেশি দূরে নয় আমাদের দেশের উদ্যোক্তারাও বিলিয়ন ডলারের ফান্ড সংগ্রহ করতে পারবেন।
আমাদের দেশে ক্রাউডফান্ডিংয়ের আইনি দিক
আইনের নানা ধরনের জটিলতার কারণে আমরা ক্রাউডফান্ডিংয়ের সব সুবিধা হয়তো এখনই পাব না। তবে অনুদান ও রিওয়ার্ডভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং শুরু করতে পারি। আইনি বিভিন্ন দিক নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে (বাংলাদেশ সদ্য নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে) ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে একটি দিকনির্দেশনা দেয়া হয়, যা আমরা অনুসরণ করতে পারি।
যেসব দেশ ক্রাউডফান্ডিংয়ের ধারণা গ্রহণ করতে চায় তাদের শুধু সক্রিয় নীতিমালা গ্রহণ করলেই চলবে না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন নীতিমালাগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে, যা এতে প্রবেশ, পরিচালনা এবং ব্যবসায়ের করার ক্ষেত্র দুর্বহ করে তোলে। যেমন- একটি ব্যবসায় গঠন প্রক্রিয়া ও এর সমাপ্তি অনেক বেশি জটিল ও দুঃসাধ্য, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সময় সাপেক্ষ এবং খরচের দিক থেকে অনেক বেশি ব্যয়বহুল।
তবে সম্প্রতি ভিন্ন উপায়ে বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলোর জন্য একটি নীতিমালা পাস করা হয়েছে। সেই একই নীতিমালায় ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারে। অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক বা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমতি নিয়েও কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য সফলতা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ক্রাউডফান্ডিংয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য কাজ করা ও নানাভাবে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। উদ্ভাবনী উদ্যোক্তাদের জন্য দেশে যাত্রা শুরু করেছে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম। কিন্তু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলো হাই প্রফিটেবল ব্যবসায়িক ধারণা ছাড়া ফান্ডিং কার্যক্রম চালাবে না। পাশাপাশি তাদের কাজ তাদের নিয়ে যাদের কোটি টাকা প্রয়োজন। সেই ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের একটি সহজ মাধ্যম হতে পারে ক্রাউডফান্ডিং। তবে সবার আগে আমাদের দেশে যারা দাতা হিসেবে ভূমিকা রাখবেন বা রাখতে পারবেন, তাদের প্রস্ত্তত করতে হবে। তাদেরকে সচেতন করে তোলার কার্যক্রম নিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৩৫ কোটি লোক রয়েছে যাদের আয় বছরে ১০ হাজার ডলারের চেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকেরই এই প্রতিবেদন থেকে আমরা একটি ধারণা নিতে পারি, আমাদের দেশে এমন কতজন মানুষ রয়েছেন যাদের বার্ষিক আয় ১০ হাজার ডলার বা তার বেশি। কিছু তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে এই সংখ্যাটা ১০ লাখের মতো পাওয়া গেছে। এদের মধ্য থেকে যদি ১ লাখ মানুষকে আমরা ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে পারি এবং তাদের আয়ের ১০০ ভাগের এক ভাগও যদি বার্ষিক সঞ্চয় বা বিনিয়োগ হিসেবে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়, তাহলে আমাদের দেশের ক্রাউডফান্ডিংয়ের ভলিউম দাঁড়াবে ১ কোটি ডলারে, যার ৪০ ভাগ ব্যবসায় বাণিজ্যের বিনিয়োগে ফান্ডিং করলে এই খাত থেকে বছরে অন্তত ৫শ’ ব্যবসায় বিনিয়োগ করার সুযোগ তৈরি হবে, যা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় আকারের পরিবর্তন নিয়ে আসবে। বিশ্বে যেভাবে ক্রাউডফান্ডিংয়ের উন্নতির গ্রাফ ওপরের দিকে উঠছে, আমাদের দেশে তার প্রভাব পড়তে শুরু করলে ধারণা করা যায়, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে এর ভলিউম ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
পরিশেষ
শুরুতেই আমরা ক্রাউডফান্ডিংয়ের সব সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে না পারলেও এর মাধ্যমে আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা সমাজের নানা সমস্যার সমাধানে অর্থের সঙ্কুলান করতে পারবেন সহজেই। ব্যবসায় বাণিজ্যের দিক থেকে ই-কমার্স উদ্যোক্তারা এর সম্পূর্ণ সুফল পেতে পারেন। রিওয়ার্ডভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং সেবা ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বৈপস্নবিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। পেবল স্মার্টওয়াচ এর একটি বাস্তব উদাহরণ। তবে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন উদ্ভাবনী উদ্যোক্তারা

ক্রাউডফান্ডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই একাডেমিক রিসার্চ করার জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্স পারচেস করতে পারবেন। এছাড়া আমাদের দেশে এখন যেহেতু গবেষণার জন্য খুব ভালো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেই, তাই যারা গবেষণা করতে চান তারা ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে সহজে তা করতে পারবেন বলেই আশা করা যায়।

মুহাম্মদ তারেক হাবীব
সহকারী অধ্যাপক
কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
গ্রিন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

ক্রাউডফান্ডিং বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পুরোদমে যাত্রা শুরু করেনি। তবে বাংলাদেশের আইসিটি সেক্টর এবং অন্যান্য সেক্টরের উন্নতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য যে মানুষকে খুব বেশি আত্মত্যাগ করতে হবে তাও নয়। শুধু দরকার মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন। ফেসবুকের মাধ্যমে এখন অনেকের সাথেই যুক্ত হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে অনেক ভালো উদ্যোগের জন্য সংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। তবে একই সাথে এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে, এই দিকে প্রতারণার ঘটনাও ঘটবে।
তবে ক্রাউডফান্ডিং নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই উপযুক্ত সময়। বিশেষ করে ই-কমার্স সেক্টরে উদ্যোক্তা এর মাধ্যমে খুবই উপকৃত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে এই মুহূর্তে প্রায় ২শ’র মতো ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম রয়েছে। আর সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার জন্য ফান্ড তোলা বেশ জনপ্রিয়। সারাবিশ্বে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে যেই অর্থ তোলা হয়, তার বড় অংশই আসে যুক্তরাষ্ট্রে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এমনিতেই নানা ধরনের ফান্ডের সুবিধা আমেরিকাতে আছে। তাই এর উপরে যদি আবার ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে আরও সহজ পদ্ধতিতে টাকা পায়, তাহলে তারা আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সুবিধা পাবে। তাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে এই কালচার গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশে ক্রাউডফান্ডিংয়ের আন্দোলন ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলো শেয়ার মার্কেটে ঢুকে অর্থ সংগ্রহের কথা চিমন্তা করতে পারে না। ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ এবং তার থেকেও বড় কথা হলো ব্যাংকগুলো ত্যেলা মাথায় তেল দিতে চায়। অর্থাৎ যাদের খুব একটা ঋণ নেয়ার দরকার নেই, তারাই ঋণ পায়। আর সামাজিক সমস্যায় তেমন কেউ এগিয়ে আসে না। ফলে দেখা যায় ১০ হাজার টাকার অভাবে কোনো রাস্তা ঠিক হচ্ছে না এবং সেই রাস্তা মরণ ফাঁদে পরিণত হয়। শিক্ষা ও গবেষণাতেও ক্রাউডফান্ডিং বদলে দিতে পারে চালচিত্র। ই-ক্যাবের সভাপতি হিসেবে ই-কমার্সের ওপর একটি সার্ভে বা জরিপের ব্যাপারে আমি খুব আগ্রহী। কিন্তু সমস্যা একটাই- এর জন্য টাকা দরকার। টাকা পাচ্ছি না। একইভাবে ই-ক্যাব থেকে একটি ই-কমার্সের ওপর বই প্রকাশের জন্য অনেক অনুরোধ এসেছে আমার কাছে। যদি মাত্র ১০০০ লোক এই বইটি পাওয়ার জন্য অগ্রিম টাকা দেয়, তাহলে প্রকাশক মনের আনন্দে এই বই প্রকাশ করবে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বা ইউআইইউ-কে ক্রাউডফান্ডিংয়ের ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছি ইনফরমালভাবে। সেখানে সাড়ে ছয় হাজারের মতো ছাত্র লেখাপড়া করে। প্রত্যেকের থেকে যদি ১০০ টাকা করে হলেও এক সেমিস্টারে (চার মাস) সংগ্রহ করা যায়, তাহলে প্রতি সেমিস্টারে ৬ লাখ টাকা উঠবে। এক লাখ টাকা করেও যদি ছয়জন ছাত্র উদ্যোক্তাকে দেয়া যায় তাহলে এক বছরে ১৮ জন উদ্যোক্তা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে তহবিল পাবে। চার মাসে ১০০ টাকা মানে গড়ে এক টাকারও কম। এই টাকার সাথে যদি বিশ্ববিদ্যালয়টি সমপরিমাণ অর্থ যোগ করে, তাহলে বিশাল একটি তহবিল গড়ে উঠবে।
ক্রাউডফান্ডিং আসলে জটিল কোনো বিষয় নয়। প্রতিদিন ১০ হাজার লোক যদি ১০ টাকার একটি করে সিগারেট না খেয়ে এই টাকাটা কোনো একটি ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মে দান করে, তাহলে প্রতিদিন একজন করে উদ্যোক্তাকে ১ লাখ করে টাকা দেয়া সম্ভব। এই সামান্য বিষয়টি যদি ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশে প্রতিদিন নতুন করে ৬৪ জন উদ্যোক্তা তৈরি হতে পারে।
ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির জন্য ক্রাউডফান্ডিংয়ের দরকার খুব বেশি। ব্যাংকগুলো এখনও এ খাতে ঋণ দেয় না। ই-ক্যাবের বেশি উদ্যোক্তা অল্প বয়সী তরুণ এবং মূলধনের সঙ্কট তাদের জন্য খুব বেশি। অথচ যারা মোটামুটি মূলধন নিয়ে নামতে পেরেছে, তাদেরও রোজার মাসে হয়তো এত ডেলিভারি এলো যে তা সরবরাহ করার মতো মূলধন তাদের হাতে নেই। আন্দাজে এই ধরনের কথা বলছি না, বরং রোজার সময় বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা আমাকে এই কথা জানিয়েছে। ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে আমাদের ই-ক্যাবের কিছু ওয়েবসাইট হয়তো তাদের পণ্যের অগ্রিম অর্ডারও পেতে পারে। আমের সময় রাজশাহী বিভাগ থেকে আসা আম কী পরিমাণ আনা দরকার, সে নিয়ে অনেক উদ্যোক্তাই টেনশনে থাকেন। আর এটি ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মে কিংবা ফেসবুকে যদি কিছু লোক সম্মিলিতভাবে কোনো ই-কমার্স ওয়েবসাইটের প্রচারণা চালায় তাহলে সেই সাইটের ভিজিটর ও বিক্রি দুই-ই বেড়ে যাবে। খুব বেশিদিন হয়নি আমাদের ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধন পেয়েছে। নিবন্ধনের আগে যে কয়টি আড্ডা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে সবাই চাঁদা দিয়ে যোগ দেয়।

রাজিব আহমেদ
সভাপতি
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)
ব্রিটেনে আমার একটি ব্যবসার জন্য আমি ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেছিলাম। ফান্ডিং সার্কেলে আমার প্রপোজালটি যখন দেই তার ঠিক ২ দিনের মধ্যে কিছু সংশোধনীসহ ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা ও গড় ইন্টারেস্ট হার হিসেব করে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। ইন্টারেস্ট হার কিছুটা বেশি হলেও এর সহজলভ্যতা, সিকিউরিটি রিকয়ারমেন্টস এবং আরো অনেক সুবিধা বিবেচনায় আমরা তা গ্রহণ করি। কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই আমরা প্রতি মাসে ইনস্টলমেন্ট পরিশোধ করছি। বাংলাদেশ এখনো এর সুফল না পেলেও আশা রাখছি খুব শিগগিরই এর সফলতা আসবে।

আবদুল হাকিম ভূইয়া
পরিচালক, ডিএন্ডএইচ ফ্যাশনস্ লিমিটেড

বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রাউডফান্ডিং
ক্রাউডফান্ডিং সূচিত হওয়ার পর থেকেই সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এর প্রভাব বাড়তে থাকে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মাত্র ছয় বছরে এর আকার বেড়েছে বহুগুণ। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য পাশে পেয়েছেন ক্রাউডফান্ডিংকে। একটি দেশের সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার, গবেষণা, চিকিৎসা, মানবিক সাহায্য, উদ্ভাবন, প্রযুক্তির প্রসার ইত্যাদি প্রায় সব ক্ষেত্রে ক্রাউডফান্ডিং অভাবনীয় ভূমিকা রেখে চলছে। আগেও ক্রাউডফান্ডিং ছিল। কিন্তু ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসার ক্রাউডফান্ডিংকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে নেপালের ভূমিকম্পে আক্রান্ত মানুষের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সহায়তা তহবিল গঠন করতে পারছে। সাধারণ মানুষের পাশে সাধারণ মানুষকে দাঁড় করাতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মগুলো। এক সময় বিনিয়োগ বা আর্থিক যেকোনো সহায়তার জন্য সাধারণ মানুষ ব্যাংক, সরকার ও বিত্তশালীদের দিকে তাকিয়ে থাকত। ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ব্যাংকের বিকল্প অর্থ ব্যবস্থা। শুধু বিত্তশালীরাই নন, এতে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসছেন সাধারণ মানুষও। ডোনেশন, ফান্ডার, বিনিয়োগকারী হিসেবে এরা গড়ে তুলছেন একেকটি সফল কার্যক্রম। ২০০৯ সালে যেখানে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ৫৩০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেখানে ২০১৪-তে এসে এর আকার দাঁড়ায় ১৬.৪ বিলিয়ন ডলারে। ক্রাউডফান্ডিং ডটঅর্গের গবেষণা অনুসারে, ২০১৫ সালে এর আকার দ্বিগুণ হয়ে ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এই পরিসংখ্যান থেকেই ক্রাউডফান্ডিংয়ের বিশ্ব অর্থনীতিতে ভূমিকা অনুধাবন করা যায়।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিভিন্ন মহাদেশের ক্রাউডফান্ডিংয়ের তুলনামূলক চিত্র
উত্তর আমেরিকা : আগের বছরের চেয়ে ক্রাউডফান্ডিং ভলিউম বেড়েছে ১৪৫ শতাংশ, যার আকার এখন ৯.৪৬ বিলিয়ন ডলার।
এশিয়া : ক্রাউডফান্ডিং ভলিউম বেড়েছে ৩২০ শতাংশ এবং এর আকার এখন ৩.৪ বিলিয়ন ডলার।
ইউরোপ : এশিয়ার অসাধারণ উন্নতির কারণে তৃতীয়তে নেমে গেছে ইউরোপ, যাদের ভলিউম বেড়েছে ১৪১ শতাংশ ও বাজার ৩.২৬ বিলিয়ন ডলার।
দক্ষিণ আমেরিকা : পরিমাণ বেড়েছে ১৬৭ শতাংশ।
ওশেনিয়া : পরিমাণ বেড়েছে ৫৯ শতাংশ।
আফ্রিকা : পরিমাণ বেড়েছে ১০১ শতাংশ।
রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এশিয়া মহাদেশীয় অঞ্চলের। ২০০৯ সালে মাত্র ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার ছিল এশিয়ার অর্জন, সেখান থেকে এখন তা ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এশিয়া মহাদেশের এত উন্নতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে চীন। সেখানে ২১১টি ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছে, যারা জুন মাস পর্যন্ত ৪৬৬.৬ কোটি ইউয়ান সংগ্রহ করেছে। আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভারতেও গড়ে উঠেছে অনেকগুলো ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ খুব ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে ক্রাউডফান্ডিংকে। সেখানে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওইশবেরি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নাট্যদল ‘মুখোশ’ তাদের ‘বৃষ্টি ফাইনাল’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে, যা সেখানকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের অনেক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
২০১৪ সালের ক্রাউডফান্ডিং ডটঅর্গের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়েছে ব্যবসায় ও উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে ৪১.৩ শতাংশ, যার পরিমাণ ৬.৭ বিলিয়ন ডলার। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সামাজিক বিভিন্ন কাজে ১৮.৯ শতাংশ, যার পরিমাণ ৩০৬ কোটি ডলার। ফিল্ম ও শিল্পকলা প্রদর্শন পেয়েছে ১২.১৩ শতাংশ, যার পরিমাণ ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার।
ব্যবসায় বাণিজ্যে ক্রাউডফান্ডিং ও পেবল স্মার্টওয়াচ
২০১৪ সালের প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, ওই বছর ব্যবসায়-বাণিজ্য বিভাগ ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে পেয়েছে ৬৭০ কোটি ডলার। এরা সবাই যে তাদের ব্যবসায়ের শেয়ার বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করেছেন তা নয়। অনেকেই অর্থ পেয়েছেন রিওয়ার্ড ক্রাউডফান্ডিং ভিত্তিতে। রিওয়ার্ড ক্রাউডফান্ডিং ডিজিটাল পণ্য ব্যবসায়ী বা ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই উপযোগী। একটি উদাহরণ থেকে এই বিষয়টি আরও সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারব। উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপ ‘পেবল স্মার্টওয়াচ’ নামে একটি ক্রাউডফান্ডিং ক্যাম্পেইন চালিয়েছিল ২০১২ সালে। কিকস্টার্টার থেকে চালানো সেই ক্যাম্পেইনে এরা এদের ঘড়ির জন্য প্রি অর্ডার বাবদ প্রত্যেকের কাছে ৯৯ ডলার করে চেয়েছিল। ৫০ হাজার ডলার লক্ষ্যমাত্রা রেখে চালানো সেই ক্যাম্পেইন থেকে এরা শেষ পর্যন্ত ৫০ হাজার ডলার পায়নি! পেয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ১ কোটি ২ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৫ ডলার। ৬৮ হাজার ৯২৯ জন দাতা গড়ে তাদেরকে ১৪৯ ডলার করে দিয়েছিল, যা ক্রাউডফান্ডিংয়ের ইতিহাসে অন্যতম সফল এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি উদাহরণ।
ক্রাউডফান্ডিং প্রতারণা
এত ভালো পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যে ব্যবস্থাটি, সেটি স্বাভাবিকভাবেই একেবারে বিশুদ্ধ কোনো ব্যবস্থা নয়। ক্রাউডফান্ডিংয়ের নামে প্রতারণা খুব কম হচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি হচ্ছে। আর তাই এন্টারপ্রেনিওর ওয়েবসাইট এক রিপোর্টের শিরোনামে ক্রাউডফান্ডিংকে ক্রাউডফ্রডিং বলতে বাধ্য হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে এই ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর ফলে তা অনেকাংশে রোধ করা গেছে। ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্মগুলো এখন নিজেদের উদ্যোগে এ নিয়ে তাদের সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন নানা সময়ে প্রতারণা রোধে রিসার্চ করছে এবং তা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে। ক্রাউডফান্ডইনসাইডার তেমনি একটি।

পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৫ - আগস্ট সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস